- সুমন ভট্টাচার্য
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলাপবাগ ক্যাম্পাস থেকে যে রাস্তাটা গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড পর্যন্ত গিয়েছে, তার নাম সুকুমার সেন সরণি। এমনিতে কেউ খুব সেই রাস্তার নামকরণ নিয়ে ভাবেন না বা কে এই সুকুমার সেন তা জানার চেষ্টাও করেন না। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে ভোটের ঘণ্টা বেজে যাওয়ার পরে রবিবার সকালে হয়তো কারও কারও কোনও সংবাদপত্র পড়ে সুকুমার সেন বিষয়ে আগ্রহ জন্মাতে পারে।
ভারতবর্ষের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং এখনও পর্যন্ত ওই পদে বসা একমাত্র বাঙালিকে অনেকেই, এমনকি ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্যতম স্থপতি বলেছেন। স্বাধীনতার পরে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যসচিব থেকে দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়া এই অবিস্মরণীয় বাঙালি ভদ্রলোক ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য কঠিনতম কাজটি করে গিয়েছিলেন। ভোটার তালিকা তৈরি করা থেকে শুরু করে দেশের প্রথম এবং দ্বিতীয়, অর্থাৎ ১৯৫২ এবং ১৯৫৭-র নির্বাচন পরিচালনা। এবং এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি সেই সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ‘ইচ্ছে’ বা নির্দেশকে উপেক্ষা করেছিলেন। অর্থাৎ যিনি তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন, সেই নেহরুর ‘ইচ্ছে’কে উপেক্ষা করে তিনি ১৯৫১ সালে ভোট করাতে রাজি হননি। দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৫২ সালে। সুকুমারবাবুর অন্য দুই ভাইয়ের একজন, খ্যাতনামা আইনজীবী অশোক সেন সাংসদ এবং দেশের আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়া সুকুমার সেন কোনওদিন দেশভাগের দগদগে ক্ষত বয়ে চলা একটি দেশের গণতন্ত্রের প্রাথমিক কাঠামো কীভাবে তৈরি করলেন, সেই নিয়ে কোনও দিন কিছু লিখে যাননি।
দেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার কিন্তু নিয়মিত লেখেন! নির্বাচনের নির্ঘণ্ট এবং আদর্শ আচরণবিধি প্রকাশের মাঝে তিনি তিনবার তিনটি শায়েরি পড়ে শুনিয়েছেন। আর রাজীব কুমারের পাশে বসে থাকা আর দুই নির্বাচন কমিশনার, জ্ঞানেশ কুমার এবং সুখবীর সিং সান্ধু তো মোদি সরকারের বেছে দেওয়া সেই দুই আমলা, যাঁদের নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগের অন্ত নেই।
সুকুমার সেনের মতো রাজীব কুমার প্রচারবিমুখ নন, তিনি শায়েরি লেখেন। সেই শায়েরি প্রেস কনফারেন্সে পড়ে শোনান। এবং বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচ্য বিষয়, যে ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য নিয়ে বিরোধীরা মোদি সরকারকে বিঁধছে, সেই ‘পলিটিকাল ফিন্যান্সিং’ নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বারবার মন্তব্য করেন। কিন্তু এটা জানা যায় না, এসবিআইয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি যে ১৭৭১.৫৭ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড ভাঙিয়েছিল, সেই বিষয়ে তিনি কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? কিংবা অতি সম্প্রতি পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সময় কেন্দ্রের শাসকদল যে ১১৪৯ কোটি টাকা ইলেক্টোরাল বন্ড ভাঙিয়েছিল, সেই বিষয়েই বা নির্বাচন কমিশন কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
এইসব প্রশ্ন মনে আসার কারণ, ২০২৪-এর লোকসভা এবং চারটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের সূচি ঘোষণা করার সময় রাজীব কুমার আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, লোকসভা কেন্দ্রে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ৯০ লক্ষ এবং বিধানসভা নির্বাচনে ৩৮ লক্ষ খরচ করতে পারেন। তাহলে নির্বাচন কমিশনের ‘মডেল কোড অফ কনডাক্ট’ আর তাদেরই ওয়েবসাইটে জ্বলজ্বল করতে থাকা ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ তো?
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বা তাঁর দুই সহযোগী কী বলছেন আর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সামনে আসা ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য কোন বাস্তবকে উন্মোচিত করছে, সেই দুটিকে পাশাপাশি রাখলে কেন দেশে সাত দফায় ভোট, তার একটা কারণ বোঝা যায়। বিরোধীদের অভিযোগ, দেশের যে তিনটি রাজ্যে সাত দফায় ভোট হচ্ছে, সেই তিনটি রাজ্যে ১৬২টি আসন রয়েছে। এবং ওই তিন রাজ্য থেকে গেরুয়া শিবির যেমন সবচেয়ে বেশি আসন দখল করতে চায়, তেমনই বিরোধীদেরও শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ আছে। যদি গোটা ভারতের বিরোধীদের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আক্রমণের কথা মাথায় রাখি, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূলের তোলা অভিযোগকেও বুঝতে পারব।
সত্যিই তো, নির্বাচন কমিশনের যুক্তি অনুযায়ী যদি নিরাপত্তা রক্ষাবাহিনীর যাতায়াত এবং আইনশৃঙ্খলার কথা মাথায় রেখেই পশ্চিমবঙ্গে সাত দফায় ভোট হয়, তাহলে উত্তরবঙ্গে একদিনে মাত্র তিনটি আসনে ভোট হতে পারে আর দক্ষিণবঙ্গে একদিনে ন’টি আসনে? এমন তো নয় যে, দক্ষিণবঙ্গের আসনগুলিতে ভোটার সংখ্যা কম বা সেগুলিতে রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ নেই! তাহলে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের অভিযোগের কোথাও সারবত্তা আছে যে, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাদের সুবিধা করে দিতে এইভাবে সাত দফায় ভোটের নির্ঘণ্ট সাজানো হয়েছে?
তা না হলে উত্তরবঙ্গের প্রধান শহর শিলিগুড়িতে দু’দফায় ভোট হয় কী করে? শিলিগুড়ির ভোটাররা, অর্থাৎ বিভিন্ন বিধানসভার ভোটাররা একবার ভোট দেবেন প্রথম দফায় ১৯ এপ্রিল। আবার ভোট দেবেন দ্বিতীয় দফায় ২৬ এপ্রিল। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অধীর চৌধুরী বা তাঁর নিযুক্ত মুখপাত্ররা যাই বলুক, গান্ধি পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’-এর একজন মহিলা সাংবাদিক শনিবারের সাংবাদিক সম্মেলনে রাজীব কুমারের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, নির্বাচনি আচরণবিধি মানার ক্ষেত্রে তিনি মোদি-শা’কে এক চোখে দেখেন কেন আর বিরোধীদের অন্য চোখে? ওই মহিলা সাংবাদিকের প্রশ্নের ভিডিও ইতিমধ্যেই ভাইরাল।
নির্বাচন কমিশন এবং তার প্রধানকে নিয়ে আলোচনা, কৌতূহলকে অন্য মাত্রা দিয়ে গিয়েছিলেন গত শতকের নয়ের দশকে টিএন শেষণ। ভোটে হাঙ্গামা ঠেকাতে কিংবা ‘বেয়াড়া’ রাজনীতিকদের শায়েস্তা করতে তিনি যেভাবে কোমর বেঁধে ময়দানে নেমেছিলেন, তা শুধু প্রচারমাধ্যমের নয়, দেশের আমজনতারও নজর কেড়েছিল। শেষণের পরে আসেন এমএস গিল, যিনি ব্যালট পেপারের পরিবর্তে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ভারতের নির্বাচনি ব্যবস্থায় নিয়ে আসেন। যে গিলের পরিচালনায় হওয়া নির্বাচন অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ক্ষমতায় এনেছিল, সেই শিখ আমলা পরবর্তীকালে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে রাজ্যসভায় যান এবং মনমোহন সিংয়ের সরকারের মন্ত্রীও হয়েছিলেন। মনমোহন সিংয়ের জমানাতেই দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়া এসএম কুরেশি ওই পদে বসা একমাত্র মুসলিম মুখ ছিলেন। কুরেশি পরবর্তীকালে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পপুলেশন মিথ’ লিখে হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার যে ভারতে মুসলিমদের জনসংখ্যার হার বাড়ছে, তাকে ভোঁতা করে দিয়েছিলেন।
সেইসব দিন এখন অতীত। বিরোধীদের সমস্ত দাবি, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কমিটিতে যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে রাখা উচিত, সেই প্রস্তাব বিজেপির ‘লৌহমানব’ লালকৃষ্ণ আদবানিই দিয়েছিলেন। সেইসব প্রথাকে বদলে দেওয়া আইন এনে নরেন্দ্র মোদির সরকার রাজীব কুমারের পাশে বসার জন্য যে দুজন আমলাকে নিযুক্ত করেছে, তাঁরা আসলেই গত কয়েক বছর ধরে গেরুয়া শিবিরের অ্যাজেন্ডার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জ্ঞানেশ কুমার স্বরাষ্ট্র দপ্তরে থাকাকালীন জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ এবং রাজ্যকে ভেঙে তিনটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করার মুখ্য কারিগর ছিলেন। তারপরে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের হয়ে রাম জন্মভূমি সংক্রান্ত বিষয় দেখভাল করতেন। অধীর চৌধুরীর বক্তব্য অনুযায়ী, লোকসভায় বিরোধী নেতা হিসেবে তিনি নির্বাচন কমিশনার বাছার বৈঠকে হাজির ছিলেন, তাঁকে যে ২১২ জন আমলার নাম দেওয়া হয়েছিল, তা কেন করা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। বিরোধীদের অভিযোগ, গেরুয়া শিবির ঠিকই করে রেখেছিল অমিত শা ঘনিষ্ঠ দুই আমলাকে নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ করে তারা ২০২৪-এর এই মহা গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন করাবে। তাই পশ্চিমবঙ্গ বা বিহারে কেন সাত দফায় ভোট তা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তেজস্বী যাদব যতই হইচই করুন, কেন্দ্র বা নির্বাচন কমিশনের কিছু যায় আসে না। একই শহরের লোক, শিলিগুড়ির নাগরিকরা দু’দফায় ভোট দিলেই বা কী।
(লেখক সাংবাদিক)