চিরদীপা বিশ্বাস
অস্কারমঞ্চে ওপেনহাইমারের জয়জয়কার প্রসঙ্গে কথা হতে হতে হঠাৎ সেদিন আমার এক ভিনরাজ্যের বন্ধু যখন জানতে পারল যে সিনেমাটা আমি দেখিনি, সে স্তব্ধ হয়ে কয়েক মুহূর্ত বসে রইল। তারপর শুরু হল তার ‘ওপেনহাইমার পাঁচালি’।
সিনেমাটার সম্পর্কে নানা ধরনের জ্ঞান নিশ্চুপে শুনে তাকে আশ্বস্ত করলাম, সত্যিই অনেক বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। অবশ্যই সেটা আমি শুধরে নেব। এরপর প্রশ্ন করলাম ‘সত্যজিৎ রায়কে বারে মে জানতি হ্যায় কুছ?’ তৎক্ষণাৎ উত্তর এল, স্কুলের জিকে বইতে সে পড়েছে ‘রে নে অস্কার জিতা থা’। গল্পটা ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল কিন্তু বাদ সাধল বন্ধুটির ‘পথের পাঁচালী’ সম্পর্কিত অসাধারণ কিছু তথ্য।
‘ইয়ে সিনেমা তো দ্রৌপদী কো লেকর হ্যায় না?’ আমি যেন চারশো চল্লিশ ভোল্টের একটা ঝটকা খেলাম। ‘পথের পাঁচালী’ আর দ্রৌপদীর সম্পর্কটা বুঝতে অপারগ আমাকে সে বুঝিয়ে দিল, ইংরেজিতে সে যখন ‘পাঁচালী’ শব্দটা পড়েছে তার বানানটা হয়েছে পাঞ্চালী। অর্থাৎ দ্রৌপদী। এরপর আরও কিছু অভিনব তথ্য শুনে (যেমন ইন্দিরঠাকুরণ নাকি পুরুষ চরিত্র ইত্যাদি) নিজেকে সমৃদ্ধ করে, ওকে বললাম, গিয়ে আগে সাবটাইটেল সহযোগে সিনেমাটা দ্যাখো।
সত্যি বলতে এটাই এক এবং একমাত্র ঘটনা নয়। রাজ্যের রাজধানী শহরে পড়াশোনার সুবাদে কিছু ভিনরাজ্যের বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তাদের অধিকাংশের কাছেই ‘বাংলা মতলব মাছভাত, মিষ্টিদই, রসগোল্লা অউর কালাজাদু’। এমনকি হালফিলের ‘এক মছলি পানিমে…’ ট্রেন্ডে ‘মছলি উঠাকে খালি, বেঙ্গলি থিনা’ যুক্ত হয়েছে। হালকা ছলে দেখলে ব্যাপারটা ‘ক্যাজুয়াল’ই বটে। তবে বাঙালি মানে নোবেল প্রাইজ, বাঙালি মানে অস্কার, বাঙালি মানে নেতাজি সুভাষ, বাঙালি ব্লকবাস্টার- এমন ধারণা কেন আসে না! ঠিক কতজনকে এই প্রশ্ন ভাবায় আজকাল খুব সন্দেহ।
এরকম কথাবার্তা প্রতিটা পদে পদেই হয়তো প্রায় সব বাঙালিকেই শুনতে হয়। অনেকে সমুচিত জবাব দেন, অনেকে আবার দেন না। বলা ভালো, দিতে পারেন না। ওটিটি, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম চষে খাওয়া, কে-ড্রামার ডাবড ভার্সন গোগ্রাসে গেলা বা অ্যানিমের প্রতিটা ইঞ্চি সম্পর্কে খবর রাখা আজকের বাঙালি ছেলে বা মেয়েটির, সত্যজিৎ রায় বা রবি ঠাকুর সম্পর্কে জ্ঞান ওই জিকে বইয়ের দুটো পাতাতেই আবদ্ধ। ভিনরাজ্যবাসী সেই মেয়েটি তাই যদি বলত, বাঙালিরাই তো বাংলা নিয়ে জানে না সবটা, সত্যিই কী জবাব দিতাম তার?
‘ন্যাশনাল অ্যানথেম’, ‘ন্যাশনাল সং’ দুটোই বাঙালির মস্তিষ্কপ্রসূত। এরকম উজ্জ্বল কৃতিত্ব দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে। তবুও, বাংলা আজও আঞ্চলিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ, জিকে বইয়ে সীমাবদ্ধ। ইংরেজি বছর শুরুর মাসখানেক আগে থেকেই এখন ‘নিউ ইয়ার রেজোলিউশন’ ট্রেন্ডিং টপিক। বাংলা নতুন বছর আগমন-এর আর মাত্র একটা মাস। তাই বাঙালি হিসেবে কি মনে মনে ভাবা যায় না যে, যতই ছেলে আমার ইংরেজি-হিন্দিতে চোস্ত হোক না, মাতৃভাষার স্বাদ আস্বাদন করতে শেখাব, কে-ড্রামার পাশাপাশি ‘অপু ট্রিলজি’ কী তা জানাব। আর বাঙালি হওয়ার সুবাদে ‘পাঁচালি’-কে কেউ ‘পাঞ্চালী’ ঠাওরালে সঠিক তথ্য দেওয়ার মতো জ্ঞান নিজে অর্জন করব।
(লেখক প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কোচবিহারের বাসিন্দা)