Saturday, April 27, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়সিএএ নয়, অসমে চর্চায় ডিলিমিটেশন  

সিএএ নয়, অসমে চর্চায় ডিলিমিটেশন  

অসমে ডিটেনশন ক্যাম্পগুলো এখন প্রায় জনশূন্য। ব্যতিক্রম গোয়ালপাড়ার সবচেয়ে বড় ক্যাম্প। বরাক বাদে সিএএ নিয়ে বেশি চর্চাও কোথাও সেভাবে নেই।

  • দেবজ্যোতি চক্রবর্তী

বাংলা ছেড়ে সাংবাদিকতার সূত্রে এক বছরেরও কাছাকাছি থাকা হয়ে গেল অসমে। বাংলার সঙ্গে অসমের সামগ্রিক ফারাকটা এখন কোথায়, প্রশ্ন করেন অনেকে। এখানে প্রতিবার উত্তর একটাই থাকে আমার।

গুয়াহাটির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলে রাজনীতির স্লোগান বা প্রচার বেশি দেখা যায় না। মানুষের মধ্যেও রাজনীতি নিয়ে অত কথা নেই। সবাই বুঝে গিয়েছে, রাজনীতি নিয়ে কথা বলে লাভ হবে না। নিজের উন্নয়ন দরকার। রাজ্যের উন্নয়ন দরকার। সবাই মিলেমিশে থাকতে চান। রাজনীতি নিয়ে হইচই ব্যাপারটা আদৌ নেই। অন্তত গুয়াহাটির ছবিটা এরকমই। এই এক বছরে একবারই শহরজুড়ে রাজনীতির পোস্টার, ব্যানারে ছয়লাপ দেখেছি। সেবার অসমে নরেন্দ্র মোদি এসেছিলেন।

কলকাতা থেকে বন্ধুরা অনেকে এখন জানতে চাইছেন একটা কথা। খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন। এই যে সিএএ নিয়ে দেশজুড়ে এত আলোচনা, অসমে তাঁর প্রভাব কতটা পড়েছে? সত্যি বলতে কী, অবাকই হচ্ছেন আমার উত্তর শুনে। কিন্তু সেটাই বাস্তব। গুয়াহাটিতে কিন্তু সিএএ নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। বিতর্ক নেই। চর্চা নেই।

কথাটা শুনে অনেকে বলবেন, সে কী! অসমে এনআরসি নিয়ে প্রথম ডিটেনশন ক্যাম্প হয়েছিল। সেই ক্যাম্প নিয়ে কত লেখালেখি। এখনও সেই ক্যাম্প অনেক রয়ে গিয়েছে। তা হলে তার রেশ কি আর নেই?

সংক্ষেপে বললে, সত্যিই নেই। এনআরসির পর অনেক ডিটেনশন ক্যাম্প হয়েছিল। অধিকাংশ এখন জনশূন্য শুনি। সবচেয়ে বড় ক্যাম্প গোয়ালপাড়ায়। সেখানেও লোক কম। এনআরসি আতঙ্ক  বলতে যা ছিল, তা অনেকটাই কেটে গিয়েছে। কিছু হবে না, বুঝতে পেরে। বরাক উপত্যকায় বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে কিছুটা এখনও রয়েছে সেই আতঙ্ক। বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমরা কাগজপত্র জোগাড় করে অসমিয়া হয়ে গিয়েছেন সরকারিভাবে। অনেক হিন্দু তা পারেননি।

সিএএ বা এনআরসির তুলনায় বরং চিন্তা বাড়াচ্ছে ডিলিমিটেশন। অনেক মুসলিম অধ্যুষিত কেন্দ্র এমনভাবে লোকসভার মধ্যে ফেলা হচ্ছে, যাতে সেখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। এটা নিয়ে বেশি আলোচনা চলছে অসমে। এর পিছনে রহস্যটা কী, সবাই বুঝতে পারছেন।

অসমে মোট ১৪টি লোকসভা আসনের মধ্যে বরাক উপত্যকায় রয়েছে ২টি আসন। ভাটি অসমে রয়েছে ৫টি আসন। উজান অসমে ৬টি এবং স্বশাসিত অঞ্চল কার্বিআংলং একটি আসন। অসমে মোট ১২৬টি বিধানসভা আসন। ১৪টি লোকসভা আসন। এই রাজ্যে এবার লোকসভা নির্বাচনে ভোটদাতাদের বৃদ্ধিটাও চোখে পড়ার মতো। নির্বাচন কমিশনের হিসাব বলছে এই রাজ্যে ২০১৯-এর তুলনায় এবার ভোটদাতার বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশ বেশি।

এবার প্রশ্ন হচ্ছে যে অসমের বুকে সিএএ এবং এনআরসি কত বড় ইস্যু। যাঁরা এনআরসির সময়ে আন্দোলনে শামিল হয়েছেন, এমন বহু মানুষের মতে সিএএ কার্যকর নিয়ে তেমন কোনও আন্দোলন দানা বাঁধা কঠিন। কারণ, সিএএ-তে কিছু ধোঁয়াশা থাকলেও, তাতে কোথাও এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নয় যে এটা নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার আইন।

এনআরসি-যে সরকারিভাবে কার্যকর হয়েছে তার সরকারি কোনও নোটিফিকেশনই আজও পর্যন্ত আসেনি। ফলে, এনআরসি প্রক্রিয়া হিসাবে যা এখনও পর্যন্ত অসমের বুকে দেখা গিয়েছে তা আইনি দলিল নয়।  যার ফলে, অসমে এনআরসি-তে যাদের নাম ওঠেনি, তাদের সবাই প্রায় সব সরকারি নাগরিক সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন। শুধু ২৭ লক্ষ নাগরিকের আধার কার্ড আটকে রাখা হয়েছে। যার ফলে সরকারি র‌্যাশন পাচ্ছেন না।

অসমে সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূল কারণ ভাষা বিপন্নতার সংকট। সিএএ বিধিতে আবেদনের সুযোগ পাবেন এনআরসি-ছুট ১৪ লক্ষ হিন্দু বাঙালি। এই ১৪ লক্ষ নাগরিকত্ব পেয়ে অসমে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে অসমিয়া ভাষা বিপন্ন হতে পারে, এটাই অসমিয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলির আশঙ্কা এবং এখান থেকেই সিএএ বিরোধী প্রতিবাদ-আন্দোলন।  একই কথা খাটে উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে। যদিও মেঘালয়, মণিপুর, অরুণাচল, মিজোরামে সিএএ কার্যকর হচ্ছে না। অসমেরও কয়েকটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল সিএএ-র আওতায় নেই।

অসম চুক্তির আধার ছিল ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে যারা বিদেশ থেকে অসমে এসেছে তারাই নাগরিকত্ব পাবে। এনআরসি-র কাট-অফ ডেট ছিল আইন অনুযায়ী সেটাই। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ রাত বারোটা। এরপর যারা এসেছে, তারাই আবেদন করবে সিএএ-র অধীনে এবং তার বিরোধিতা করছে অসমের দল-সংগঠন।

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের একটি পরিসংখ্যান বলছে বিদেশি সন্দেহে অসমে ২,৪৪,১৪৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ১,৪৯,৭৩২টি মামলা খািরজ হয়ে গিয়েছে। ফরেন ট্রাইবিউনালে ঝুলছে ৯৪,৪১২টি মামলা। আর অসমে মাত্র ২ জনকে তাদের স্বদেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে।

তবে, নিশ্চিতভাবে অসমে ডি-ভোটার একটা বড় ইস্যু। কিন্তু এর সংখ্যাটা এমন কিছু নয় যে তা ব্যাপকভাবে লোকসভা নির্বাচনের অন্যতম বড় ইস্যু হয়ে উঠতে পারে। আর এই মুহূর্তে এনআরসি ও সিএএ-কে ঘিরে কোনও জুজু আতঙ্কও অসমের জনমানসে চেপে বসেনি, যাতে ডি-ভোটার হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই মুহূর্তে অসমের ডি-ভোটার নিয়ে যে সংখ্যাটা পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে এই সংখ্যাটা ৯৬,৯৮৭।

ডিলিমিটেশনের কথা বলছিলাম। ১৯টি বিধানসভা আসনে এবং একটি লোকসভা আসনে এই ডিলিমিটেশন বা আসন পুনর্বিন্যাস হয়েছে। মনে করা হচ্ছে এই আসন পুনর্বিন্যাসের আসল ফায়দা তুলে নিতে পারে বিজেপি। কারণ এই আসন পুনর্বিন্যাসে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায়। এই আসন পুনর্বিন্যাসে বেশ কিছু মুসলিম অধ্যুষিত জেলা এমন কিছু জেলার সঙ্গে মিশে গিয়েছে যেখানে অন্যান্য জনজাতিরা সংখ্যাগুরু।

এই মুহূর্তে অসম বিধানসভায় ৩১ জন মুসলিম বিধায়ক রয়েছেন। এদের কেউই শাসকদল বিজেপি বা তাদের জোটসঙ্গীদের দলকে প্রতিনিধিত্ব করেন না। অসমের সংখ্যালঘু ভোটব্যাংকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের প্রধান নেতা বদরুদ্দিন আজমলও নাকি শঙ্কিত যে আসন পুনর্বিন্যাসের ফলে মুসলিম জনপ্রতিনিধির সংখ্যা না কমে যায়। এই আসনগুলিতে মুসলিম আধিপত্য কমে এবার তপশিলিদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে গিয়েছে তাতে বিজেপি এই সমস্ত আসনগুলো জিতে নিতে পারে।

আসন পুনর্বিন্যাসে ধাক্কা খেতে পারে কংগ্রেস, এমনটাও মনে করছে অসমের রাজনৈতিক মহল। এখনও পর্যন্ত অসমে কংগ্রেস তাদের ১২ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। বাকি দুটি আসন জোটসঙ্গীদের ছেড়ে দিয়েছে গৌরব গগৈদের দল। আসন পুনর্বিন্যাস কংগ্রেসের অন্দরে এতটাই আতঙ্ক ফেলেছে যে কালিয়াবোরের বিদায়ি সাংসদ গৌরব গগৈ এবার জোরহাট লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছেন। যদিও, গৌরব গগৈ চেয়েছিলেন নগাঁও থেকে প্রার্থী হতে। অনেক কংগ্রেস নেতা কেন্দ্র বদল করতে চাইছেন।

এমনিতে মুসলিম জনসংখ্যায় অসমের স্থান জম্মু-কাশ্মীরের পরেই। সা়ড়ে তিন কোটির জনসংখ্যার রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যার হার ৩৪ শতাংশ। আসন পুনর্বিন্যাসের ফলে ধুবড়ি, করিমগঞ্জ এবং নগাঁও লোকসভা কেন্দ্র হিসাবে নথিভুক্ত হয়েছে। আর এই তিন আসনেই মুসলিম ভোটদাতারাই ডিসাইডিং ফ্যাক্টর। এখানে সিএএ অবশ্যই কিছুটা চর্চার ব্যাপার।

কংগ্রেস ও অন্যান্য বিজেপি বিরোধীদের আশঙ্কা সিএএ কার্যকরের নোটিফিকেশনে এই মুসলিম আধিপত্য থাকা আসনগুলিতে ভালোই প্রভাব ফেলবে শুধু নয়, এর পুরো ফায়দাই তুলবে বিজেপি। কারণ, সিএএ কার্যকরকে স্বাগত জানিয়েছেন এই সব অঞ্চলের মানুষ।

সব মিলিয়ে অসমের বুকে এবারের লোকসভা ভোটে সিএএ ও এনআরসি-র প্রভাব নিয়ে কেউই পরিষ্কারভাবে কোনও ধারণা তৈরি করতে পারছে না। বরং এই রাজ্যে এবারের ভোটে ডিলিমিটেশনই আসল ম্যাজিক দেখাবে বলেই মনে করছে সমস্ত রাজনৈতিক দল। তাই আপাতত নিস্তরঙ্গ অসমের রাজনীতির চর্চার টেবিলে তর্জার মাত্রায় আকর্ষণ যুক্ত করেছে ওই একটা শব্দ-ডিলিমিটেশন।

(লেখক সাংবাদিক। গুয়াহাটির বাসিন্দা)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

CM Mamata Banerjee | দুর্গাপুরে হেলিকপ্টারে চড়তে গিয়ে বিপত্তি, ভেতরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: দুর্গাপুরে (Durgapur) হেলিকপ্টারে চড়তে গিয়ে বিপত্তি। কপ্টারের ভিতরেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (CM Mamata Banerjee)। তবে তিনি...

Fire | জেনারেটরে শর্ট সার্কিট! বড়সড়ো অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে রক্ষা পেল বাগডোগরার একটি বিল্ডিং...

0
বাগডোগরাঃ শনিবার দুপুরে বড়সড়ো অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে রক্ষা পেল বাগডোগরার একটি বহুতল বিল্ডিং। এদিন বেলা প্রায় সাড়ে ১২টা নাগাদ আগুন লাগে স্টেশন মোড় এলাকার...

SSC Verdict | চাকরিহারাদের বিক্ষোভে উত্তাল সল্টলেক, ধস্তাধস্তি পুলিশের সঙ্গে

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: চাকরিহারাদের বিক্ষোভে ধুন্ধুমার সল্টলেকের এসএসসি ভবন। শনিবার বাম যুব সংগঠনের নেতৃত্বে এসএসসি ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছিলেন চাকরিহারাদের একাংশ।তখনই তাঁদের...

Dinhata | ‘দিনহাটায় কিছু ডাক্তার আবার ডাকাতি শুরু করেছে’, মন্ত্রী উদয়নের পোস্ট ঘিরে শোরগোল

0
দিনহাটা: দিনহাটা মহকুমা হাসপাতালে সক্রিয় দালালচক্র! জেলা হাসপাতালে রোগী রেফার হলেই দালালের মাধ্যমে নার্সিংহোমে পৌঁছে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। সেখানে অপারেশন করছেন খোদ মহকুমা হাসপাতালের...

SSC Scam | ‘চাকরি বাতিলের তালিকায় কারা যোগ্য, তা বলা সম্ভব নয়’, কবুল করলেন...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছে ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুরো প্যানেল। ফলে চাকরি হারিয়েছেন ২৫ হাজার ৭৫৩ জন শিক্ষক-অশিক্ষক...

Most Popular