Thursday, February 13, 2025
Homeসম্পাদকীয়উত্তর সম্পাদকীয়মোর মালঞ্চে বসন্ত নাইরে নাই

মোর মালঞ্চে বসন্ত নাইরে নাই

রাতে ঘুমোতে গেলে বসন্ত চৌধুরীর মতো কেউ দীপ জ্বেলে যায়। জাগলেই বসন্ত বিশ্বাসের মতো কেউ বোমা মারে।

  • ধ্রুব গুপ্ত

বহুকাল আগে যখন কলকাতা ময়দানে কলকাতা বইমেলা অনুষ্ঠিত হত, তাতে নিরন্তর গান বাজত ‘মোর মালঞ্চে বসন্ত নাইরে নাই/ ফাগুন ফিরিয়া গেল তাই’। তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া। শীতের প্রান্তসীমায় কবোষ্ণ বাতাসে বই-বৌ কিংবা বৌসমপ্রেমিকা সামলে বাঙালি সে গানকে দিব্যি উপেক্ষা করত আর কিংশুক-মন্দার ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ফিশফ্রাইতে কামড় দিত। তারপর সরস্বতীপুজোর মালা গাঁথতে গাঁথতে আর খিচুড়ি রাঁধতে রাঁধতে গুচ্ছের বার্ষিক-পারিপার্শ্বিক-মাধ্যমিক-উচ্চ-অতি উচ্চ পরীক্ষার ধাক্কায় কোথা দিয়ে যে বসন্তকাল ফুড়ুত হয়ে যেত, তা নিয়ে তার অত না ভাবলেও চলত। এক ফাঁকে একটু রং মেখে ‘ওরে গৃহবাসী’ গেয়ে নেচে দিলেই চলত।

ঋতু-রাগ-রোগ-অভিনেতা-বিপ্লবী বলতে গেলে সর্বভূতেই বাঙালির বসন্তের ব্যথার অনুভব। সেখানে তার নাক্ষত্রিক-সৌরবর্ষপঞ্জিতে ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাসব্যাপী এই ঋতুটি পদে পদে এমন লুকোচুরি খেলবে, সেটা তার পক্ষে পীড়াদায়ক।

কালের গতি বড় রহস্যময়। বইমেলা জেলায় জেলায় ঘুরে ক্লান্ত হয়ে বিশীর্ণ হয়ে শীতের গর্ভে চলে গেল যাবতীর পাঠাভ্যাস সমেত। পরীক্ষাগুলিও কোন মহাকালের পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্তার অলঙ্ঘ্য নির্দেশে পরখ করে, প্রাণসুধায় ভরে কোথায় যেন সরে গেল। আর বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হচ্ছিল, তা কোভিডকালীন খ্যাপা পবনের সাহচর্য পেয়ে শীতের আমেজকে দিল প্রলম্বিত করে।

হিমের পরশ লাগা দীর্ঘকায় এক বসন্তকে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘুমন্ত দেশে বসন্তসেনাকে জাগানোর কথা মনে পড়ল বাঙালির। খিদে পাওয়ার মতো তার গান-নাচ-কবিতা সবই পেল। স্মৃতিপটে ভেসে এল পুরোনো প্রেমপত্র, যেখানে অনন্ত বসন্তের পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষা করা হয়েছিল। গীতার শ্লোকও ভেসে এল ‘…অহং ঋতুণাং কুসুমাকরঃ’। বুদ্ধিজীবীরা নীরব বৌদ্ধিক সম্পদ নিয়ে রাচেল কার্সনের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ পর্যন্ত দৌড়ালেন। কিন্তু বসন্তের জ্বালা কমানো গেল না। রাতে ঘুমোতে গেলেই বসন্ত চৌধুরীর মতো কেউ দীপ জ্বেলে যায়, গেয়ে ওঠে ‘এই রাত তোমার আমার’। জাগলেই বসন্ত বিশ্বাসের মতো কেউ বোমা মারে। কী জ্বালা!

এই দীর্ঘায়িত বসন্তে প্রাণ নাই কেন? এখানে যখন-তখন গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত এসে দাপিয়ে যায় কেন? বেলা দশটায় নিদ্রাভঙ্গের পর স্নানবর্জিত বাঙালি গায়ে অধিক পরিমাণে বডি স্প্রে সিঞ্চিত করে বাসি বার্গার এবং নকল দ্রাক্ষারস সেবন করে বুঝতে পারে কোমর আর বেঁকছে না। নাচের সমস্ত মুদ্রা রিল ভিডিও, প্রতিবাদী অনশন এবং ল্যাম্পপোস্টের নীচের পোশাকি শালীনতায় খরচ হয়ে গিয়েছে। গানের সমস্ত সুর মাথা-কামানো বহুবিবাহিত মার্জারধ্বনির গালাগালে হারিয়ে গিয়েছে। কবিতার সমস্ত অক্ষর ব্রিগেড-ধর্মতলা-কালীতলা-মনসাতলার তৈলাভিষিক্ত পুরস্কারমুখী কর্দমাক্ত নয়ানজুলিতে নিমজ্জিত।

নিম্নমেধার দর্শকের সামনে নিম্নমেধার অভিনয় না হয় রিলের পর রিল নামিয়ে না হয় ‘আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল’ গেয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু নিখিল ব্যানার্জির সেতারে সন্তুষ্ট হওয়া সুবৃহতের বসন্ত তা শুনবে কেন? নিখিল ব্যানার্জির বাড়ি ভেঙে ধুলোয় মিশিয়েছে তো বাঙালিই। অধিক দ্রাক্ষারস সেবনে এখন হসন্তের জায়গায় বসন্ত খুঁজতে গিয়ে সে দেখে আর শোনে ‘আয়ুবিহঙ্গ উড়ে চলে যায়, হে সাকি পেয়ালা অধরে ধরো’, তারপর ভাবে ‘মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে’। ততক্ষণে চৈত্রের সেল শেষ। পিঠে শিক গেঁথে চড়কগাছে তোলার আয়োজন সম্পূর্ণ এবং গগনে গগনে প্রবল কালবৈশাখীর ঘনঘটা।

(লেখক অসমের ধুবড়ির বাসিন্দা। পরিবেশরক্ষা সংক্রান্ত গবেষক, লেখক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img
[td_block_21 custom_title="LATEST POSTS"]

Most Popular