- অজন্তা সিনহা
রামি, তিনপাত্তি বা এই জাতীয় ভাগ্য চমকে দেওয়া অনলাইন গেম খেলে নিমেষে কত লাখ টাকার মালিক হওয়া যায়– পর্দায় হাজির হয়ে নামীদামি তারকারা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একথা বলছেন। আর মানুষ রাতারাতি বড়লোক হওয়ার তীব্র বাসনায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেশাগ্রস্তের মতো ব্যস্ত থাকছেন হাতের মুঠোফোনে।
তাঁরা খেলছেন, কদাচিৎ জিতছেন, হারছেনই বেশি। আশাহত হয়ে আবার খেলছেন। এ হল জুয়া খেলার পুরোনো রীতি ও ফলাফল! একইভাবে কোনও বিশেষ পানমশলা বা ইলাইচি খেয়ে কতটা ফুর্তিতে টগবগ করবেন, এইসব যখন তারকাদের মুখে শুনছেন মানুষ, তখন তাঁরা পরিণত হচ্ছেন নেশার দাসে। শুধু নিজের চরম শারীরিক ক্ষতি করছেন তা নয়, যত্রতত্র থুতু ছিটিয়ে পরিবেশকেও দূষিত করছেন।
‘আপনিও হতে পারেন কারও চিত্ততারকা’…একটি জনপ্রিয় গায়ের সাবান ব্র্যান্ডের এই বিজ্ঞাপনে হেমা মালিনী, জিনাত আমন প্রমুখ তারকার মুখ প্রদর্শন আমাদের কৈশোরের চেনা ঘটনা। সুপারস্টার রাজেশ খান্নার ভুবন-ভোলানো হাসিমুখের ছবি টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার–এও অনেকেই দেখেছেন। সাবান, পেস্ট, পোশাক, বিস্কুট ইত্যাদি পণ্যের বিজ্ঞাপনে সিনেমা তারকাদের উপস্থিতি বিপণন ও বিজ্ঞাপনের আদি যুগ থেকেই প্রচলিত। সংবাদপত্র থেকে সিনেমা ও ঘরের টিভির পর্দা হয়ে ডিজিটাল মাধ্যম– যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে পণ্যের বিপণনে তারকা সমাবেশ এখন গগনচুম্বী।
কথা হল, সাবান-পেস্ট-বিস্কুট আর রামি-তিনপাত্তি, পানমশলার বিজ্ঞাপন তো এক নয়! একটি প্রয়োজনের, আর একটি সর্বনাশা। তরুণ প্রজন্মের সামনে সিনেমা তারকারা বরাবরই আদর্শ। পরিসংখ্যান বলছে, পণ্য বিজ্ঞাপনের মডেল হচ্ছেন যেসব সেলেব্রিটি, তার ৮০ শতাংশ আসছেন সিনেমা জগৎ থেকে। হয়তো সকলেই রামি-তিনপাত্তি, পানমশলা ইত্যাদির বিজ্ঞাপনে অংশ নেন না। কিন্তু অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, অজয় দেবগণ, অক্ষয়কুমার, রণবীর সিং প্রমুখ থেকে বাংলার প্রসেনজিৎ সকলেই বিরাট মাপের তারকা।
২০২২ সালে আইপিএল চলাকালীন সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপুল হারে ট্রোল্ড হওয়ার পর অমিতাভ প্রথম সারির পানমশলা প্রস্তুতকারক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি ভেঙে, তাদের থেকে প্রাপ্ত টাকা ফিরিয়ে দেন। হায়, এমন শুভবুদ্ধি যদি অন্যদেরও হত! শোনা যায়, এই তারকাদের অনেকেই প্রচুর চ্যারিটি করেন! সেটা কি তাহলে শুধুই গিমিক, বাজারে ভালো মানুষের ইমেজ তৈরির সস্তা কৌশল? নাহলে কী করে এঁরা ন্যূনতম সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন থাকেন!
স্মার্টফোন আসার পরই শুরু হয়ে গিয়েছে ব্যাপক হারে চরম সর্বনাশের খেলা! সকলেই কোনও না কোনও কারণে সারাদিন অনলাইনে থাকে। অ্যাপ ইনস্টল করা তো মিনিটের খেলা। এসবের জন্য খুব বেশি প্রযুক্তির জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না। এই জাতীয় পণ্য বা গেম নির্মাণকারী সংস্থাগুলির সুবিধা হল, দেশের অগণিত অভাগা আজও সেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যেখানে দাঁড়িয়ে তাঁরা নিজেদের ভালোমন্দ বুঝবেন। আর যাঁরা বোঝেন, সেই তারকারা নিজেদের অর্থের ক্রীতদাসে পরিণত করেছেন, দুর্ভাগ্য এটাই।
(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা। সাংবাদিক)