- পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়
নীতিন শেকারের ‘হোয়াট’স লেফট অফ দি জাঙ্গল’ গ্রন্থ যে বাস্তব চরিত্রকে ঘিরে, রাজাভাতখাওয়াবাসী সেই নেত্রপ্রসাদ শর্মার সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার জন্মভূমি আলিপুদুয়ারের খবরাখবর নিয়ে কথা হয়। ক’দিন আগে জানলাম যে, বিগত কয়েকদিন ধরে হাতি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাবারের খোঁজে। শত্রু মানুষের বিরুদ্ধে উগরে দিচ্ছে রোষ। সেদিন ভোরে ভেঙে দিয়েছে বামনি বস্তির একটি ট্যুরিস্ট লজের কিছু অংশ। তিন-চারদিন আগে পানিঝোরাতে রাস্তার পাশের দু-তিনটে দোকান ভেঙেছে।
এবার শীতে বৃষ্টি হয়নি। তাই বৃক্ষহীন জঙ্গল একদম শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে আছে। সবুজের দেখা সেইভাবে নেই। বর্তমানে জঙ্গলে হাতির খাওয়ার মতো ঘাস বা অন্য গাছ নেই। আর বছরের এই সময়টা থাকে হাতিদের ‘মেটিং’-এর সিজন। তাই ওরা একটু উন্মত্ত থাকে। তার উপর ভুখা পেট।
এর খবর কি আর বন দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা বা অন্য কর্মীরা রাখেন? রাখেন না। মাঝে মাঝে কোনও অংশে ঘাস লাগায়। কিন্তু, পরের বারের জন্যে পুরো ঘাস পুড়িয়ে নতুন বীজ বপন হয় না। ফলে ঘাস জাতীয় খাদ্যেরও অভাব। শুধু মাঝে মাঝে ওয়াচটাওয়ার থেকে লবণ ফেলে দিয়ে দায়িত্ব খালাস। বেতন তো ঘরে বসে বসেই পাওয়া যায়।
বক্সা ফরেস্ট অঞ্চলের ১৫, ১২, ১০ এবং ২ নম্বর কম্পার্টমেন্ট এলাকায় এবার প্রচুর চালতা ফলেছে। চালতা হাতির অতি প্রিয় খাদ্য। তাই হাতিরা বক্সা-জলদাপাড়া করিডর দিয়ে যেতে যেতে বা কুমারগ্রাম-সংকোশ এলাকা থেকেও চলে আসছে এইসব চালতা গাছ থাকা এলাকায়। দিনের যে কোনও সময়েই হাতির দেখা মিলবে। এতে পর্যটনশিল্পের পোয়াবারো। পর্যটনের সিজন এখনও বলবৎ আছে। তাই পর্যটকরা খুব খুশি। কিন্তু, তাঁদের প্রাণ হাতে নিয়ে বেড়াতে হবে। কারণ যে কোনও সময়েই হাতি লজের ঘরে হামলা হানতে পারে।
বন দপ্তরের অনুমতি ছাড়াই, ছোট-বড় লজ বা রিসর্ট গড়ে উঠছে জঙ্গলের এমন অংশে, যেখানে মানুষের বসবাস করা উচিত নয়। সামান্য যা গাছ আছে, তাও বন দপ্তরের কর্মীদের চোখের সামনেই কেটে নেওয়া হচ্ছে। উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে গাছের কাণ্ড অর্ধেক চিরে রেখে দেওয়া হয়, যাতে সামান্য ঝড়েই তা ভেঙে পড়ে রাস্তার উপরে। আর হইহই করে কাঠ কাটা শুরু হয়ে যায়। জঙ্গল থাকবে না। থাকবে শুধু মানুষের বসবাসের গৃহ বা পর্যটন-গৃহ। মানুষ নির্লজ্জের মতো ঢুকে পড়বে জঙ্গলে। বিপরীতে হাতির মতো প্রাণীরা চলে আসবে মানুষের বসবাসের এলাকায়। হাতির মতো শক্তিধর প্রাণীরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসার সাহস পায়। কিন্তু, হরিণের মতো নিরীহ প্রাণীরা? তাদের অবস্থা কি কেউ জানে?
রাজাভাতখাওয়া-দমনপুরের মানুষ হাতির এই উপদ্রব সহ্য করে নিচ্ছে ক্ষতি বেশি না হলে। কিন্তু, এইভাবে কতদিন চলবে? এই আসা-যাওয়া কি হাতিদের পক্ষে নিরাপদ থাকবে? নাকি রেললাইনে কাটা পড়ে হাতির মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটতে থাকবে?
(লেখক অনুবাদক এবং প্রাবন্ধিক)