- রন্তিদেব সেনগুপ্ত
লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এই রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ভেঙে দেওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস সম্পর্কে চরম বিষবাণটি হেনেছেন। মমতা বলেছেন, ‘লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস চল্লিশটির বেশি আসন পাবে না।’ ইন্ডিয়া জোটের শরিক মমতার এহেন মন্তব্যে অন্য জোট শরিকরা হতবাক। ইন্ডিয়া জোটের অনেক শরিকের সঙ্গেই কংগ্রেসের এখনও আসন সমঝোতা হয়নি। আদৌ হবে কি না তা-ও কেউ জানে না। তবুও কংগ্রেস সম্পর্কে এইরকম মন্তব্য তারা কেউ করেনি।
মমতার এই মন্তব্যে সব থেকে বেশি আনন্দিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি নেতৃত্ব। প্রধানমন্ত্রী লোকসভায় মমতার এই বক্তব্যের খেই ধরে কংগ্রেস সম্পর্কে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করেছেন। অনেকেই মনে করছেন নির্বাচনের আগে মমতার এই মন্তব্য ইন্ডিয়া জোট সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করবে এবং বিজেপির হাত শক্ত করবে। ইতিমধ্যেই এই রাজ্যের বাম, কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মমতার বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ তুলতেও শুরু করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মমতা কেন এরকম করলেন? আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, তৃণমূল নেত্রী কিছুটা হঠকারীর মতোই উষ্মাবশত এইরকম মন্তব্য করে বসেছেন। তাতে বিষয়টিকে অতিসরলীকরণ করা হয়ে যাবে। একটু তলিয়ে ভাবতে বসলেই বোঝা যাবে, কংগ্রেস সম্পর্কে এইরকম একটি মন্তব্য করে এই রাজ্যে জোটের দরজাটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার পিছনে মমতার সুচিন্তিত রাজনৈতিক কৌশল কাজ করেছে।
মমতার রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘ চার দশকের। নানাবিধ চড়াই উতরাই পেরিয়ে গত তিনটি নির্বাচনে জিতে বারো বছর যাবৎ এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদে তিনি। কোন কথায় কী বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, সেটি না বোঝার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মমতা নন। বেশ অনেকটা সময় সাংবাদিক হিসেবে মমতাকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, অনেক ক্ষেত্রেই মমতার অনেক সিদ্ধান্তকে আপাতদৃষ্টিতে ভুল মনে হলেও পরে দেখেছি সেগুলি মমতাকে সুফলই এনে দিয়েছে এবং মমতা খুব হিসেব কষেই সেইসব চাল দিয়েছিলেন। ফলে, এবারও মমতা নিতান্ত ঝোঁকের মাথায় কংগ্রেস সম্পর্কে এই কথাটি বলে বসেছেন এরকম মনে করা ভুলই হবে। বরং যতদূর মনে হচ্ছে এর পিছনেও মমতার একটি নির্দিষ্ট কৌশলই রয়েছে।
মমতার এই গোপন কৌশলটি কী? ইন্ডিয়া জোটের জন্মলগ্ন থেকেই মমতা জানতেন, এই রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোটের চিন্তাটি অলীককুসুম কল্পনা মাত্র। আর সিপিএমের সঙ্গে জোট তো অসম্ভব। যে কারণে প্রথম থেকেই এই রাজ্যে জোটের বিষয়ে মমতা আন্তরিক ছিলেন না। তার প্রমাণ, দুটির বেশি আসন কংগ্রেসকে ছাড়তে রাজি না হওয়া। মমতা জানতেন তাঁর এই শর্তে রাজ্য কংগ্রেস কখনোই রাজি হতে পারবে না। অন্যদিকে তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লোকসভা নির্বাচনে লড়তে গেলে তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই যে প্রশ্ন উঠে যাবে— তা অধীর চৌধুরীরা জানতেন। বিজেপির সুরেই ক্রমাগত মমতা এবং তৃণমূলকে আক্রমণ করে যাওয়া অধীরদের পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না দলের হাইকমান্ডের কথায় ঘাড় নেড়ে সুড়সুড় করে এসে মমতার হাত ধরা। জোট যাতে না হয় সে চেষ্টায় অধীররাও তৎপর ছিলেন। যে কারণে দশ-বারোটি আসনের মতো অযৌক্তিক দাবি তুলেছিলেন।
মমতা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন পুরোপুরি। নিজের ঘাড়ে পুরো দায়টা না নিয়ে কংগ্রেস অযৌক্তিক দাবি তুলছে এই অভিযোগ করে জোটের ভাবনায় পাকাপাকি পেরেক মেরে দিয়েছেন। কংগ্রেস যদি মমতার কথামতো দুটি আসনেই সন্তুষ্ট হয়ে জোট গড়তে আসত, তাহলে তেমন অবস্থায় হয়তো মমতাকে জোট ভাঙার নতুন উপায় খুঁজতে হত। কারণ এই রাজ্যে জোট গড়ার থেকে জোট ভাঙাটা রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে মমতার পক্ষে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
কেন? বিগত নির্বাচনগুলির তুলনায় এবারের লোকসভা নির্বাচন মমতার কাছে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। মোদির রাম মন্দির নিয়ে তোলা হিন্দুত্বের হাওয়া গো-বলয়ে যতটা প্রভাব ফেলবে, কালীক্ষেত্র পশ্চিমবাংলায় ততটা না ফেললেও, অন্য কিছু বিষয় এবার মমতার কপালে ভাঁজ ফেলেছে। নির্বাচনের আগে রাজ্য বাজেটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা বাড়ানো থেকে আরও নানাবিধ ভাতাবৃদ্ধির ঘোষণা ভোটের বাজারে তাঁকে কিছুটা সুবিধা দেবে। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে গত কয়েক বছরে গ্রামীণ মানুষজনকে তাঁর সরকার যেসব আর্থিক এবং অন্যান্য সুবিধা দিচ্ছে, সেটাও ভোটবাজারে কিছুটা সহায়ক হবে। এতৎসত্ত্বেও ভোটবাজারে মমতা বোধহয় পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছেন না। তার কারণ, গত বারো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে ভোটারদের একাংশের ভিতর একটি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মানসিকতা জন্ম নিয়েছে এবং দ্বিতীয়ত, প্রশাসনের সর্বস্তরে বল্গাহীন দুর্নীতি, তার সঙ্গে শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের যোগ, মাত্রাহীন সন্ত্রাস, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা এসবের কারণে ভোটারদের একটা বড় অংশের ভিতরে তৃণমূল সম্পর্কে বিতৃষ্ণা। এরই পাশাপাশি বিরোধী দলগুলির দুর্নীতির ইস্যুতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার, একটি অংশের মানুষকে তৃণমূল বিমুখ করে তুলেছে, স্বীকার করতেই হবে।
এইরকম পরিস্থিতিতে লড়াইটি এবার কঠিন। সেটা মমতাও মানেন। আর কঠিন লড়াইটা জিততে গেলে শুধু লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ভাতা বাড়িয়ে বা আরও নানাবিধ আর্থিক সুবিধা দিয়ে হবে না। তার সঙ্গে আরও কিছু কৌশল দরকার। সেই কৌশলটি হচ্ছে রাজ্যে তৃণমূল বিরোধী ভোটকে ভাগ করে দেওয়া। জোট ভেঙে মমতা সেই তৃণমূল বিরোধী ভোটটিকেই ভাগ করে দিয়েছেন। ত্রিমুখী নির্বাচনের দিকে ঠেলে দিয়েছেন রাজ্যকে। এবারের নির্বাচনে এই রাজ্যে তৃণমূল বিরোধী ভোট বিজেপি এবং কংগ্রেস-সিপিএম জোটের ভিতর ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এই ভোট ভাগাভাগির রাজনীতিতে পুরো লাভটাই মমতার।
মনে রাখতে হবে, দিল্লিতে কে এল গেল, তাতে মমতার আপাতত কিছু যায় আসে না। রাজ্যে নির্বাচনে লোকসভার আসন বাড়িয়ে নিজের জমি ধরে রাখা আপাতত মমতার কাছে প্রথম লক্ষ্য। যদি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আসন দখল করতে পারেন, তখন জাতীয় রাজনীতিতে তিনি আবার দরকষাকষির খেলায় নামবেন। তখন তিনি কোন কৌশল অবলম্বন করেন তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।