অমিতকুমার রায়, মানিকগঞ্জ : স্মৃতিপটে সেই নকশাল আন্দোলন। নিজেদের অধিকার ফিরে পেতে নকশালবাড়ির আদিবাসীরা সশস্ত্র আন্দোলনে নেমেছিলেন। জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের দক্ষিণ বেরুবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতেও যেন একই ঘটনা ফিরে এসেছে। গত এক সপ্তাহে আদিবাসীরা এই এলাকায় প্রায় ১৫০ বিঘা চা বাগান সহ জমির দখল নিয়েছেন। দলবদ্ধভাবে বাগানে গিয়ে খুঁটি পুঁতে লাল কাপড় লাগানো হচ্ছে। বাগান থেকে কর্মরত কর্মীদের তাড়ানোর পাশাপাশি কেউ যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য সেখানে পাহারার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এভাবে জমি দখল করলেও তাকে ‘দখল’ তকমা দিতে আদিবাসীরা নারাজ। বিষয়টিকে তাঁরা ‘নিজেদের অধিকার ফিরে পাওয়ার চেষ্টা’ বলেই জানিয়েছেন।
তাঁদের দাবি, স্বার্থান্বেষী একদল মানুষ সহজ সরল আদিবাসীদের সামান্য টাকার লোভ দেখিয়ে তাঁদের জমির দখল নিয়েছিল। সেই জমিতে চা বাগান বানিয়ে বছরের পর বছর ধরে মুনাফা লোটা হয়েছে। সেই স্বার্থান্বেষীদের অনেকে আদিবাসীদের অজান্তে অবৈধভাবে ওই জমির দীর্ঘমেয়াদি লিজের কাগজ তৈরি করে নিয়েছে। সব জেনেও প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে তাঁদের অভিযোগ। এনিয়ে এলাকায় আদিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ বাড়ছে। প্রশাসন পরিস্থিতির বিষয়ে অবগত। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে দক্ষিণ বেরুবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সুমিত্রা দেব অধিকারী ক্ষুব্ধ আদিবাসীদের নিয়ে রবিবার সাতকুড়ায় এক বৈঠকে বসেন। তবে তাতে কোনও সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসেনি। গোটা বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য রয়েছে।
প্রধান বলেন, ‘বেশ কিছুদিন হল দক্ষিণ বেরুবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের কিছু এলাকায় চা বাগান নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওপরমহলের নির্দেশে আমি এদিন আদিবাসীদের নিয়ে আলোচনায় বসি। আদিবাসীরা তাঁদের বিভিন্ন দাবির কথা জানিয়েছেন। যাতে খুব তাড়াতাড়িই সমস্যা মেটে আমি তাই ওই দাবিগুলির বিষয়ে ওপরমহলকে জানাব।’ প্রধানের রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত তাঁরা কিছু করতে না পারলেও গোটা বিষয়টিই প্রশাসনের নজরে রয়েছে বলে জলপাইগুড়ি সদরের বিডিও মিহির কর্মকার জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘গোটা বিষয়টি জেলা শাসকের নজরে রয়েছে।’ যাঁদের দিকে অভিযোগের আঙুল, সেই চা বাগান মালিকদের একজনের কথায়, ‘আদিবাসীদের অভিযোগ ঠিক নয়। উপযুক্ত দাম দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে আইন মোতাবেক জমি লিজ নিয়ে তাতে চা বাগান করা হয়েছে। প্রয়োজনে চিকিত্সার জন্য এই বাসিন্দাদের খরচও দেওয়া হয়। তাও তাঁরা যা করছেন তা মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়।’
দক্ষিণ বেরুবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে বর্তমানে প্রায় ১৩০০ আদিবাসী পরিবারের বসবাস। অভিযোগ, এঁদের মধ্যে ১০০ পরিবারের প্রায় ৪০০ বিঘা জমি দখল করে চা বাগান তৈরি করা হয়েছে। এই আদিবাসীরা এতদিন স্বল্প পরিশ্রমে কর্মী হিসেবে এই বাগানগুলিতে কাজ করতেন। কম রোজগারের কারণে তাঁদের খুবই সমস্যায় জীবন কাটে। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে বিভিন্ন বাগানে বর্তমানে যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। এর জেরে এই আদিবাসীদের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা নিজেদের জমি ফিরে পেতে মাঠে নেমেছেন। দলবদ্ধভাবে একের পর এক জমি দখল করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে চিলডাঙ্গা, দইখাতা, সাঁওতালপাড়া সহ বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ১৫০ বিঘা চা বাগানের জমি উদ্ধার করা হয়েছে। কাজলদিঘি, নাউতারি, বড় শশীর মতো অ্যাডভার্স পজিশন ও জিরো খতিয়ানভুক্ত জমিতে থাকা চা বাগানও দখল করা হয়েছে। বাগানে গিয়ে খুঁটি পুঁতে লাল কাপড় লাগানো হচ্ছে। বাগান থেকে কর্মীদের তাড়ানো হচ্ছে। বাগানে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দখল করা চা বাগানের জমি থেকে চা পাতা তোলা, চা গাছ পরিচর্যার মতো কাজ অবশ্য আদিবাসীরা শুরু করেননি। কেউ তাঁদের কাজে বাধা দিলে আদিবাসীরা তিরধনুক নিয়ে রুখে দাঁড়াবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এই আন্দোলনে এখনও পর্যন্ত কোনও রক্ত না ঝরলেও পরিস্থিতি অদূরভবিষ্যতে আশঙ্কাজনক হয়ে উঠতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
বাবলু মান্ডি, শুক্রা রাম ভগত, রবিন মালপাহাড়ি, নিমাই মালপাহাড়িরা জানান, কয়েক দশক আগে এই সমস্ত এলাকা বনজঙ্গলে পূর্ণ ছিল। আদিবাসীরা তা পরিষ্কার করে জমি তৈরি করেন। বাবুল বলেন, ‘একশ্রেণির মানুষ কৌশলে এই জমিতে চা বাগান বানিয়েছে। নিজেদের জমিতেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে আদিবাসীদের একরকম বাধ্য করেছে। এটা কোনওমতেই মানা যায় না। তাই নকশাল ধাঁচে আন্দোলন করা হচ্ছে।’ শুক্রার বক্তব্য, ‘আদিবাসীদের পাট্টা বা লিজ দিয়ে জমির অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে। এই বিষয়ে ইতিমধ্যে জলপাইগুড়ির অতিরিক্ত জেলা শাসককে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে, আইন অনুযায়ী আদিবাসীদের জমি হস্তান্তর কিংবা লিজে দেওয়ার নিয়ম নেই। তাহলে এক্ষেত্রে কীভাবে আদিবাসীদের জমি দীর্ঘমেয়াদি লিজ নিয়ে চা বাগান বানিয়ে একশ্রেণির মানুষকে মুনাফা লোটার সুযোগ করে দেওয়া হল সে বিষয়ে প্রশ্ন জোরালো হয়েছে। এনিয়ে প্রশাসনের কেউ মুখ খুলতে রাজি নন। আদিবাসীদের সমস্যা ও দাবির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তাঁদের নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে বলে জলপাইগুড়ি সদর পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য দীননাথ রায় জানিয়েছেন।