- গৌতম হোড়
ফিরোজ বরুণ গািন্ধর সঙ্গে বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বের সম্পর্ক গত পাঁচ বছরে মধুর ছিল, এমন দাবি কোনও বিজেপি নেতাই করবেন না। বরং এই সম্পর্কে রীতিমতো চড়াইউতরাই ছিল। যদি রেখচিত্র দেখা যায়, তাহলে তা ক্রমেই নীচের দিকে নেমেছে। শীর্ষনেতৃত্বের কাছে বরুণ যেমন ‘ব্যাড বয়’ থেকে গিয়েছেন, তেমনই বরুণও তাঁর বিদ্রোহী সত্তা বজায় রেখেছেন।
গত পাঁচ বছরে নিজের নির্বাচনকেন্দ্র পিলিভিটের জন্য তিনি কাজ করেছেন, সংসদে উপস্থিত থেকেছেন, সেটা বাদ দিয়ে বাকি সময়টা বরুণ যা করেছেন, তা হল, প্রচুর লিখেছেন। তিনি নিয়মিত খবরের কাগজে কলাম লেখেন। ভারতীয় অর্থনীতি, গ্রামীণ ব্যবস্থা, কৃষি ও সামাজিক অবস্থা হল তাঁর প্রিয় বিষয়। নিয়মিত বই লেখেন। আর সেই লেখার মধ্যে কখনও প্রচ্ছন্ন, কখনও প্রকটভাবেই সরকারের নীতির সমালোচনা থাকত। এই লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে বিজেপি নেতারা তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হতেন, তাকে অনেকবার মানা করা হয়েছে। কিন্তু বরুণ লেখা চালিয়ে গিয়েছেন। হয়তো তার মধ্যে সমালোচনার সুর কম হয়েছে বা বিষয় পরিবর্তন হয়েছে, এই মাত্র।
২০২৩ সালে উত্তরপ্রদেশের আমেঠিতে সঞ্জয় গািন্ধ মেমোরিয়াল হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় যোগী আদিত্যনাথ সরকার। তখন এই সিদ্ধান্তের প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছিলেন বরুণ। তিনি বলেছিলেন, এই হাসপাতালের সঙ্গে তাঁর বাবার নাম যুক্ত, তাঁর ঠাকুমা এটা তৈরি করেছিলেন, সেটা তাঁর কাছে আবেগের বিষয়। কিন্তু এই আবেগের বাইরে একটা বিষয় আছে। একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অনেক সময় লাগে। একটা বিকল্প ব্যবস্থা না করে, তার লাইসেন্স বাতিল করা ঠিক নয়। যখন এলাহাবাদ হাইকোর্ট এই সিদ্ধান্তের উপর স্থগিতাদেশ দেয়, তখনও বরুণ তা স্বাগত জানান।
পিলিভিটে বরুণের নিজের কাছের কর্মীরা ছিলেন। তঁাদের সাহায্যেই তিনি সেখানে কাজ করতেন। কয়েকশো মানুষকে তিনি নিয়োগ করেছিলেন, পিলিভিটে নিজের সম্ভাব্য জয় নিশ্চিত করতে। তাঁরা অনেকেই বিজেপির সংগঠনের বাইরের কর্মী। বলা যেতে পারে বরুণ-ব্রিগেড। ফলে দলের অন্দরে তাঁকে ঘিরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল প্রচুর। সরকারি কাজকর্মের প্রচার করতেও তাঁকে বিশেষ দেখা যায়নি। এককথায়, বিজেপির সঙ্গে তাঁর একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এটাও শুনেছি, সামাজিক মাধ্যমে দলের প্রচার করার নির্দেশ নিয়েও বরুণ খুব একটা উৎসাহ দেখাতেন না। যদিও সামাজিক মাধ্যমে বরুণ রীতিমতো জনপ্রিয়।
তবে এতকিছুর পরেও বরুণের আশা ছিল, পিলিভিটে তিনিই বিজেপির প্রার্থী হবেন। গত ১৯ জানুয়ারি তিনি টুইট করে একটা সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘এটা অনেক বছর ধরে সেবার ফলে অর্জন করা বিশ্বাসের জন্য হয়েছে। পিলিভিটের সঙ্গে আমার বিশেষ সম্পর্ক আছে।’ সমীক্ষাতে বলা হয়েছিল, পিলিভিটের ৭২.৪৮ শতাংশ ভোটদাতা মনে করেন, বরুণেরই আবার জেতা উচিত। ২০১৯-এর নির্বাচনেও তিনি প্রায় আড়াই লাখ ভোটে জিতেছিলেন।
কিন্তু বিজেপি যখন পঞ্চম তালিকা প্রকাশ করল, তখন দেখা গেল, বরুণকে পিলিভিটে প্রার্থী করা হয়নি। প্রার্থী করা হয়েছে প্রয়াত কংগ্রেস নেতা জিতেন্দ্র প্রসাদের ছেলে জিতিন প্রসাদকে। তিনি কয়েক বছর আগে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। আমেঠি, রায়বেরিলির মতো পিলিভিটও নেহরু-গান্ধি পরিবারের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। তবে রাজীব, সোনিয়াদের নয়, মানেকা গািন্ধর শক্ত ঘাঁটি। ১৯৮৯ সালে তিনি প্রথমবার জনতা দল প্রার্থী হিসাবে এখানে জেতেন। পরে ২০১৯ সালে মা ও ছেলে তঁাদের কেন্দ্র পরিবর্তন করেন। মা মানেকা চলে যান সুলতানপুরে এবং ছেলে বরুণ পিলিভিটে। এবার মানেকাকে সুলতানপুরে প্রার্থী করা হলেও বরুণকে পুরোপুরি বাদ।
সঞ্জয় গািন্ধর উত্তরাধিকার নিয়ে রাজনীতি করা মানেকা ও বরুণদের কাছ থেকে পিলিভিট নিয়ে দেওয়া হল জিতিন প্রসাদকে। পিলিভিট এখন বিজেপির কাছে খুব নিরাপদ আসন। সমীক্ষা ঠিক কথা বললে তাহলে সেই আসনটি বরুণেরই পাওয়ার কথা ছিল, কারণ, সমীক্ষায় যে প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তাকেই প্রার্থী করার নীতি নিয়ে চলেন মোদি-শা।
এখানে এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন মোদিরা। বিদ্রোহী বরুণকে ছেঁটে ফেলা হল। এমনভাবে ছেঁটে ফেলা হল, যাতে তিনি সহজে কংগ্রেস বা সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে হাত মেলাতে না পারেন। কারণ, মা মানেকাকে তো প্রার্থী করা হয়েছে। বরুণকে একা হাতে মানুষ করেছেন মানেকা। তাই মায়ের প্রতি তিনি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল। তিনি এমন কিছু করতে পারবেন না, যাতে মায়ের ক্ষতি হয়।
সোনিয়া ও মানেকার মধ্যে সম্পর্ক অসম্ভব খারাপ হলেও রাহুল ও প্রিয়াংকার সঙ্গে বরুণের সম্পর্ক খুবই ভালো। এমনকি দিল্লিতে বরুণের বাড়িতে রাহুল বেশ কয়েকবার গিয়েছেন। দুই ভাইয়ের কথা হয়েছে। প্রিয়াংকাও তাঁকে খুব ভালোবাসেন। এর আগে বরুণকে কংগ্রেস থেকে লড়াইয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু বরুণ শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছেন। এবারও সমাজবাদী পার্টির তরফে খোলাখুলি বলা হয়েছে, বরুণ যদি পিলিভিটে নির্দল হয়ে দাঁড়ান, তাহলে সমাজবাদী ও কংগ্রেস তাঁকে সমর্থন করবে। এমনকি রায়বেরিলি ও আমেঠিতে দাঁড়ালেও করবে। আমেঠি ও রায়বেরিলি এবারও কংগ্রেসের ভাগে পড়েছে। তারা এখনও সেখানে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি। কংগ্রেস অপেক্ষা করছে।
পিলিভিটে মনোনয়নপত্র পেশ করার সময় বুধবার শেষ হয়ে গিয়েছে। বরুণ দাঁড়াননি। বিজেপির কিছু নেতা বলছেন, বরুণ চাইলে তাঁকে রায়বেরিলি থেকে দাঁড় করানো হতে পারে। এর আগেও বরুণ ও মানেকাকে এমন প্রস্তাব যে দেওয়া হয়নি তা নয়, কিন্তু রাজীব ও সঞ্জয় গািন্ধর পরিবার এখনও পর্যন্ত একে অপরের বিরুদ্ধে না দাঁড়াবার সিদ্ধান্তে অটল আছে। সেই নীতি মেনে প্রিয়াংকা রায়বেরিলিতে দাঁড়ালে বরুণের সেখানে দাঁড়াবার কথা নয়।
এর মধ্যে কংগ্রেস নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী বরুণকে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার কথা বলেছেন। এর আগে দাদা রাহুলও এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বরুণ তাতে রাজি হননি। এখন কী হবে? রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই, কিন্তু মা মােনকা বিজেপিতে থাকবেন, সুলতানপুরে লড়বেন, আর তিনি কংগ্রেসে যোগ দেবেন, এতদিন তো এই সম্ভাবনা সযত্নে পরিহার করে এসেছেন বরুণ।
বরুণ জানিয়েছেন, মায়ের প্রচারের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবেন। বরুণ একটা কথা জানেন ও বিশ্বাস করেন, বয়স তাঁর পক্ষে আছে। তাঁর বয়স এখন মাত্র ৪৪ বছর। ফলে রাজনীতি করার জন্য তাঁর সামনে অনেক সময় পড়ে আছে। মানেকার বয়স ৬৭ বছর। বিজেপির এখনকার নিয়ম অনুসারে ৭৫ বছর বয়সে রাজনীতি থেকে অবসর নিতে হবে। ফলে হতে পারে এবারই শেষ লোকসভা নির্বাচনে লড়বেন মানেকা। কারণ, আগামী লোকসভার মেয়াদ যখন শেষ হবে, তখন তাঁর বয়স হবে ৭২ বছর। তখন বরুণের বয়স হবে ৪৯ বছর। তারপরেও অনেকদিন তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে পারবেন। ফলে এখন তাড়াহুড়ো না করলেও বরুণের খুব বেশি ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। এখনও পর্যন্ত, তিনি যা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাতে তিনি এবার আর ভোটে দাঁড়াচ্ছেন না। রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত বদল করতে খুব বেশি সময় লাগে না। তবে এটুকু বলা যায়, রাজনীতির মাঠে এখন অপেক্ষা করলেই বরুণ ভালো করবেন।
এই লেখা শেষ হওয়ার পর পিলিভিটের মানুষের জন্য বরুণের খোলা চিঠি নজরে এল। বরুণ সেখানে লিখেছেন, ‘সাংসদ হিসাবে আমার কার্যকাল শেষ হয়ে গেলেও, পিলিভিটের সঙ্গে সম্পর্ক জীবনের শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে। আমি আজীবন আপনাদের সেবা করার জন্য দায়বদ্ধ। আমি রাজনীতিতে আমআদমির কথা বলার জন্য এসেছিলাম। আজ আপনাদের কাছ থেকে সেই আশীর্বাদই চাইছি, যে মূল্যই দিতে হোক না কেন, আমি আমার এই কাজ চালিয়ে যাব।’
বিজেপির ‘ব্যাড বয়’ তার বিদ্রোহ থেকে সরে আসছেন না।
(লেখক সাংবাদিক)