- শিমূল সরকার
ফিরে ফোন করে জানিও। কথাটা রেলস্টেশন বা জনপদে হরবখত কানে আসে। তিন দশক আগে শুনতাম, পৌঁছে চিঠি লিখো।
মূল বিষয় সংযোগের মাধ্যম বদলে গিয়েছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখলে আগে হাতের লেখাতে চোখের সামনে আবেগ ভাসত। বর্তমানে কানে-চোখে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। আমাদের লক্ষ্য কম সময়ে সংবাদ দেওয়া। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, আমরা ক্রমশ যান্ত্রিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছি।
চিঠি ভারতের মতো দেশে একদা বড় প্রভাব রাখত। ছিল ডাকহরকরাদের নিয়ে আবেগ। সময়ের তালে তার আয়ু ফুরিয়েছে। সেই নিয়ে আক্ষেপ করার কারণ নেই। একটা চিঠির জন্য প্রতীক্ষা, হাতে পেলে সেই অক্ষরের মাধ্যমে ফুটে উঠত মধুর মনের মিলন। আজ ঋষিদের কথা মেনে শতংবদ মা লিখো। বিগত দু’দশকে বেড়েছে বাড়ি থেকে দূরে কাজ করার প্রবণতা। মানুষ আবার পরিযায়ী জীবনে অভ্যস্ত। সেই দূরত্ব ঘোচাতে নানাবিধ আয়োজন রয়েছে।
ফোন ও ইন্টারনেট তার বড় সহায়। কিছু বিশেষজ্ঞ, ১৯৯২ সালের ডব্লিউ-ডব্লিউ ডট কমের আগে ও পরে দু’ভাগে সভ্যতাকে ভাগ করার পক্ষে।
বিবর্তন ও চাহিদা বেড়েই চলেছে। প্রথমে ছিল ফোনে বাক্যালাপ। বিদেশ থেকে আইএসডিতে নাতির গলা শুনে দিম্মার চোখে জল। সুন্দরবনে দেখেছি, বুথ থেকে মাইকে ঘোষণা হত, অমুক আপনার বোম্বে থেকে ফোন এসেছে। আসুন। ছিপ চালিয়ে হাজির ছেলের সঙ্গে কথা বলতে। আজ এসটিডি বুথ বললে, বাচ্চারা অবাক হয়ে তাকায়। অথচ এককালে কত পরিবারকে তৃপ্ত করেছে। কতজনের প্রেম বিয়েতে রূপান্তরিত হয়েছে। কতজনের কেঁচেও গিয়েছে।
এরপরে স্মার্টফোনে প্রত্যন্ত প্রান্ত যোগ হল। এই বড় বড় ফোনে সত্যি দুনিয়া মুঠঠি মে। তার সঙ্গে যোগ হল ইন্টারনেট। যে খামতি ছিল শুধুমাত্র গলার স্বরের, মুঠোফোনে তা যেন আচমকা অন্যমাত্রা পেল। তবে খরচ বড় বালাই। বিদেশে করা ফোনের খরচ কমাতে অনেকে মা ভালো আছ! আমি ভালো আছিতে সম্পর্ক ছোট হল। কথা বলে মনে শান্তির থেকে অশান্তি বাড়ল। বহু বাবা-মা ছেলের থেকে দূরে সরলেন। আবার প্রেমের সম্পর্কে সব বাধানিষেধ উধাও। তারপর এল হোয়াটসঅ্যাপ কল, ভিডিও কল। সেখানে অন্য এক প্রেমের জগৎ খুলল। সেটার ব্যবসায়িক রূপে সমাজে বিপদও এল। পরকীয়াতেও যেন জোয়ার আজ।
প্রেমে কথার তেজ বাড়লেও ব্যবসায়িক সম্পর্কে এল ভিন্ন স্পর্শ। মোবাইলে সামাজিক মাধ্যমে কত যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে-ভেঙে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। স্মার্টফোনের দৌলতে আজ দুনিয়া একটা গ্রামে পরিণত হয়েছে। কথা বলে, ভিডিও দেখে মানুষ তৃপ্ত। মেয়ের বিয়ের আগে ছেলের বাড়ির বা মেয়ের বাড়ির সামনে নাকি উলঝুল পাগল সেজে গোয়েন্দা বসে থাকত। এখন সামাজিক মাধ্যম ঘাঁটলেই তার চরিত্রের আঁচ পাওয়া যায়।
কতদিন বলুন তো বাড়িতে বাক্স-প্যাটরা বেঁধে আত্মীয়রা আসেননি! বা সন্ধ্যাবেলায় আড্ডা মারতে আসেনি! আগে টিভি দেখার জন্য সন্ধ্যাতে আসতে দ্বিধা করত। এখন একটা ভিডিও কলেও গ্রুপে সকলের দেখা। বসার ঘরে অতিথি আগমন বিরল।
প্রযুক্তির হাত ধরে বিদেশের মানুষ নিকট হয়েছে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে গিয়েছে। বাড়িতেও বাবা-ছেলে-মেয়ে-মাকে ফোন করে ডাকা চালু হয়েছে। ডাকনামে ডাকাও কমেছে। সামাজিক মাধ্যমে লালু-কালু নাম জানলে দফারফা।
প্রযুক্তির হাত ধরে আজ আমাদের পরস্পরের সম্পর্ক অন্য এক মোড়ে দাঁড়িয়ে। সাক্ষাৎ যেখানে অপ্রাসঙ্গিক।
(লেখক পুলিশ অফিসার। উত্তরবঙ্গেও কাজ করেছেন)