- মৃড়নাথ চক্রবর্তী
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এড়িয়ে যাওয়া বিষয়গুলির মধ্যে বর্তমানে বই অন্যতম। আজ থেকে মোটামুটি পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও সাধারণ মানুষের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল বই। এখন যে মানুষ বই থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে তাতে কার দোষ? মানুষের? না। প্রতিটি মানুষ একটি স্বাধীন মস্তিষ্ক যা স্বাধীনভাবে নিজের পছন্দের এক্তিয়ার নির্ধারণ করে। কোনও স্বাধীন মানুষের কোনও দায় নেই শিল্প, সাহিত্য, দর্শন বা বিজ্ঞানের প্রতি নিজেকে আসক্ত করার। মানুষ তার বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে যা কিছু বেছে নিতে পারে ও নেয়।
গ্রিসে সোফোক্লেস বা ইউরিপিডিসরা নাটক এভাবে লিখতেন যাতে নাটকের শেষে মানুষের ‘ক্যাথার্সিস’ তৈরি হয়। কিন্তু গ্রিকবাসীরা ‘ক্যাথার্সিস’ উপলব্ধির ব্রত নিয়ে অ্যাক্রোপলিসের ছায়ায় যেতেন না, যেতেন বিনোদনের জন্য। তাত্ত্বিক চিন্তা-চেতনা গুটিকয় মানুষের কাজ, আপামর জনসাধারণের দায় নেই তা নিয়ে গভীর বা অগভীর চিন্তার। একটি ট্র্যাজেডির শ্রেষ্ঠত্ব তার ‘ক্যাথার্সিস’ তৈরিতে, কিন্তু একজন দর্শকের কোনও দায় নেই সেই উপলব্ধির তাগিদে থিয়েটারে যাওয়ার। তাঁর লক্ষ্য বিনোদন, নাট্যকারের লক্ষ্য তাঁর দর্শন সেই দর্শকের মধ্যে রোপণ করা।
আজকাল বই পড়া হয় না কেন, মানুষ বইয়ের বদলে ডিজিটাল মাধ্যমকে, ছোট ভিডিও বা রিলকে, ওয়েব-সিরিজকে কেন বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে তা নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। এ নাকি সমাজ ও সংস্কৃতির অপমৃত্যু।
এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন, যখন মোটরগাড়ি ছিল না, মানুষ গোরুর গাড়িতে চড়ত। তবে এখন কেন চড়ে না? অথবা, মাত্র কয়েক বছর আগেও মানুষ কাছাকাছি কোথাও যাবার ক্ষেত্রে মানুষে-টানা রিকশা ব্যবহার করতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই জায়গায় এসেছে ব্যাটারি-রিকশা। এটা কি তবে পরিবহণের অপমৃত্যু?
একজন সাধারণ মানুষ তুলনামূলক বেশি আরামদায়ক ও বেশি আকর্ষণীয় মাধ্যমকে ছেড়ে শুধুমাত্র গুটিকয় তাত্ত্বিক আঁতেল গোছের মানুষের কথা শুনে বই কেন পড়বে যদি তাতে সে আগ্রহী না হয়? তার তো কোনও দায় নেই বইয়ের প্রতি, লেখকের প্রতি বা প্রকাশকের প্রতি। তার প্রয়োজন বিনোদন। তাই সে তার পছন্দের মাধ্যমকেই বেঁছে নেবে, আর সেটাই খুব স্বাভাবিক।
এখন কেউ কেউ বলবেন যে বই না পড়ায় মানুষের কল্পনাশক্তি, চিন্তাশক্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমার প্রশ্ন হল, তাতে কার কী এসে যাচ্ছে? কিচ্ছু না। এককালে শিলনোড়া ও হামানদিস্তা ব্যবহার হত, এখন তা উঠে গিয়ে মিক্সার-গ্রাইন্ডার এসেছে, আর মানুষের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বেড়েছে। তাই বলে কি আবার শিলনোড়া ও হামানদিস্তায় ফিরে যাচ্ছে মানুষ? ক’দিন পর হয়তো সমস্ত লেখালেখিই এআই করবে, কবিতাও এআই লিখবে। মানুষ তাই-ই পড়বে, বা পড়বে না। বই পড়া বন্ধ হয়ে গেলেও কারও কোনও ক্ষতি হবে না তেমন গভীরভাবে। কারণ লাভক্ষতি সবটাই আমরা একটা নির্দিষ্ট ধ্রুবকের ওপর নির্ধারণ করি। যদি বই পড়া বন্ধ হয়ে যায়, তা হবে প্রায় সামগ্রিকভাবে বন্ধ। আর যা সামগ্রিকভাবে পালিত হয়, তাকে আমরা ক্ষতি বলি না, বলি স্বাভাবিকতা।
(লেখক খাগড়াবাড়ির বাসিন্দা। আলিপুরদুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)