- পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়
সম্প্রতি মায়াপুরের ইসকন মন্দিরে দুই পোষা হাতি তাদের মাহুতকে আছড়ে মেরেছে। দুই মাহুতই রাভা সম্প্রদায়ের। এরা হয় উত্তরবঙ্গের বা অসমের বাসিন্দা। কেন দুই হাতিই একই কাণ্ড করল তা বুঝতে আমি উত্তরবঙ্গের দুটি ঘটনার বিবরণ দেব।
বছর চল্লিশ আগে রাজাভাতখাওয়া জংশন স্টেশনের পশ্চিমদিকের বস্তিতে হাঁড়িয়ার ব্যবসা করত এক উপজাতি পরিবার। হাঁড়িয়ার গন্ধে হাতি চলে আসে হাঁড়িয়া খেতে। রাত প্রায় দুটো। পরিবার মাস ছয়-সাতেকের শিশুকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় ঝুপড়ি-বাড়ির পেছন দিকে ধাক্কার শব্দ। স্বামী-স্ত্রী দেখে এক হাতি ঘর ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে। ভীষণ ভয়ে দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। উত্তজেনায় ভুলে যায় শিশুর কথা। হাতি ঘর ভেঙে হাঁড়ি থেকে হাঁড়িয়া খেয়ে নেয়। তারপর আলতো করে শুঁড়ের মাথায় শিশুটিকে তুলে সামনের উঠোনে নিয়ে আসে। এক নিরাপদ জায়গায় শিশুটিকে শুইয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গলের দিকে চলে যায়।
দ্বিতীয় ঘটনা বছর তিরিশ আগের কথা, সেই রাজাভাতখাওয়ার ঘটনা। ব্যবসায়ী প্রেম গোয়েঙ্কার ভাই একসময় এক হাতিকে তাড়াতে গিয়ে ধারালো কিছু দিয়ে তাকে আঘাত করে। একদিন রাতে সেই হাতি এসে প্রেমের বাড়িতে হামলা করে। পাড়ার মানুষ জড়ো হয়ে যায় হাতি তাড়াতে। কিন্তু একসময় সেই হাতি সামনে পেয়ে যায় প্রেমের সেই ভাইকে। এতই ক্রুদ্ধ ছিল সেই হাতি যে পা দিয়ে নৃশংসভাবে পিষে মারে তাকে। বন্যপ্রাণী নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে হাতির মানসিকতা অজানা নয়। কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ প্রকৃতির নিয়মকে উপেক্ষা করে পশুকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। ভুলের মাশুল দিতে হয় এবং হবে।
মার্চ মাসের মাঝামাঝি বক্সা ব্যাঘ্র-প্রকল্পের (একমাত্র ব্যাঘ্র-প্রকল্প, যেখানে কোনও বাঘ নেই) এলাকার অন্তর্গত ভুটিয়া বস্তির ৫১ পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থসাহায্য দেওয়া হল তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য। আগে গাঙ্গুটিয়া বস্তির ১৯১ পরিবারকে একইভাবে সাহায্য দেওয়া হয়েছে। এঁদের নতুন আবাসস্থল হবে কালচিনির ভাটপাড়া চা বাগানের লাগোয়া জমিতে। বাহারি নাম পরিকল্পিত গ্রামের, বনছায়া। কিন্তু বক্সা ব্যাঘ্র-প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত লোকদের কাছে শোনা যাচ্ছে, এই নতুন আবাসস্থল সঙ্কোশ থেকে জলদাপাড়ার দিকে যাওয়া হাতিদের করিডরের উপর অবস্থিত।
আসলে ব্যাঘ্র-প্রকল্পের ৭৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৩৬ বন-গ্রাম আছে। এছাড়াও অনেক পরিযায়ী এবং ব্যবসায়ী মানুষ এই এলাকাতে আছেন। আলিপুরদুয়ার শহরের লাগোয়া রাজাভাতখাওয়াতেও গত পঞ্চাশ বছরে লোকসংখ্যা অসম্ভব বেড়েছে। হাতি এই বছর জঙ্গলে পর্যাপ্ত খাদ্য না পাওয়ায় বেশি ফলন হওয়া চালতা খেতে আশপাশের গ্রামগুলিতে চলে আসছে। মানুষ এবং বন্যপশুর এই রকম সহাবস্থান কি সংরক্ষিত অরণ্যের পক্ষে উপযোগী? বাঘের খাদ্য জোগান দিতে ইতিমধ্যে ৬০০ হরিণ ছাড়া হয়েছে এলাকায়। এর পরে ধরে নিলাম, ‘পায়ে পড়ি বাঘমামা’ গেয়ে বাঘকে নিয়ে আসা গেল। তারপর মানুষের এলাকায় হাতির পাশাপাশি বাঘের হামলা রুখতে রাত জেগে পাহারা দিতে হবে না তো?
(লেখক আলিপুরদুয়ারের ভূমিপুত্র। বর্তমানে খড়দহের বাসিন্দা)