- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
এত বেয়াদপ গরম সেদিন, সবারই নাকি প্রাণ যায় যায়! সোশ্যাল মিডিয়াতেই মানুষের চুইয়ে ঘাম পড়ার দশা। কলকাতা নাকি হয়ে উঠেছে জয়সলমের। অথবা রাজস্থানেরই শ্রী গঙ্গানগর বা চুরু বা ফালোদি, ভারতে যে তিন শহরে সবচেয়ে গরম পড়ে।
অথচ কী কাণ্ড, কী কাণ্ড! ভরদুপুরে সেদিন ইডেনে দেখা গেল ৫৪ হাজার ৩৬৫ দর্শক রং মেখে উল্লসিত হাজির কেকেআরের ‘যুদ্ধ’ দেখতে। খেলাকে অনেকেই এখন যুদ্ধ বলে থাকেন।
এই ঘটনা নিয়ে কাগজে লিখতে গেলে শিরোনাম কী হতে পারে?
ক্রিকেটের কাছে গোহারা হেরে গেল গরম।
ভোটের প্রেক্ষাপটে এই ঘটনাকে রেখে, দুটোকে মেলালে বাংলার সংস্কৃতির একটা নতুন দিক উঠে আসে। সেই নতুন দিকটা কত ভয়ংকর, কত স্বাভাবিক, তার উত্তর খোঁজার দায় না হয় আপনার ওপর ছেড়ে দেওয়া যাক প্রিয় পাঠক আমার। আপনিই সিদ্ধান্ত নিন, কোন পথে চলেছে সমাজ। কোন পথে চলেছে মানুষ। নাকি এখান থেকে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়াই অবধারিত বোকামি।
দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, কুকথা, গালাগাল, মিথ্যের ফুলঝুরি, অপ্রাসঙ্গিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে নির্বাচনে। তাতে কি সাধারণ মানুষ আদৌ প্রভাবিত হন এখন? মনে তো হয় না। এসবের প্রভাব ইদানীং কালের ভোটে আদৌ পড়ে না। অত শত ভাবেও না মানুষ। নিজের বা নিজের পরিবারের প্রাপ্তি ঠিক থাকলেই হল। সমাজের কী হল, অধিকাংশ মানুষের যায় আসে না কিছু।
এই যে কেকেআরের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ইডেনে আছড়ে পড়ে, তাঁরা কি কোনওদিন ভেবে দেখেছেন, কলকাতার নাম ভাঙিয়ে কেকেআর কত ব্যবসা করে গিয়েছে? অথচ কলকাতা বা বাংলার জন্য একেবারে কিছুই করেনি ১৭ বছরে। রাজ্যের জন্যও না, বঙ্গক্রিকেটের জন্যও না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদ নিয়ে যা খুশি করে দিয়েছে। মমতা বা তাঁর মন্ত্রীরা একবারের জন্যও প্রশ্ন তোলেননি, কলকাতায় কেকেআরের অফিস হল না কেন? আইপিএলের অন্য অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি শহরের জন্য নানা কিছু কাজ করেছে। কেকেআর তুলনায় শুধু ভাঁওতাবাজির ওপর দাঁড়িয়ে। তবু কলকাতা নামের ব্র্যান্ডিং লোক টানছে।
এই টিমে ধোনি বা বিরাট খেলেন না। রোহিত বা পান্ডিয়াও নন। তবু কেকেআর নামটাই মাঠে লোক টেনে আনছে। কম কথা নয়। বড় কৃতিত্ব।
শাহরুখের সংস্থা রেড চিলিজ নাইট রাইডার্স কিনেছিল ২৯৮ কোটি টাকায়। দু’বছর আগের হিসেব দেখছি, কেকেআরের দাম তখনই ১.১ বিলিয়ন ডলার। রেভিনিউ ৪১.২ মিলিয়ন। অপারেটিং ইনকাম : ১৪.১ মিলিয়ন। এই যে হাজার হাজার লোক কেকেআরের হয়ে খেলা দেখে উৎসব করেন, তাঁরা কোনওদিন এসব প্রশ্ন তুলেছেন? শাহরুখ কলকাতা বা বাংলার জন্য এতটুকুও কিছু করেননি। শুধু ‘কোলকাতা আমি টোমাকে বালোবাসি’ বলে ছেড়ে দিয়েছেন। কেকেআর ব্র্র্যান্ডের জনপ্রিয়তার কাছে সব চাপা পড়ে গিয়েছে। ফুটবলে কলকাতা নামের সর্বজনগ্রাহ্য কোনও টিম নেই। ক্রিকেটে তো রয়েছে অন্তত।
একদল ক্রিকেটপ্রেমী যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভোট দেওয়ার সময় মানুষ প্রার্থীদের সততা, দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সে সময় মজা লাগে বেশ। মনে পড়ে অঙ্কিত কেশরী নামে এক হতভাগ্য ক্রিকেটারের কথা।
সেটাও একটা এপ্রিল মাস। ২০১৫ সালের কথা বলছি। মাস চারেক আগে অস্ট্রেলিয়ার ফিল হিউজ আগে ক্রিকেট মাঠে মারা গিয়েছেন। তার রেশ ধরে ক্রিকেট মাঠে আতঙ্ক তীব্র। কলকাতা মাঠে সিনিয়ার নকআউট ম্যাচ চলছিল। বাংলার অনূর্ধব-১৯ ক্রিকেট অধিনায়ক অঙ্কিত কেশরী ম্যাচের মধ্যে এক ক্রিকেটারের সঙ্গে সংঘর্ষে লুটিয়ে পড়েন। তিনদিন হাসপাতালে থাকার পর তরুণ অঙ্কিত চিরকালের জন্য হারিয়ে যান। সেই ঘটনা নিয়ে বাংলার ক্রিকেটে হইচই পড়েছিল।
কেকেআর অধিনায়ক তখন গৌতম গম্ভীর। তিনি তখন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাঁশদ্রোণীতে অঙ্কিতের পরিবারের কাছে যাবেন। কেকেআর অবশ্যই তাঁদের পাশে দাঁড়াবে। ধন্য ধন্য পড়েছিল চারদিকে। প্রচার নিয়ে চলে যান গম্ভীর। কিন্তু কেশরীর বাড়িতে যাওয়ার সময় পাননি। পরে সাংসদ হন। তবু কিছু করেননি। এই যে এখন আবার কেকেআর কোচ হয়ে এসেছেন, অঙ্কিতের কথা অবধারিত ভুলে গিয়েছেন। তাঁকে কেউ প্রশ্নও করেন না।
তাতে তো কেকেআরের কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। একজন সমর্থকও কমেনি। মরুভূমির মতো গরমেও কেকেআর আবেগে লোক যাচ্ছে ক্রিকেট দেখতে। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলকে নিয়েই বরং কেকেআরের মতো আবেগ, মার্কেটিং তৈরি হয়নি। যা দরকার ছিল। ফুটবলের ক্লাবগুলো একশো পেরোনো, কেকেআরের বয়স মাত্র ১৭। কেকেআরে বাংলার চিহ্ন নেই, শুধু কলকাতার নাম জড়িয়ে। তবু কলকাতার বাইরে অনেক বাঙালিই কেকেআরের ভক্ত।
রাজনীতিতেও এখানে ক্রিকেটের সঙ্গে অন্তহীন মিল। গৌতম গম্ভীরের মতো অসংখ্য চরিত্র রয়েছেন রাজনীতিতে, যাঁরা কথা দিয়ে কথা রাখেন না। প্রচুর মিথ্যে কথা বলে যান। লোকের কাছে এসব গুরুত্ব পায় না।
ক্রিকেট এবং রাজনীতিতে আরও কী মিল দেখুন, কেকেআর যেমন কলকাতা নিয়ে মানুষের আবেগকে শুষে শহরকে কিছুই দেয়নি, রাজনীতির অনেক পার্টিও এই এক কাজ করেছে। বাড়তি যোগ হয়েছে দুর্নীতির স্তূপে বসে থাকা, মানুষে মানুষে জাতিগত ভাগ করে রাখা, অতীতে অনেক দুষ্কর্মের সাক্ষী হয়ে থাকা। ক্রিকেটের মতো রাজনীতিতেও এগুলো সাধারণ জনতা নির্বিবাদে ক্ষমা করে দিয়েছে। আদর্শহীনতার সওয়ারির পিঠে চড়েছে। ক্ষমা অত্যন্ত ভালো গুণ। সর্বক্ষেত্রে দেখাতে পারলে তো ভালো। তা তো হয় না। মানুষ একদিকে বাবা-মাকে ফেলে রেখে দিচ্ছে রাস্তায়। আর ভোটের বাজারে ঠিক ক্ষমার মুডে। সেখানে জিতে বেরিয়ে যায় কেকেআরের মতো আরও দুটো ব্র্যান্ড। দিদি অথবা মোদি।
আমি জানি, দুজনের বাছাই করা প্রার্থী দলবদলিয়া। আদর্শচ্যুত। নানা রকম সিন্ডিকেটরাজে ওস্তাদ। তবু তাঁকেই ভোটটা দিয়ে আসব। যেমন জানি, ক্রিকেটে অনেক গণ্ডগোলের ঘটনা হয়। তবু সেখানেই যাব। আমাদের মনস্তত্ত্ব বড় অদ্ভুত।
অনেক মানুষকে বলতে শুনি, দেখেছেন কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকার আমাদের উৎসবে বুঁদ করে রাখছে। আসল সমস্যা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা। তাঁরা যা বলছেন না, সেটা আরও বড় সত্য। আমরাই আসলে উৎসবে, হুজুগে বুঁদ হয়ে থাকতেই ভালোবাসি। আইপিএলের মতো মশালা টুর্নামেন্টই হোক আর ভোটই হোক। এই যে মিঠুন বা দেবের মতো লোকেরা রোড শো করতে এলেন, কোথাও এঁরা নির্দিষ্ট রুটে প্রচারে যাননি। অনেকে অপেক্ষা করে ছিলেন। সেদিকে যাননি দুই সুপারস্টার। তাতে কোনও ক্ষতি হয়নি। কোনও পার্টির ভোট কমেনি ক্ষোভের জ্বালায়। শাহরুখের টিমের কাজের বিরুদ্ধে যেমন কোনও বিক্ষোভ হয় না। সৌরভকে সরিয়ে দেওয়ার পরেও আখেরে জনপ্রিয়তা কমেনি কেকেআরের।
ক্রিকেটভক্ত এবং ভোটারদের মধ্যে একটা জায়গায় সবচেয়ে বড় মিল।
আমাদের ক্রিকেট ভক্তিতে আর সেই শিল্প, সূক্ষ্মতা, রোমান্টিকতা, টেকনিক চর্চা, ইতিহাসের স্মৃতি রোমন্থন নেই। আমাদের ক্রিকেট উত্তেজনা জেগে আছে শুধু মারকাটারি ব্যাটিংয়ে। ভোটারদেরও অত অতীতের আদর্শ নিয়ে তলিয়ে ভাবতে বয়ে গিয়েছে! চে গেভারার উল্কি পাঞ্জাবিতে ঢেকে সটান চেঁচিয়ে ওঠা যায় ‘জয় শ্রীরাম’ বলে। ফুলে ফুলে, রামে বামে পালটাপালটি এক সেকেন্ড কা খেল ভাই, এক সেকেন্ড কা খেল।
ক্রিকেটভক্তদের অধিকাংশ ক্রিকেটের বেটিংয়ের প্রভাব নিয়ে বিরক্ত। অনেকে ক্ষুব্ধ বোলারদের ক্ষমতা কমিয়ে খেলাটা ব্যাটসম্যানদের করে ফেলায়। তা হলে আর বোলারদের না খেলিয়ে বোলিং মেশিন রেখে দিলেই হয়, এমন বলেন। অমিত শা-পুত্র যেভাবে পরিবারবাদে ভর করে বোর্ড দখল করে নিয়েছেন, তা নিয়ে নানা টিপ্পনী চলে। আবার তাঁরাই উদ্বাহু হয়ে মাতেন ক্রিকেটে। নাচেন ব্যাটসম্যানের রণংদেহি রূপ দেখে। বোলাররা ভালো খেলে উইকেট নিয়ে দ্রুত ম্যাচ শেষ করে দিলে বলবেন. এটা কোনও পিচ হল? একেবারে অযোগ্য পিচ।
ভোটারদের ক্ষেত্রে আসুন। একই জিনিস দেখবেন অবিকল। তিনি নেতাদের দুর্নীতি দেখে গালাগাল দেবেন। দলবদল করে বড় বড় কথা বলা নেতাদের দেখে অসহ্য বলবেন। সাম্প্রদায়িক হানাহানি ভাগাভাগির চেষ্টা দেখে কড়া সমালোচনা করবেন। পুরোনো দুর্নীতির কারিগরের মুখে নতুন কথা শুনে ব্যঙ্গ করবেন। ভোটটা দেওয়ার সময় আবার সেইসব নীতি-আদর্শহীন লোককে দিয়ে আসবেন।
আপনি বলবেন, দুজনেই তো এক প্রজাতির। দু’পক্ষই মানুষ। ফারাক আর হবে কেন? মানুষ নিজেই জানে না, মানুষ কী চায়। দেশের রাজধানীর কথা ধরা যাক। শহরের পূর্বপ্রান্তেই বেশি গরিবের ভিড়। সেখানে আপ জমানায় সরকারি স্কুল ও হাসপাতালের প্রচুর উন্নতি হয়েছিল। স্কুলের উন্নতির পিছনে যাঁর হাত সবচেয়ে বেশি, সেই অতিশী আপের হয়ে গত ভোটে হারলেন তিন নম্বর হয়ে। ভোট মাত্র ১৭.৪৪ শতাংশ। ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীর সেখানে ৫৫.৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে সাংসদ। পাঁচ বছর পরে সেই গম্ভীর রাজনীতিতেই নেই। সব ছেড়েছুড়ে প্রচুর টাকা নিয়ে আইপিএলে কেকেআরের দায়িত্বে।
বলছিলাম তো, ক্রিকেটের মতোই রাজনীতি। কোথাও কোথাও সম্পূর্ণ ব্যাখ্যাহীন। ক্রিকেটপ্রেমিক ও ভোটাররা তাই মিলেমিশে একশা হয়ে যান অক্লেশে।