Saturday, May 18, 2024
Homeকলামশাসনবেড়ির সুবাদে বঙ্গে ভাগাভাগির ছবি ভোটে

শাসনবেড়ির সুবাদে বঙ্গে ভাগাভাগির ছবি ভোটে

  • গৌতম সরকার

আমাদের এখন মনে হচ্ছে, ভোটের ফলাফলের চেয়েও বেশি অনিশ্চিত কুণাল ঘোষের ভবিষ্যৎ। অতঃপর কী করবেন কুণাল, পদ কাড়লেও তৃণমূল তাঁকে দল থেকে ঘাড়ধাক্কা দেবে কি না কিংবা অন্য অনেকের মতো ক্ষুব্ধ হয়ে পদ্মপুকুরে আশ্রয় নেবেন কি না ইত্যাদি চর্চার শেষ নেই। ভোটবাজারে হঠাৎ দু’দিন অন্য সবকিছু ছাপিয়ে যেন দোলা দিয়ে গেল কুণাল ঢেউ। এ রকম ঘটনা নতুন নয়।

বাম আমলে যাঁর সঙ্গে কুণালের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল, সেই সুভাষ চক্রবর্তী সম্পর্কে বিদ্রোহের গল্প ছড়িয়েছিল। খবর ছড়িয়েছিল, সইফুদ্দিন চৌধুরী, সমীর পুততুণ্ডদের সঙ্গে সুভাষও সিপিএমের জার্সি ছেড়ে অনিশ্চিতের নৌকায় পা বাড়াবেন। জল্পনার মুখে ছাই দিয়ে সে কাজটি সুভাষ করেননি। কুণাল করবেন, এরকম ইঙ্গিত অন্তত এখনও দেননি। বরং তিনি বলে চলেছেন, তৃণমূলে থাকার চেষ্টা করব। বহিষ্কৃত হলেও নাকি তৃণমূলের সমর্থক হয়ে থাকবেন।

সুভাষের গায়ে মার্কসবাদের নামাবলি ছিল। সেই নামাবলি নিয়ে তাঁর খুব মাথাব্যথা ছিল না। মার্কসবাদের আস্থা নাস্তিকতায়। সুভাষ কিন্তু পরমানন্দে তারাপীঠের মূর্তিতে লাল জবার মালা পরিয়েছিলেন। আসলে তিনি যত না কমিউনিস্ট, তার চেয়েও বেশি ঘোর বাস্তববাদী। রাজ্যে বাম শাসন চললেও তিনি জানতেন, ধর্মে মতি অধিকাংশ বঙ্গবাসীর। বিপরীত স্রোতে হাঁটা সংসদীয় রাজনীতির কুশীলবদের কাছে বোকামি।

বরং মানুষকে নিজের মতে টেনে আনার চেয়ে সহজ মানুষের পছন্দের স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন সুভাষ। যে কারণে সিপিএমের বাইরেও তাঁর ফ্যান-বন্ধু বৃত্তটা বেশ বড় ছিল। বাস্তববাদী বলেই তিনি জানতেন, দলের তকমাটা ঝেড়ে ফেললে সেই জনপ্রিয়তাটা ধীরে ধীরে ঝরে যাবে। যেমন ঘটেছে সফি, সমীরদের ক্ষেত্রে। মতাদর্শের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য না থাকলে মানুষ ক্ষমতার কাছে থাকতে চায়।

কিছু মানুষ বিশেষ করে বামপন্থীরা বলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনীতিতে দুই পক্ষ (ইংরেজিতে বাইনারি) তৈরি করা হচ্ছে। আসলে বিষয়টা ইচ্ছাকৃত নয়। এটা তৈরি হয় ক্ষমতার কারণে। ক্ষমতা মানে শাসনের দণ্ড হাতে থাকা। তৃণমূল ও বিজেপি উভয়ই এখন ক্ষমতাসীন। কেউ রাজ্যে, কেউ কেন্দ্রে বা ভিনরাজ্যে। কেরলে ক্ষমতায় থাকলেও বাংলায় কংগ্রেসি সখ্যে যে স্বপ্ন ফেরি করছে সিপিএম, তা এখনও হালে পানি পাচ্ছে না মানুষের কাছে।

বরং ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সহজাত প্রবৃত্তির কারণে বঙ্গবাসীর কাছে তৃণমূল ও বিজেপি প্রায় সমান প্রাসঙ্গিক। এই দুই দলের প্রতিপক্ষ হওয়া কার্যত মনুষ্যসৃষ্ট। কোনও দল বা সংবাদমাধ্যমের সাধ্য নেই জোর করে ‘বাইনারি’ তৈরি করা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, আটের দশকের প্রথম দিকে বাংলায় মার্কসবাদ নামক বিপ্লব বটিকায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ক্ষমতাসীন বামেদের বাইরে ভিন্ন কিছু করার স্বপ্ন দেখেছিল নবীন প্রজন্মের একাংশ।

যে মুহূর্তে তাঁরা দলের বাইরে চলে গেলেন, সেই মুহূর্তে তাঁরা হয়ে গেলেন নিঃসঙ্গ। ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই বুঝে সেই ‘বিপ্লবী’দের পছন্দ করলেও মানুষ তাঁদের হাত ধরেনি। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিতে চাণক্য বলে পরিচিত ধুরন্ধর নেতাও কংগ্রেসের বাইরে গিয়ে হারিয়ে যেতে বসেছিলেন। পরে কংগ্রেসে ফিরে সেই ক্ষমতার চূড়ায় নিশ্চিন্তে কাটিয়ে গিয়েছেন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত।

একমাত্র তিতিবিরক্ত, অতিষ্ঠ হলেই শুধু নীরবে মানুষ ক্ষমতাসীনদের ছুড়ে ফেলে দেয়। যেমন দিয়েছিল ১৯৭৭ সালে কিংবা ২০১১-তে। ১৯৭৭-এর জয়ে বামেদের কৃতিত্ব যত না, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল ইন্দিরা শাসন থেকে মুক্ত হতে জনতার মরিয়া তাগিদ। ২০১১-তে তৃণমূলের জয়জয়কারের নেপথ্যে ছিল সিপিএমের ঔদ্ধত্য, স্থানীয় স্তরে দলের কিছু নেতার অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিঃশব্দে গণরায়।

ভেবে দেখুন, সিপিএম বা বাম শরিকদের যা কিছু বাড়বাড়ন্ত, তা ঘটেছিল ’৭৭-এর পরে। আবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দ্রুত তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে দলীয় ইমারত। তৃণমূলেরও বাংলায় আধিপত্য বিস্তার ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর। সংশ্লিষ্ট রাজ্যে ক্ষমতা নেই বলে শত চেষ্টা এবং কোটি কোটি টাকা লগ্নি সত্ত্বেও ত্রিপুরা, অসম, মেঘালয় বা গোয়ায় দাঁত ফোটাতে পারেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল।

কুণাল ঘোষ ঘোর বাস্তববাদী। না হলে সারদা কেলেঙ্কারিতে তৃণমূল সরকার তাঁকে দীর্ঘ কারাবাসে পাঠানো বা রাজ্যের পুলিশ বিভিন্ন সময় তাঁকে চরম হেনস্তা করার পর কুণাল সেই তৃণমূলে আঠার মতো লেগে থাকতেন না। পেশায় সাংবাদিক, রাজনীতির উত্থান-পতন, আনাচ-কানাচ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল কুণাল বাস্তববাদী বলেই আবেগে ভেসে কোনও পদক্ষেপ করবেন বলে মনে হয় না। যাঁরা করেছিলেন দলের প্রতি রাগে-ক্ষোভে, তাঁদের বড় অংশ আবার নাকে খত দিয়ে তৃণমূলে ভিড়েছেন।

কুণাল একটি উদাহরণ মাত্র। তৃণমূলের উৎখাত হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত না হলে হাজার হাজার কুণাল কোণঠাসা, বিক্ষুব্ধ এমনকি অত্যাচারিত হলেও ঝাঁকের কইয়ের মতো ঝাঁকে থেকে যাবেন। দুর্নীতি, কর্মসংস্থানের অভাব যতই প্রকট হোক, বাংলায় তৃণমূলের ক্ষমতাচ্যুতির সম্ভাবনাটা এখনও স্পষ্ট নয় বলে জমি থাকলেও পদ্মের চাষ আশানুরূপ হচ্ছে না। শুধু ক্ষমতা আছে বলে বাংলায় চাষের জমিটা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে রেখেছে ঘাসফুল ও পদ্মফুল। লোকসভা ভোটের ফলে সম্ভবত তার প্রতিফলন দেখা যাবে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Hardik Pandya Banned | মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে দুঃসংবাদ! পরের আইপিএলে প্রথম ম্যাচে নির্বাসিত হার্দিক

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: একে তো ঘরের মাঠে লখনউ সুপার জায়ান্টসের (Lucknow Super Giants) কাছে পরাজয় মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের (Mumbai Indians)। পাশাপাশি পয়েন্টস টেবিলে একেবারে...

Bus Accident | চাকুলিয়ায় বাস দুর্ঘটনায় মৃত ২, আহত চার বাংলাদেশি সহ ১৩

0
কানকি: মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনায় (Bus Accident) মৃত্যু হল ২ জনের। আহত চার বাংলাদেশি সহ ১৩ জন। চাকুলিয়া (Chakulia) থানার কানকি ফাঁড়ির ২৭ নম্বর জাতীয়...

Bus catches fire | যাত্রীবাহী চলন্ত বাসে আগুন, পুড়ে মৃত্যু ৮ জনের, আহত বেশ...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: যাত্রীবোঝাই চলন্ত বাসে আগুন (Bus catches fire) লেগে মৃত্যু হল ৮ জনের। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। শুক্রবার গভীর রাতে ঘটনাটি...

West bengal weather update | রাজ্যের সাত জেলায় তাপপ্রবাহের সতর্কতা, জেনে নিন বিস্তারিত…

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মাঝে ক’দিন স্বস্তির বৃষ্টি হয়েছে বঙ্গে। ফলে তীব্র গরম থেকে কিছুটা রেহাই পেয়েছিল বঙ্গবাসী। ফের পারদ চড়তে শুরু করায় বাড়ছে...

NBMC | দালাল ধরে টাকা দিতেই হাতে এল মৃত্যুর শংসাপত্র! তদন্তের আশ্বাস মেডিকেল সুপারের...

0
শিলিগুড়িঃ মৃত্যুর শংসাপত্র পেতে ১৫০০ টাকা দিতে হল উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। যে পরিবার মৃত্যুর শংসাপত্র পেতে দেড় মাস ধরে ঘুরছিল, সেই পরিবারই...

Most Popular