Tuesday, April 30, 2024
Homeকলামপ্রেমের মাসে নাগরিকের লাঞ্ছনা ও অসম্মান

প্রেমের মাসে নাগরিকের লাঞ্ছনা ও অসম্মান

  • গৌতম সরকার

দিগন্ত রঙিন অশোকে পলাশে। বসন্ত জাগ্রত দ্বারে…। বাজারময় গোলাপ। বন রাঙা আগুনে পলাশে। চারদিকে ভালোবাসার আয়োজন। হায় রে কপাল, এসব অর্থহীন মনে হয় আশপাশে শুধু বিদ্বেষের ছবি দেখলে। কৃষকদের আটকাতে পথে পেরেক পোঁতা। রাস্তা কাটা। কাঁটাতারের বেড়া, কংক্রিটের শক্ত স্ল্যাবে প্রতিরোধে কোথায় ভালোবাসা? সদ্য বাজেট পেশ হয়েছে কেন্দ্রে। রাজ্যেও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখে অমৃতবাণী শুনেছি, মহিলা, যুব, দরিদ্র ও কৃষকের স্বার্থে এই বাজেট।

স্বার্থ যদি সুরক্ষিতই হবে, তাহলে কৃষক পথে কেন? ওঁরা নাকি অন্নদাতা। ওঁরা ফসল না ফলালে আমাদের একবেলার খাবার মিলবে না। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান শুধু নয়, ‘সবুজ বিপ্লবে’র জমি পঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকরা দিল্লি এগোনোর চেষ্টা করছেন। ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্য চান তাঁরা। এগোচ্ছেন নিজেদের ট্যাঁকের টাকায় ট্র্যাক্টরে, গাড়িতে অথবা স্রেফ হেঁটে। কতদিন পথে থাকতে হবে জানেন না। তাই খাওয়া-পরার রসদ এনেছেন নিজেদের রক্ত-ঘামে উপার্জিত অর্থ খরচ করে।

শান্তিপূর্ণ সেই মিছিলে ড্রোন থেকে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার নাম নিশ্চয়ই কৃষক প্রেম নয়। কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষাও নয়। জলকামানের তীব্র গতি যখন ভিজিয়ে দিচ্ছে কাস্তে-কোদাল ধরা শরীরগুলিকে, তখন কি ওঁরা আদৌ উপলব্ধি করছিলেন সরকার তাঁদের জন্য কতটা চিন্তিত? সর্বশেষ যা শুনলাম, তাতে গায়ে কাঁটা দিল। সহনশীলতার চেয়ে অনেক উচ্চগ্রামে শব্দ শুনিয়ে কৃষকের প্রাণ জেরবার করার যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। তাতে কেউ বধিরও হয়ে যেতে পারেন।

প্রেমের মাসে এর চেয়ে হিংসার উদাহরণ আর কী হতে পারে? এরপর কৃষকের কথা বলে মোদিজির চোখের জল ফেলা মনে দাগ কাটে না। বরং সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের কৌশল মনে হয়। রাজ্য বাজেটে নাকি নজর মহিলাদের ওপর। বড় মুখ করে বলছেন রাজ্যের মন্ত্রীরা। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের বরাদ্দ বেড়েছে। হোক না যৎসামান্য। গরিবের পরিবারে ১০ টাকারও যে দাম অনেক।

সেখানে ঘরের লক্ষ্মীদের মাসিক ভাতা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাতা বাড়লেই কি নারীর সম্মান রক্ষা পায়? রাজ্যজুড়ে নারী নির্যাতনের শেষ নেই। গত এক সপ্তাহে খবরের কাগজে শুধু উত্তরবঙ্গে প্রতিদিন কোনও না কোনও জায়গায় এ রকম হেনস্তার খবর যে কত ছাপা হয়েছে, তার ফিরিস্তি অনেক লম্বা। সন্দেশখালিতে যৌন হেনস্তার কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ না পাওয়া গেলেও রাতবিরেতে নেতাদের নির্দেশে নির্দিষ্ট ঠিকানায় মহিলাদের যেতে হত বলে অভিযোগ উঠেছে।

প্রথমে রাজ্য পুলিশের এক্স হ্যান্ডেলে, পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা ভাষণে অবশ্য বলা হয়েছে, যত দোষ নন্দ ঘোষ সংবাদমাধ্যমের একাংশের। পুলিশ এজন্য কড়া পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে। হায় রে ভালোবাসার মাস। মনে প্রশ্ন জাগে, না হোক যৌন হেনস্তা, এই যে নেতাদের মন রাখতে রাতে মহিলাদের বাইরে বেরোনো, সেটা কি অভিপ্রেত? অনেকটা আগের দিনের কিছু রাজরাজড়া বা সম্রাটদের মতিগতির মতো নেতাদের আচরণ।

লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ভাতায় কি সেই অসম্মান ঢাকা যায়? বাঙালির প্রেম দিবস বসন্তপঞ্চমী ও বিলিতি মতে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পার হল সবে। শুধু যুগলের ভালোবাসাই তো ভালোবাসা নয়। জীবে প্রেম করে যেইজন… এই পংক্তিটার সার্থকতা কোথায় তাহলে? আমরাও যেন দু’কান কাটা। নির্লজ্জ, বেহায়া। কেমন নির্বিবাদে সয়ে চলেছি সব। গন্ডারের চামড়া যেন আমাদের।

অভিনেতা দেব আসন্ন ভোটে লড়বেন কি লড়বেন না, তা নিয়ে কত চর্চা করি আমরা। তিনি না থাকলে তৃণমূলের কী ক্ষতি হবে, সেটা সেই দলের ব্যাপার। আমাদের মতো পাঁচ পাবলিকের কিছু আসে যায় না তাতে। অভিনেত্রী সাংসদ মিমি চক্রবর্তীকে নিয়েও আমাদের মাথাব্যথার শেষ নেই। যেন তিনি আবার সাংসদ না হলে, রাজনীতিতে না থাকলে আমাদের চরম ক্ষতি হবে। তৃণমূলেরই বা কী এমন ক্ষতি হবে বলুন তো?

অথচ কৃষক আন্দোলনে বলপ্রয়োগ, সন্দেশখালিতে তৃণমূলের কিছু নেতার স্বেচ্ছাচারে আমাদের মুখে কুলুপ। যা কিছু কথা, ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় রাজনৈতিক দলগুলি সংকীর্ণ স্বার্থে একে অপরের বিরুদ্ধে বলে। বিজেপি বলে কখনও কংগ্রেস, কখনও তৃণমূলের বিরুদ্ধে, তৃণমূল বলে বিজেপি, সিপিএমের বিরুদ্ধে। আমরা চুপ। শিলিগুড়িতে মেয়র গৌতম দেবের ওয়ার্ডের একাংশ প্রায় দেড় মাস নির্জলা। গৌতম ওয়ার্ডবাসীর উদ্দেশে ক্ষমা চেয়েছেন, তাও মাস গড়াতে চলল। পরিস্থিতি ন যযৌ, ন তস্থৌ।

এরপরেও বলতে হবে নাগরিকদের প্রতি ভালোবাসা আছে প্রশাসনের, জনপ্রতিনিধিদের? আমাদের আমজনতার মুখে আঙুল। প্রতিবাদের দৌড় বড়জোর ‘টক টু মেয়র’ পর্যন্ত। অন্য দলগুলি এই সমস্যায় পথে নামেনি। কাকে ভরসা করব আমরা বলুন তো? আমরা প্রেম দিবসে এত হুল্লোড় করি। আমাদের প্রতি যে সরকার, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিরা প্রেমহীন, ভাবি কি একবার? আবার একটা ভোট হবে। দরদ উথলে উঠতে শুরু করেছে।

ন্যূনতম মজুরি ঠিক করার বালাই নেই, ডুয়ার্সে চা শ্রমিকদের একতা যাত্রা করার উদ্যোগ নিয়েছে তৃণমূল। বিজেপি নাকি সন্দেশখালিকে নন্দীগ্রাম বানিয়ে দেবে। বড় হাসি পায়। নন্দীগ্রাম ছিল আন্দোলন। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ। সন্দেশখালি হয়ে যাচ্ছে ভোটের অস্ত্র। এত তাগিদ যে, খুন-রক্তারক্তির মতো কিছু না হলেও নন্দীগ্রাম বানানোর ঘুঁটি সাজাতে জগৎপ্রকাশ নাড্ডার তৈরি টিম তড়িঘড়ি পৌঁছে গিয়েছে বাংলায়। মানুষের প্রতি প্রেমের টানে নয়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রয়াসে অশান্তি জিইয়ে রাখা। ভালোবাসার মাসে প্রহসন যেন।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Heatwave | তাপপ্রবাহের কারণে পশ্চিমবঙ্গ সহ ৪ রাজ্যে জারি রেড অ্যালার্ট

0
নয়াদিল্লি: তাপপ্রবাহের কারণে ৪টি রাজ্যে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, ওডিশায় লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। অন্যদিকে, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক, সিকিমের কিছু...

0
১। প্রকাশ্যে দিবালোকে নদীর বুকে একাধিক শ্যালো মেশিন লাগিয়ে গাড়ি গাড়ি চুরি হচ্ছে বালি কুমারগঞ্জ: নির্বাচন ঘোষণার আগেই জেলা জুড়ে নদীর বালি চুরি আটকাতে ব্যাপক...

‘বাইনারি’ তত্ত্বে ব্যর্থতা ঢাকা যাবে তো কমরেড!

0
  আশিস ঘোষ এক-একটা ভোটে এক-একটা কথা অনেক কথার ভিড় ঠেলে সামনে আসে। অনেক শব্দ। একদা ‘গরিবি হটাও’ থেকে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’, ‘অচ্ছে দিন’ থেকে...

প্রতিবাদের রাজপথে আর নেই নাগরিকরা

0
  অমল সরকার ক’দিন আগে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একজন পুরোনো একটি রশিদের ছবি দিয়ে  ১৯৬৬ সালে চার চাকা গাড়ি এবং পেট্রোলের দাম উল্লেখ করলেন। উৎসাহ পেয়ে...

সংকোশপারের সংকটে সীমান্তের বাঙালিরা

0
  ধ্রুব গুপ্ত হিমালয় থেকে নেমে আসা নীলবর্ণ সংকোশ নদী বাংলা আর অসমের সীমানার সঙ্গে বারবার লুকোচুরি খেলতে খেলতে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে। সে নদীর কোনও অংশকে...

Most Popular