- শর্মিষ্ঠা ঘোষ
মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে যে বই ছেঁড়া হল আমরা কি নিশ্চিত তা কেবল উল্লাসে? হতাশায়ও কি নয়?
ভৌতবিজ্ঞানের প্রশ্ন সকলের পাশ করার মতো মোটেই ছিল না। এই উত্তর দিনাজপুর জেলা এমনিতেই সবচেয়ে গরিব জেলা বলে পরিচিত। যেখান থেকে কাজের খোঁজে কিশোর থেকে যুবক দলে দলে চলে যায় ভিনরাজ্যে। মেয়েরা বিয়ের প্রলোভনে বিক্রি হয়ে যায়। কিডনি চুরিচক্রের কবলে পড়ে। করোনা পিরিয়ডে এই ছবি আরও জোরদার হয়েছে। স্কুলছুট হয়েছে ছাত্রসমাজের এক বৃহৎ অংশ।
ছেলেদের ক্ষেত্রে যেমন পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে গিয়েছে মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেককেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৮-র অনেক কমেই। বাবা-মায়ের অর্থনৈতিক দুরবস্থা, কর্মহীনতা অর্থাৎ দারিদ্র্যই এর মূল কারণ। স্কুল যাওবা খুলেছে মাঝখানের ওই দুটো বছর স্কুল থেকে সরে থাকা তাদের কাছে ভয়ংকর হয়েছে। দুটো বছরে অক্ষরজ্ঞানও ভুলে গিয়েছিল কেউ কেউ। ফের যদিও বা ধরেবেঁধে মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের ফিরিয়ে এনেছিলেন স্কুলে, কফিনের শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছে প্রশ্নপত্র। শুধু কিন্তু ভৌতবিজ্ঞান নয় প্রশ্ন উঠেছে ইতিহাস প্রশ্ন নিয়েও।
সুতরাং যারা বুঝে গিয়েছে কোনওমতেই আর পাশ করতে পারবে না, যারা বুঝে গিয়েছে পড়াশোনার এখানেই ইতি নিশ্চিতভাবেই, তারা এবার ভিনরাজ্যে কাজে যাবে, যারা বুঝে গিয়েছে বাড়িতে বিয়েটা আর ঠেকিয়ে রাখা যাবেই না, বাবা-মা পারবেই না আরও এক বছর বসে খাওয়াতে, বই কি তারাও ছেঁড়েনি?
নিজে পরীক্ষার হলে উপস্থিত থাকার কারণে এই কথাগুলো আরও বেশি করে মনে হয়েছে। এটা তো ঠিকই, গতবার যেমন ‘আমরা দেখে নেব’ বলার পর আবির খেলা হয়েছিল পরীক্ষার হলের বাইরে, এবার অন্তত সেরকম কোনও আশ্বাস আগাম দেওয়া হয়নি। সবাইকে পাশ করিয়ে দেবে কি না তারা কিন্তু নিশ্চিত নয় এবার। আমাদের সমাজে কম পড়াশোনা যারা করে, বিয়ের বাজারে দুটো ডিগ্রি মান্যতা পায়। এইট পাশ এবং অন্তত মাধ্যমিক পাশ।
এইট পর্যন্ত পাশ-ফেল ছিল না। সুতরাং এইট পাশের সার্টিফিকেট এখন সবাই পায়। নিজে খেটেখুটে পড়ে পাশ করতে হলে মাধ্যমিক তাই একমাত্র মাপকাঠি। মাধ্যমিক পর্যন্ত যেতে তাকে নাইন, টেন এই দুটো বছর পড়াশোনা করতে হয়েছিল। অন্তত খাতায়-কলমে স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়েছিল। কিন্তু যখন সে বুঝে গেল পাশ হয়তো করতে পারবে না, বাবা জোর করে দোকানে বসিয়ে দেবে বা খেতে নিয়ে যাবে বা বিয়ে দিয়ে সংসারে দায়মুক্তির পথ খুঁজবে, স্বাভাবিকভাবেই জীবনের দুটো বছর নষ্ট হবার বেদনা তাকে গ্রাস করবে। যেটা প্রিভিলেজ শহুরে অভিভাবক কিংবা ছাত্র কারও অনুধাবন করবার ক্ষমতা থাকার কথা নয়। অঙ্ক পরীক্ষার পরই এক ছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনা এবারও ঘটেছে। সবই চিন্তার ব্যাপার। সরকারি স্কুলে বহু বছর ঠিকঠাক নিয়োগ পর্যন্ত নেই। বহু স্কুলেই বিষয় শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই বহু বছর। এমন অবস্থায় যারা মাধ্যমিক দিতে বসেছিল তাদের প্রশ্ন সেট করা কিংবা তাদের মনোভাব বোঝার জন্য আরেকটু দরদ কি আমাদের দরকার ছিল না?
(লেখক রায়গঞ্জের বাসিন্দা। শিক্ষক)