- শৌভিক রায়
পর্যটনের শহর দার্জিলিংয়ের এই অংশ এতটা ফাঁকা দেখে বিস্মিত হইনি। কেননা আজকাল ট্যুরিস্ট যত বেশি, ট্রাভেলার বা পর্যটক ঠিক ততটাই কম। সেটা না হলে আধুনিক ভারতের মহাপর্যটক রাহুল সাংকৃত্যায়নের দার্জিলিং যোগ ভুলে যাব কেন? কেনই বা চুপিসারে কেটে যাবে ৯ এপ্রিল তাঁর জন্মদিনটি! মৃত্যু দিবসও বাংলা নববর্ষের দিন। সেদিক থেকে দেখলে আক্ষরিক অর্থেই গত সপ্তাহটি রাহুল সাংকৃত্যায়নময়। তবু তাঁকে নিয়ে একটি শব্দও খরচ করিনি আমরা।
অথচ তাঁকে ভারতীয় ভ্রমণকাহিনীর জনক বলা হয়। বাংলা সাহিত্যে উমপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, সুবোধকুমার চক্রবর্তী, শঙ্কু মহারাজের মতো ভ্রমণকাহিনী লেখক এলেও সর্বভারতীয় পর্যায়ে কিন্তু রাহুল সাংকৃত্যায়ন অনেক এগিয়ে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তিনি যে জীবনযাপন করেছেন সেটি সত্যিই একজন পরিব্রাজকের।
তাই উত্তরপ্রদেশের আজমগড় জেলায় জন্মানো মানুষটির মৃত্যু হয় দার্জিলিংয়ে! মাঝের দিনগুলিতে তিনি ঘুরে বেড়ান এই দেশের কাশ্মীর, লাদাখ। চলে যান নেপাল, তিব্বত, চিন, সোভিয়েত রাশিয়া। প্রথম জীবনে আর্যসমাজের দয়ানন্দ সরস্বতীর একনিষ্ঠ অনুগামী হয়েও পরবর্তীতে কমিউনিস্ট বলে পরিচিত হন। আবার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে ত্যাগ ও মোক্ষের পথ অনুসন্ধান করেন। এই টানাপোড়েন তো প্রকৃত পর্যটকের সঙ্গী। একমাত্র অবলম্বন।
মহাপণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের জীবন তাই বিরাট বিস্ময় আজও। শ্রীলঙ্কায় অধ্যাপনা ছেড়ে দার্জিলিংয়ে ফিরে আসা মানুষটির কাছারি রোডের বাড়িটিও এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা। আর আমরা যারা বেড়াতে যাই তারা তো সীমাবদ্ধ থাকি নির্দিষ্ট কিছু দ্রষ্টব্যে। সেখানে রাহুল সাংকৃত্যায়নের স্মৃতি কিংবা দেশবন্ধুর বাড়ি স্টেপ এসাইড কিছুই জায়গা পায় না।
প্রজন্মকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যদি তাদের জানানো না হয়, তবে তারা অজ্ঞই থাকবে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের সমাধি স্থানের কথাই ধরা যাক। একটু লক্ষ করলেই সিস্টার নিবেদিতার সমাধি ফলকটিও চোখে পড়ে। কলকাতার বাগবাজারের তাঁর বাড়িটি দেখে থাকলেও আমরা অধিকাংশই জানি না, উত্তরের এই শৈলশহরই ছিল তাঁর শেষ আশ্রয়। এখানেই হিমালয়ের শান্ত সমাহিত পরিবেশে তাঁর অন্তেষ্ট্যি করা হয়েছিল। তাঁরও ছিল পরিব্রাজকের জীবন। সেই কোন আয়ারল্যান্ড থেকে আসা ভিনদেশি নিবেদিতা রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতোই আশ্রয় নিয়েছিলেন এই উত্তরে। কিন্তু আমরা কি সেসবের খোঁজ রাখি?
আবার, চা বাগান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ইউরোপ থেকে যে তরুণরা টি প্ল্যান্টার হিসেবে একদিন বদলে দিয়েছিলেন উত্তরের অর্থনীতি, তাঁদের কথা কি আমরা বলেছি কখনও? যদি বলতাম তবে মালবাজারের রাঙ্গামাটি চা বাগানের চাইবাসা ডিভিশনের ইউরোপিয়ান কবরস্থানটির ওই দৈন্যদশা হত না। অথচ ওখানে লুকিয়ে কত ইতিহাস। একই কথা বলা যায়, কালিম্পংয়ের ডঃ গ্রাহাম সহ উত্তরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন সমাধিক্ষেত্র সম্পর্কে। সেগুলিতে যাঁরা শায়িত, উত্তরের বিকাশের ক্ষেত্রে, তাঁদের অবদান কিন্তু গবেষণার বিষয়।
পর্যটন হোক প্রকৃত অর্থে। সেলফি আর রিল বানানো যে পর্যটনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয় সেটা বুঝুক এই প্রজন্ম। আমাদেরও উচিত দায়িত্ব নিয়ে তাদের বোঝানো। তা না হলে ঘন অন্ধকারেই ঢেকে থাকবে আলোকিত এক অতীত।
(লেখক কোচবিহারের বাসিন্দা। পেশায় শিক্ষক)