- গৌতম হোড়
চারদিকে উড়ছিল গেরুয়া পতাকা। সব বাড়ি, দোকান, গাড়ি, যানবাহনে লাগানো পতাকার রংও গেরুয়া। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাইকেলে করে পতাকা, শ্রীরামের ছবি ও ফুলমালা লাগিয়ে তরুণরা এসেছিলেন অযোধ্যায়। পথে গ্রামবাসীরা তাঁদের খাদ্য, পানীয় দিয়েছেন। থাকার আশ্রয় দিয়েছেন। গোটা অযোধ্যাজুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল সেই উন্মাদনা। মানুষের সঙ্গে দলে দলে সাধুরা এসেছিলেন। সমানে রাম-গান করে মিছিল হচ্ছিল। কখনও ‘জয় সিয়া রাম’ বলে, কখনও ‘রঘুপতি রাঘব’ গাইতে গাইতে নাচের ঘূর্ণি তুলছেন তরুণরা। উদ্বোধনের আগে থেকেই অযোধ্যার রাস্তায় পা দিলেই টের পাওয়া যাচ্ছিল এই উন্মাদনার ঝড়।
গোটা অযোধ্যায় অন্তত গোটা কুড়ি জায়গায় বিনা পয়সায় খাবার দেওয়া হয়েছিল। একবেলা নয়, চারবেলার খাবার। শীতের বস্ত্র দিয়ে ধর্মশালায় আশ্রয় দেওয়া হয় সাধারণ মানুষকে। রাম মন্দিরের পিছনে রামকথা কুঞ্জে দুইবেলা পাত পেড়ে খেয়েছেন পাঁচ হাজার মানুষ। রাম মন্দিরের অযোধ্যায় দুই ধরনের মানুষ এসেছিলেন। আমন্ত্রিত, যাঁদের মন্দির ট্রাস্ট, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা বিজেপি আসতে বলেছে। আর বিনা নিমন্ত্রণে প্রচুর মানুষ শ্রীরামের মন্দির দর্শন করতে এসেছেন। তার মধ্যে গরিব-গুর্বো মানুষের সংখ্যা প্রচুর। তাঁদের খাওয়া ছাড়াও কম্বল, গরম পোশাকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে মানুষ বিশ্বাস করছে, শ্রীরাম তাঁর জন্মস্থানে মন্দিরে অধিষ্ঠিত। আর এটা সম্ভব হয়েছে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির জন্য।
অযোধ্যার মন্দিরে যাওয়ার প্রবেশদ্বার তখন বন্ধ। মন্দির উদ্বোধন হতে দিন দুয়েক বাকি। গেটের বাইরে দেখা রতন রঞ্জনের সঙ্গে। দিল্লি থেকে এসেছেন তিনি। সঙ্গে একটি ভ্যান। তাতে মোদির বড়সড়ো কাটআউট। সঙ্গে শ্রীরাম, হনুমান ও যোগী আদিত্যনাথের ছবি। রতন রঞ্জনের হাতে একটা থালা। তাতে নারকেল, ধূপ, প্রদীপ এবং ফুল রাখা। সেই থালা ঘুরিয়ে ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছেন মোদির কাটআউটের উপর। মোদিকে এইভাবেই পুজো করতে করতে দিল্লি থেকে অযোধ্যা এসে পৌঁছেছেন। তাঁর সেই পুজো দেখতে ভিড় হচ্ছে প্রচুর। টিভি ক্যামেরার কল্যাণে সেই ছবি চলে যাচ্ছে গোটা ভারতে।
রতন রঞ্জনের দাবি, ভগবান শ্রীরাম তাঁকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছেন, মোদি এবং যোগী তাঁর মতো প্রজাদের কল্যাণের জন্য সমানে কাজ করছেন। তাঁরাও অবতার। তিনি এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ঘিরে সমবেত প্রচুর মানুষের গর্জন, ‘জয় শ্রীরাম’। এভাবেই লোকসভা নির্বাচন, রাম মন্দির, মোদি, যোগীর মধ্যে কোথাও যোগসূত্র তৈরি হয়ে যাচ্ছে। যে যোগসূত্রের কারণে, গোটা হিন্দি বলয়ে তো বটেই, দেশের অন্যত্রও তার প্রভাব পড়েছে। অযোধ্যায় দেখলাম শ্রীরামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাটআউট ও ছবি মোদি ও যোগীর। মনে পড়ছিল নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে ভিএইচপি, বিজেপি নেতা-সমর্থকদের একটা জটলায় একজন বলছিলেন, বিষ্ণুর ২৪ অবতারের কথা শুনেছি। মোদি নিশ্চয়ই ২৫তম অবতার। না হলে রাম মন্দির এভাবে বানাতে পারতেন না। অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কথায় প্রায় দুই হাত তুলে সমর্থন জানালেন।
বিজেপির নেতা-কর্মীদের মুখে এই কথা ও মোদিপুজোর ওই ছবিটা একটা বার্তা দিচ্ছে। প্রচারের অভিমুখ কী হবে, তার বার্তা। গোবলয়ে রাম মন্দির দেখিয়ে কেল্লা ফতের চেষ্টা করবে বিজেপি, তার বার্তা। নয়াদিল্লির উদাহরণ দিই। অযোধ্যা থেকে ফেরার পথে বিমানবন্দরে নেমে বাড়ির দিকে আসতে আসতে দেখছিলাম, গোটা রাজধানী মুড়ে গেছে ওই গেরুয়া পতাকায়। ফ্ল্যাটে, বাড়িতে, গাড়িতে, অটো, টোটোতে, দোকানে লাগানো সেই পতাকা। মন্দির উদ্বোধনের দিন চিত্তরঞ্জন পার্কের দুটি মার্কেটের সবজি, ফল, মাছ, মাংস বিক্রেতাদের অনেকেই তাঁদের দোকান বন্ধ রেখে কচুরি, তরকারি, মিষ্টি বানিয়ে সাধারণ মানুষকে খাইয়েছেন। তাদের বাঁধা খদ্দেরদের বাড়িতেও পাঠানো হয়েছে চারটি লাড্ডু সংবলিত মিষ্টির বাক্স। উন্মাদনার ঢেউয়ে তরুণদের মধ্যে এই আলোচনাই শুনেছি, মোদির জন্যই রাম মন্দির সম্ভব হল। সন্ধ্যায় মোদির অনুরোধমতো বাড়িতে বাড়িতে জ্বলতে দেখেছি প্রদীপ।
অযোধ্যার রাজদ্বার মন্দিরের বয়স পাঁচশো বছর। এতদিন এই মন্দিরই ছিল সবচেয়ে উঁচু। সেই রাজদ্বার মন্দিরের পুরোহিত বলছিলেন, শংকরাচার্যরা তো ঠিকই বলেছেন। অসমাপ্ত মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে। তারপর মন্দিরের উপরের ফাঁকা জায়গা ঢেকে দেওয়া। রাম মন্দিরের উদ্বোধনের আগে এবং পরে শংকরাচার্যদের কথা বিশেষ কেউ বলছেন না, সকলেই বলছেন রাম মন্দিরের কথা।
২০১৪ ও ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল হিন্দুত্ব। এবার বিজেপির হিন্দুত্বও রামময়। এবার বিজেপির ভোট পাওয়ার অস্ত্রও রাম মন্দির। মোদির বিজেপি জানে, প্রচারকে কীভাবে উচ্চগ্রামে নিয়ে যেতে হয়, কীভাবে আলোড়ন, উন্মাদনার জন্ম দিতে হয়, কীভাবে এই উন্মাদনাকে ভোটে রূপান্তরিত করতে হয়। এখানেই তারা কংগ্রেস সহ বিরোধীদের থেকে বহু যোজন এগিয়ে।
মোদি-যোগীরা যখন রাম মন্দিরের উদ্বোধন করছেন, তখন রাহুল গান্ধি তাঁর ন্যায় যাত্রায় অসমে। শংকরদেব মন্দিরে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তিনি সামনে বসে অবস্থান বিক্ষোভ করেছেন। মণিপুর থেকে যাত্রা শুরু করে নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, অসম হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছে সেই যাত্রা। উত্তর-পূর্বে যাত্রায় প্রচুর জনসমাগম হয়েছে। অসমে মহিলারা প্রচুর সংখ্যায় তাঁকে দেখতে এসেছেন। তাঁর কথা শুনেছেন। অসমেও রাজ্য সরকার এই যাত্রার প্রতি খুব সদয় ব্যবহার করেনি।
কিন্তু এই যাত্রাকালেই একাধিক বড় খবর পেয়েছেন রাহুল। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লোকসভায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা না করার ঘোষণা করেছেন। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান ঘোষণা করেছেন, আপ পঞ্জাবে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করবে না। তার থেকেও বড় খবর, বিহারে নীতীশ কুমার আবার বিরোধী জোট ভেঙে, আবার ডিগবাজি দিয়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নবমবারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। ফলে বিহারের মহাজোট আর নেই। শুধু একটা খবরই রাহুলের পক্ষে ভালো। সেটা হল, উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ কংগ্রেসকে ১১টি আসন ছাড়তে রাজি হয়েছেন। ফলে উত্তরপ্রদেশে ইন্ডিয়া জোট হচ্ছে।
অনেক হইচই করে বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোট ও রাহুলের ন্যায় যাত্রার ঘোষণা করা হয়েছিল। অযোধ্যায় আমন্ত্রণ সত্ত্বেও যাননি সোনিয়া, খাড়গে, অধীররা। তাঁরা বলেছেন, আরএসএস-বিজেপির অনুষ্ঠানে তাঁরা যাবেন না। ভোটের আগে তাঁদের ওই রাম মন্দিরে যেতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপাতত, তাঁরা রাম মন্দিরে যাচ্ছেন না। তাঁরা ব্যস্ত রাহুলের ন্যায় যাত্রা নিয়ে।
সন্দেহ নেই, এর আগে ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল খুবই ভালো জনসমর্থন পেয়েছিলেন। কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে তার সুফলও পেয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু সেটা ছিল বিধানসভা নির্বাচন এবং বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল, মানুষ তাদের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। সেখানে রাহুল কিছু বিধানসভা আসনে তাঁর ভারত জোড়ো যাত্রা করেছিলেন। তার সঙ্গে বর্তমানের ন্যায় যাত্রার তুলনা চলে না। এবার লোকসভা নির্বাচন। প্রতিপক্ষ মোদি। যে সব জায়গা দিয়ে রাহুল তাঁর যাত্রা নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে কংগ্রেস গতবার খুব বেশি আসন পায়নি। তার উপর এবার অযোধ্যার উন্মাদনা রয়েছে। ফলে রাহুলের কাজটা কঠিন, খুবই কঠিন।
তা সত্ত্বেও রাহুলের যাত্রায় ভিড় হচ্ছে। তাঁর বাবা রাজীব গান্ধির সময়ও একই জিনিস হত। রাজীবকে দেখতে দলে দলে মানুষ আসতেন। কিন্তু তার প্রতিফলন ভোটে পড়ত না। রাহুলকে দেখতেও মানুষ আসেন। তার প্রতিফলনও সবসময় ভোটের বাক্সে পড়ে না।
তবে রাহুলের এই সময় ন্যায় যাত্রা না করে কোনও উপায় ছিল না। কারণ, অযোধ্যা নিয়ে উন্মাদনার রাজনৈতিক মোকাবিলা করতেই হত। সেক্ষেত্রে এই যাত্রাই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। কিন্তু এই যাত্রা দিয়ে গোবলয়ে রাম মন্দিরের মোকাবিলা করা কঠিন, রীতিমতো কঠিন।
(লেখক সাংবাদিক)