গৌরহরি দাস, কোচবিহার : নেতা-কর্মীদের ভিড়ে একসময় গমগম করত রাজ রাজেন্দ্রনায়ারণ রোডের ধারে থাকা পার্টি অফিসটি। কিন্তু বামেদের হাত থেকে রাজ্যের শাসনভার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়েছে সেই সুদিন। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন কর্মীরাও। এখন এমন অবস্থা যে, দল চালানোর টাকাটাও নেই। তাই বাধ্য হয় তিনতলা জেলা কার্যালয়ে একটা অংশ লিজ দিয়ে দিল ফরওয়ার্ড ব্লক। এখন সেখানে চলছে স্টল তৈরির কাজ।
দলীয় কার্যালয় ভাড়া দেওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহার জেলা সভাপতি দীপক সরকার। তিনি বলছেন, আর্থিক সমস্যার কারণে জেলা কার্যালয়ে নীচের একটা অংশ ৩০ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, ওই জায়গা শুধুমাত্র চিকিত্সার প্রযোজনেই ব্যবহার করতে পারবে।
সদস্যদের মাসিক চাঁদা দিয়ে মূলত চলে ফরওয়ার্ড ব্লক। এই চাঁদার অঙ্ক ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২৫ টাকা কিংবা তার বেশিও রয়েছে। যেমন জেলা কমিটির সদস্যরা মাসে ১০০ টাকা করে চাঁদা দেন। আগে প্রচুর সদস্যপদ থাকায় মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় হত। কিন্তু রাজ্যপাট বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে দলের সদস্য সংখ্যাও কমতে শুরু করে। এই অবস্থায় দল চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন নেতারা। সেই কারণেই জেলা কার্যালয়ে পশ্চিম দিকে নীচতলার একটি অংশ লিজ দেওয়া হয়েছে। লিজ বাবদ এককালীন মিলেছে ৩৬ লক্ষ টাকা। এছাড়া প্রতিমাসে ভাড়া বাবদ আদায় হবে ৭২ হাজার টাকা। এই টাকায় আগামীদিনে জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি চালাবে ফরওয়ার্ড ব্লক।
রবিবার পার্টি অফিসে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে স্টল তৈরির কাজ প্রায় শেষের পথে। দলীয় নেতাদের দাবি, ওই স্টল দুটিতে ডাক্তার বসতে পারেন। বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থাও থাকতে পারে। সেই শর্তেই ওই অংশটুকু ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কে বা কারা সেটি ভাড়া নিয়েছেন, তা খোলসা করতে চাননি নেতারা।
রাজ্যে বামেরা ক্ষমতায় থাকাকালীন ফরওয়ার্ড ব্লকের রমরমা ছিল কোচবিহারে। এই ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে উঠে এসেছিলেন কমল গুহর মতো দাপুটে মন্ত্রী। পরেশ অধিকারী সহ ফরওয়ার্ড ব্লকের একাধিক বিধায়ক, সাংসদও ছিলেন এই জেলা থেকে। তাই সেসময় কোচবিহারকে ফরওয়ার্ড ব্লকের শক্ত ঘাঁটি বা দুর্গ বলা হত। উদয়ন গুহ ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক থাকাকালীন একটা সময় তাঁকে দলের রাজ্য সম্পাদক করারও দাবি উঠেছিল। কিন্তু সেই দুর্গে ঘুণ ধরতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতেই একে একে নেতারা সেখানে ভিড়ে গিয়েছেন। এমনকি উদয়নও। ফলে জোর কমেছে ‘সিংহে’র। যৌবন থেকে যেন বার্ধ্যক্যে পা রেখেছে সে।
দলের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, বাম আমলে দলের সদস্য সংখ্যা ছিল চার হাজারের মতো। এখন সেটা নেমে এসেছে ৮০০-য়। গত কয়েক বছরে গ্রাফটা অনেকটাই নিম্নমুখী। নেতারা দাবি করলেও, ফরওয়ার্ড ব্লকের যে কোনও কর্মসূচিতেই হাতেগোনা কয়েকজনকে দেখা যায়। ফলে বাকিরা নামেই সদস্য কি না তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে দলেই।
এমন অবস্থায় আয় কমে যাওয়ায় আর নেওয়া যাচ্ছে কোনও কর্মসূচি। অনেক সময় নেতারাই পকেট থেকে বিভিন্ন খরচ চালাচ্ছেন। তাই জেলা কার্যালয় ভাড়া দেওয়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের জেলা সম্পাদক অক্ষয় ঠাকুর। তিনি বলছেন, দলের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮০০-তে নেমে এসেছে। এই অবস্থায় দলের আর্থিক সমস্যা মেটাতে আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বছরখানেক আগে শিলিগুড়ির হকার্স কর্নারে সিটুর একটি কার্যালয় বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ায় ব্যাপক হইচই হয়েছিল। দিন দুয়েক আগেই পূর্ব বর্ধমানে দলের ৬টি গাড়ি ভাড়া দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা সিপিএম। এবার সামনে এল কোচবিহারে ফরওয়ার্ড ব্লকের কার্যালয় ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত। স্বাভাবিকভাবেই বামেদের রক্তক্ষয়ী চেহারাটা যেন স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমাগত। এরপর কোথায়? জল্পনা যেন চলছেই, চলবেই।