রণজিৎ ঘোষ, শিলিগুড়ি : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন শিলিগুড়িতে রেলবাস দিয়েছিলেন। জংশন ও দার্জিলিং মোড় এলাকায় নিত্য যানজটের কথা মাথায় রেখে এবং পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতেই শিলিগুড়ি থেকে মাটিগাড়া হয়ে বাগডোগরা পর্যন্ত এই রেলবাসের ভাবনা এসেছিল মমতার। পর্যটকদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এই রেলবাস। পাশাপাশি মাটিগাড়া-বাগডোগরার বাসিন্দারাও এই পরিষেবা পাওয়ায় তাঁদের সুবিধা হয়েছিল। কিন্তু রেলের কিছু অদ্ভুত সিদ্ধান্তের জেরেই রেলবাসকে কয়েক বছর পর থেকেই বসিয়ে রাখা হয়। এবার সেই রেলবাস স্ক্র্যাপ করে বিক্রি করে দিল ভারতীয় রেল।
রেলকর্তারা মুখে কুলুপ আঁটলেও জংশন রেলস্টেশন সূত্রের খবর, কিছুদিন আগেই দুটি রেলবাসকে ভেঙে নিলাম করে দেওয়া হয়েছে। কাটিহারের ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) এসকে চৌধুরীর সঙ্গে এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১০ সালের বাজেটে শিলিগুড়িতে রেলবাস চালানোর ঘোষণা করেছিলেন। শিলিগুড়ি শহরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে যানজট সমস্যা দীর্ঘদিনের। যানজটের কারণে বিশেষ করে মাটিগাড়া থেকে দার্জিলিং মোড় হয়ে শিলিগুড়ি শহরে পৌঁছাতে প্রচুর সময় লাগে। এই পরিস্থিতিতে মানুষ যাতে সড়ক এড়িয়ে রেলপথে বাগডোগরা পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারেন, পর্যটকরাও যাতে রেলবাসের আনন্দ নিতে পারেন সেজন্যই দুটি রেলবাস চালানোর ঘোষণা হয়েছিল। ২০১১ সালে মমতা রেলমন্ত্রীর পদ ছেড়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী। তিনি মমতার সমস্ত প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। ২০১১ সালের ২০ জুলাই কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে রেলমন্ত্রক আয়োজিত এক অনুষ্ঠান থেকে রেলবাসের উদ্বোধন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। উত্তর-পূর্ব ভারতে একমাত্র শিলিগুড়িতেই রেলবাস পরিষেবা চালু হয়েছিল। দুটি রেলবাসকে দিনে দু’বার করে শিলিগুড়ি জংশন স্টেশন থেকে বাগডোগরা পর্যন্ত মিটারগেজ লাইনে চালানো হত। প্রতিটি ট্রেনের একটিমাত্র কামরা ছিল, যেখানে ৪০ জনের বসার ব্যবস্থা ছিল। শিলিগুড়ি জংশন থেকে বাগডোগরা পর্যন্ত মাথাপিছু ভাড়া ধার্য হয়েছিল ৩৫ টাকা। মাঝে শুধুমাত্র মাটিগাড়ায় একটি স্টপেজ ছিল।
প্রথম দিকে কিছুদিন দেশ-বিদেশের পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষও শখের বসে এক-দু’দিন এই ট্রেনে চড়েছেন। কিন্তু ভাড়া এতটাই বেশি যে ধীরে ধীরে স্থানীয়রা রেলবাসের বদলে সিটি অটো, লোকাল বাসে চাপতে শুরু করেন। কেননা সেই সময় শিলিগুড়ি থেকে বাগডোগরা পর্যন্ত বাসে ভাড়া ছিল পাঁচ-সাত টাকা। ভাড়া কমানো, সিটি সেন্টার, শিবমন্দির, গোঁসাইপুরে স্টপেজের দাবিতে বেশ কয়েকবার রেলকর্তাদের কাছে দাবি পেশ করা হযেছিল। এমনকি বাস, সিটি অটোর ভাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্টপেজ অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণের দাবিও ছিল। কিন্তু রেল সে সবে গুরুত্ব না দেওয়ায় ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই রেলবাস বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন দুটি রেলবাসই জংশন স্টেশনের ডিজেল শেডে রাখা ছিল। সম্প্রতি সেই দুটি রেলবাসই ভেঙে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
হিমালয়ান হসপিটালিটি অ্যান্ড টুরিজম ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক সম্রাট সান্যালের বক্তব্য, রেলবাস দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। আমরা পর্যটকদের জন্য রেলবাস একাধিকবার পুরোটা ভাড়া নিয়েছি। এই রেলবাস নকশালবাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু এটা কেন বন্ধ করে দেওয়া হল জানি না।’ তিনি মনে করেন, ‘রেলবাস শুধু পর্যটকদের জন্যই নয়, সড়কপথে যানজট এড়াতে মাটিগাড়া, শিবমন্দির, বাগডোগরার মানুষের শিলিগুড়ি যাতায়াতের জন্যও খুব স্বস্তিদায়ক হত। একটু পরিকল্পনা করে রেল এটাকে চালাতেই পারত।’
শিলিগুড়ি শহরের পরিধি বাড়তে বাড়তে এখন বাগডোগরা পর্যন্ত বিস্তৃত। একাধিক উপনগরী থেকে শুরু করে সরকারি অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, বিমানবন্দরের মতো প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা শহরের বাইরে এই অঞ্চলে হওয়ায় মাটিগাড়া-বাগডোগরার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ শহর থেকে মাটিগাড়া-বাগডোগরায় যাতায়াত করেন। এই দুই এলাকার লক্ষাধিক মানুষও নানা প্রয়োজনে শহরে যাতায়াত করেন প্রতিদিন। শহর থেকে এই এলাকায় নিত্যযাতায়াতকারী সকলেই মনে করেন, রেলবাস তাঁদের যাতায়াতে অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারত। রেলের কয়েকজন আধিকারিকের অনিচ্ছা আর অদূরদর্শিতার কারণে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এই রেলবাসকে চালানো হল না।