- সৈয়দ তনভীর নাসরিন
বর্ধমান শহরের যে অঞ্চলে আমাদের বাড়ি, সেখানে বাড়ির পিছনে একটি বড় পুকুর রয়েছে। আমি মালদ্বীপে থাকার সময়, মাঝে মাঝেই আমার স্কুল শিক্ষিকা মা ফোনে অভিযোগ করতেন, সেই পুকুর ভরাট হয়ে বিভিন্ন ধরনের জিনিস উঠছে। বাড়ি, ক্লাবঘর ইত্যাদি। মাকে একদিন মজা করে বলেছিলাম, এই মালদ্বীপে তো সমুদ্র ভরাট করার প্রক্রিয়া রোজ দেখতে পাই। আর সেই ‘রিক্লেইমড ল্যান্ড’-এ বাড়ি তৈরির ধুম দেখি।
এই যে সমুদ্রের থেকে জমি ‘জোগাড়’ করে এনে বাড়ি তৈরির অবিরাম প্রচেষ্টা, মালদ্বীপের এই ‘রিয়েল এস্টেট বুম’-এর অন্যতম ধারক এবং বাহক নতুন প্রেসিডেন্ট মইজু। ইয়ামিন সরকারের আমলে আবাসন মন্ত্রী হিসেবে হুলুমালে এবং তার আশপাশের এলাকায় যে বিশাল বিশাল আবাসন তৈরি হয়েছিল, তার পিছনে মূল কৃতিত্ব দেওয়া হয় মইজুকে। আবাসন মন্ত্রী হিসেবে তাঁর ট্র্যাক রেকর্ডই বিরোধী দল হিসেবে পিপিএমকে বা ইয়ামিনের দলকে রাজধানী মালের মেয়র পদে জিতিয়েছিল। মনে করা হয়, মালদ্বীপের মানুষের আবাসন সমস্যা মেটাতে মইজুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাঁকে নির্বাচনে জিততে সাহায্য করেছিল।
সমাজতত্ত্বের ছাত্রী হিসেবে খেয়াল করে দেখেছি ওই ঘটনাই মালদ্বীপের রাজনীতিতে মইজুকে প্রথম নিজস্ব ‘ব্র্যান্ড’ তৈরিতে সাহায্য করে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে খেয়াল রাখতে হবে, মেয়র হিসেবে কাউকে বাছতে মালদ্বীপের রাজধানীতে ওটাই ছিল প্রথম সরাসরি ভোট। অর্থাৎ কাউন্সিলারদের ভোটে নয়, মানুষ সরাসরি বেছে নিল কে মেয়র হবেন। ২০২১-এ মালের মেয়র হওয়ার পর থেকে একদিকে যেমন মইজু মালদ্বীপের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের দলের হয়ে ভারত-বিরোধিতায় শান দিয়েছেন, তেমনই দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ইয়ামিন জেলে চলে যাওয়ার পর বিরোধীদের কারাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্তের পেছনে ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্র’ রয়েছে বলে লাগাতার সরব থেকেছেন।
ইয়ামিনের শুরু করা এবং পরবর্তীকালে মইজুর টেনে নিয়ে যাওয়া ‘ইন্ডিয়া আউট’ রাজনৈতিক প্রচারের মূল অভিমুখ ছিল দুটি। প্রথমত, ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এমডিপি’র সরকার বা প্রেসিডেন্ট সোলিহ-র প্রশাসন যা যা ‘খারাপ কাজ করছে’ তার জন্য নিকটতম প্রতিবেশী ভারতকে নিশানা করা। আর সোলিহ সরকার দ্বীপরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নয়াদিল্লির কাছে বিকিয়ে দিয়েছে সেই স্লোগান তুলে এক ধরনের মালদ্বীপীয় জাতীয়তাবাদকে পুষ্ট করা।
ভারত মহাসাগরের উপরে প্রায় ১৩০০ দ্বীপের এই রাষ্ট্রের ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বকে বুঝতে পেরে অনেক দিন ধরেই বড় রাষ্ট্রগুলি তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছিল। মামুন আবদুল গায়ুমের একনায়কতন্ত্রের অবসানের পরে যখন এমডিপি তৈরি করে মহম্মদ নাশিদ মালদ্বীপে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, তারপরে একপ্রকার অভ্যুত্থান ঘটিয়েই ইয়ামিন গদিতে বসেন এবং সেই সময়ই ভারতীয় সংস্থা জিএমআরকে কেন মালদ্বীপের প্রধান বিমানবন্দর তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে বিক্ষোভ শুরু হয়। ইয়ামিন সরকার ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দেয়। মামুন আবদুল গায়ুম, যাঁকে একসময় সৈন্য পাঠিয়ে রাজীব গান্ধি দস্যুদের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছিলেন, সেই ২৭ বছর শাসন করা রাজনীতিকের বৈমাত্রেয় ভাই হলেও ইয়ামিন ক্ষমতায় এসেই বেজিংয়ের সঙ্গে সখ্য বাড়াতে শুরু করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অতর্কিত আক্রমণ বা আগ্রাসন ঠেকাতে যে দ্বীপপুঞ্জকে ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশরা, আধুনিক পৃথিবীতে সেই দ্বীপরাষ্ট্র কী কৌশলগত সুবিধা দিতে পারে সেটা আন্দাজ করেই শি জিনপিংয়ের সরকারও ইয়ামিনকে দু’হাতে সাহায্য শুরু করে। বেজিংয়ের সাহায্য নিয়ে মালদ্বীপের পরিকাঠামো নির্মাণ কিংবা আবাসন শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধানতম ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন মইজু। সেই সময় থেকেই চিন দ্বীপরাষ্ট্রের রাজনীতিকদের মধ্যে ‘সম্ভাব্য বন্ধু’ হিসেবে মইজুকে শনাক্ত করে। তাঁর উপর ভরসা রাখতে শুরু করে। সেই কারণেই বহু আলোচিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে এক অনলাইন মতবিনিময় সভায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে এই ইংল্যান্ডে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আসা, লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি খোলাখুলিই বলেছিলেন, তিনি কুর্সিতে বসলে মালদ্বীপের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক আবারও মজবুত হবে। ‘ওবওর’ বা ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’, বেজিংয়ের পছন্দের পরিকাঠামো প্রকল্প আবার গতি পাবে।
প্রাক্তন ভারতীয় বিদেশসচিব শ্যামশরণ সম্প্রতি লিখেছেন, কীভাবে মালদ্বীপকে আবার কাছে টানা যায়। সমাজমাধ্যমের ট্রোল যাবতীয় বয়কটের ডাক ইত্যাদি কিছুকে অতিক্রম করে আমিও মনে করি, বয়কট নয়, বরং এই দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার দিকেই আমাদের লক্ষ রাখা উচিত। না হলে এই দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের যে দীর্ঘ সামাজিক, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রয়েছে, তার ক্ষতি হবে। কূটনৈতিক এবং কৌশলগত দিক থেকেও আমরা পিছিয়ে পড়ব। বয়কটের ডাক দেওয়া অক্ষয়কুমার এবং অন্যরা জানেন না, মালদ্বীপের যে ১৮০টি বড় রিসর্ট রয়েছে, তার মধ্যে অন্তত এক তৃতীয়াংশের মালিক বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থা। তাজ গ্রুপ সহ সেখানকার কোনও সংস্থাই কিন্তু মালদ্বীপ থেকে হোটেল ব্যবসা গুটিয়ে চলে আসার কথা ঘোষণা করেনি। আমাদের আরও অনেক প্রতিবেশী দেশের মতো মালদ্বীপেও নিশ্চিতভাবেই ভারত-বিরোধী শক্তি রয়েছে। কিন্তু আমরা যদি তাদের ফাঁদে পা দিই তাহলে বেজিংয়ের পোয়াবারো আর কূটনৈতিক দিক থেকে আমাদের ক্ষতি।
মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট মইজুকে বুঝতে গেলে বা কেন তিনি ‘চিনপন্থী’ বলে পরিচিত সেটা উপলব্ধি করতে গেলে তাঁর অতীত ইতিহাস বা ইয়ামিনের আমলে কীভাবে তাঁর সঙ্গে বেজিংয়ের সখ্য তৈরি হয়েছিল সেটা মনে রাখতে হবে। সম্প্রতি যখন মালদ্বীপ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয় তখন তিনি চিন সফরে গিয়েছিলেন এটা একটি তথ্য মাত্র। জেনে রাখা ভালো, মইজুর চিন সফরের ঠিক আগে মার্কিন বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মালদ্বীপের বিদেশমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। দ্বীপরাষ্ট্রের গুরুত্ব বুঝতে পেরে ওয়াশিংটন শুধু যে আর শ্রীলঙ্কা থেকে দূতাবাস পরিচালনা করছে না তাই নয়, এই দ্বীপরাষ্ট্রে একাধিক দপ্তর খুলেছে। আমেরিকা এই গুরুত্ব দেওয়া সত্ত্বেও মইজু কিন্তু চিনের সঙ্গে বন্ধুত্বেই শান দিয়েছেন এবং তাইওয়ান বলে কোনও রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন। মইজু যে পথে মালদ্বীপকে নিয়ে যেতে চান, সেখানে ভারতের সঙ্গে যে দ্বীপরাষ্ট্রের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তাতে কাটছাঁট করতে তিনি আগ্রহী। সাংস্কৃতিক সম্পর্ক হয়তো রাজনীতি বা প্রশাসন দিয়ে কেটে ফেলা যায় না, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে প্রভাব তো কমানোই যায়। তাই ‘বয়কট মালদ্বীপ’ পালটা হিসেবে তিনি দ্বীপবাসীদের স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য ভারতের পরিবর্তে থাইল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে পাঠাতে চান। মালদ্বীপ সরকারের স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প ‘আসান্ধা’ অনুযায়ী সেদেশের সব নাগরিক প্রয়োজন হলে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন এবং সেদেশের সরকারই তার খরচ দেয়। তাহলে ‘বয়কট বাংলাদেশ’-এর মতো ডাক দিয়ে মালদ্বীপের মতো গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপরাষ্ট্রকে একেবারে চিনের ‘উপগ্রহ’ হয়ে যেতে দেওয়ার কি কোনও কারণ আছে?
একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে আমাদের বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশে আমার কাজ করা বা মালদ্বীপে চার বছর কাটিয়ে কী শিখেছি তা বলার চেষ্টা করতে পারি। রাজধানী মালেতে আমি বা আরও অনেক ভারতীয় যে বাড়িটিতে থাকতাম, তার নাম জেনিন রেসিডেন্সি। এককালে ভারতে পড়তে আসা প্যালেস্তিনীয় ছাত্র তাঁর মালদ্বীপীয় বান্ধবীকে বিয়ে করে মালেতে এই বিশাল ফ্ল্যাটবাড়িটি বানিয়েছিলেন। বোঝাই যায় তাঁর ফেলে আসা দেশের এক শহরের নামে বাড়ির নাম রেখে তিনি আসলে প্যালেস্তাইনের স্মৃতিকে উসকে দিতে চেয়েছেন। কেন সেটা আমি চার বছরে মালদ্বীপে থেকে প্রতিনিয়ত বুঝেছি। দ্বীপরাষ্ট্রে প্যালেস্তাইন একটা আবেগের লুকোনো আগ্নেয়গিরি। নিয়ম করে সেখানে প্যালেস্তাইন দিবস পালিত হয়, বাড়িতে বাড়িতে পতাকা ওড়ে, ‘ফ্রি প্যালেস্তাইন’ লেখা টি-শার্ট বিলি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে প্যালেস্তাইন বন্ধু হিসেবে ভারত এবং মালদ্বীপ একই বিন্দুতে অবস্থান করত। আর জেনিন রেসিডেন্সি ছিল সেই সৌভ্রাতৃত্বের মাইলফলক। আজকের বিশ্ব রাজনীতিতে চিন ‘প্যালেস্তাইন বন্ধু’ সেজে মালদ্বীপবাসীর মন জয় করতে চাইছে। আমরা ভারতীয়রা পিছিয়ে গেলে হবে কী করে?
(লেখক মালদ্বীপে ভারতীয় হাই কমিশনের ভারতীয় কালচারাল সেন্টারের প্রাক্তন ডিরেক্টর)