- রন্তিদেব সেনগুপ্ত
কার্সিয়াং শহরে সেদিন একটি বোর্ডে সাঁটা ফ্লেক্স চোখে পড়ল। ভোটের মরশুমে সদ্য লাগানো। ফ্লেক্সে দুজন প্রান্তিক শ্রেণির গ্রামীণ মানুষের ছবি। পুরুষ এবং মহিলা। হাসি হাসি মুখ তাঁদের। ছবির নীচে হিন্দিতে লেখা স্লোগান। যার বাংলা মানে করলে এরকম দাঁড়ায়- ভোট দেওয়াটা আমার অধিকার। এই অধিকার নষ্ট করব না।
ওই ফ্লেক্সটি দেখে কয়েক বছর আগের অভিজ্ঞতা মনে পড়ল। সেবার ভোটের মরশুমে উত্তরপ্রদেশ গিয়েছি ভোটের খবর সংগ্রহ করতে। বেজায় গরমে ঘেমেনেয়ে মথুরা যাওয়ার হাইওয়ের অদূরে গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি। গ্রামে উচ্চবর্গের সঙ্গে বেশ কয়েক ঘর নিম্নবর্গের মানুষও থাকেন। ভোটে তাঁদের সমর্থন কোন দিকে জিজ্ঞাসা করায় ওই নিম্নবর্গের মানুষজন বেশ কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে শহর থেকে আসা এই সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর প্রবীণ একজন আমতা আমতা করে বলেছিলেন, ‘আসলে আমরা তো ভোট দিই না।’
কেন? বয়কট করেন নাকি ভোট? প্রবীণ মানুষটি বলেছিলেন, ‘না। ভোট তো দিতেই চাই আমরা। কিন্তু ভোট দিতে পারি না।’ ধন্দ লেগেছিল আমার মনে। ফের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন ভোট দিতে পারেন না? এবারের উত্তর, ‘ওই ওরা দিতে দেয় না তো। ভোটের আগের দিন ওদের লোকেরা আমাদের মহল্লা ঘিরে রাখে। বন্দুক থাকে ওদের হাতে। আমাদের ভোট দিতে যেতে দেয় না।’ ইঙ্গিতটা ছিল গ্রামের উচ্চবর্গের মানুষজনের দিকে।
বেশ কয়েক বছর আগে যেতে হয়েছিল মালদার হরিশ্চন্দ্রপুরের কাছে একটি গ্রামে। ভোট আসতে তখন কিছুটা বাকি ছিল। নদীভাঙনে ওই গ্রামের বেশ কিছু মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে পিচ রাস্তার ধারে অস্থায়ী ত্রিপলের ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন তখন। ক্ষুব্ধ, অসহায় ওই মানুষজন বলেছিলেন, ‘বছর বছর ভোট তো দিই। কিন্তু আমাদের যে সব কিছু চলে গেল, এটার জন্য কে জবাব দেবে?’ ওইখানে নদীর পাড়ে বোল্ডার ফেলার দায়িত্বে যে ঠিকাদার ছিল, সে কনট্রাক্ট অনুযায়ী বোল্ডার ফেলার বদলে সামান্য কিছু বোল্ডার ফেলে পুরো টাকা নিয়ে নিয়েছিল সরকারি কোষাগার থেকে। এ-ও শুনেছিলাম, ওই ঠিকাদার এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।
আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি বেশ মজার। এখানে সবার একটি করে ভোটাধিকার। আদানি-আম্বানি-টাটা-বিড়লা-গোয়েঙ্কার যেমন একটি করেই ভোট, হরিপদ কেরানিরও তেমনই একটি ভোট। পুরোপুরি সাম্যবাদ আর কী। ভোটের দিন সকালে কোন সেলেব্রিটি কোথায় ভোট দিলেন, কীভাবে ভোট দিলেন, সেই ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাম্যানদের হুড়োহুড়ি। ক্যামেরার সামনে সেলেব্রিটিদের ভোটের কালি মাখানো আঙুল তুলে হাসিমুখের পোজ।
সরকারি তথ্যেই প্রকাশ, কোভিডের সময় বারো কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছিলেন। এঁদের ভিতর একটি বড় অংশ আর চাকরি পাননি। এঁদের অনেকেরই সামাজিক অবস্থানে অবনমন হয়েছে। এক মানুষকে পেলাম, যিনি আর চাকরি খুঁজে পাননি। তাঁর স্ত্রী সামান্য একটি চাকরি করেন। মধ্যবিত্ত থেকে তাঁর সামাজিক অবস্থান এখন নিম্নমধ্যবিত্তে। তাঁর এই অবস্থানটি তিনি একটি কথায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আগে মাসে দু’দিন বাড়িতে মাংস আসত। এখন আসে না। সপ্তাহে একদিন মাছ, একদিন ডিম। বাকি পাঁচদিন নিরামিষ।’
কলকাতার কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের পাশে রোজ দুপুরে সরকারি উদ্যোগে পাঁচ টাকার ডিমভাত বিক্রি হয়। সেখানেই একদিন একটি দৃশ্য আমাকে স্তব্ধ করেছিল। রীতিমতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চেহারার মধ্যবিত্ত গোছের একজন মানুষ পাঁচ টাকার ডিমভাত কিনে ভিড়ের থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন। এর বেশি কিনে খাওয়ার সংগতি তাঁর এখন নেই। কিন্তু সামাজিক অবনমনটিও তাঁর কাছে অস্বস্তির, লজ্জার। তাই মুখ লুকোতে হচ্ছে।
সুভাষ চক্রবর্তী ছিলেন সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। সেই সময় সুভাষ চক্রবর্তীর নির্বাচনি প্রচার ছিল দেখার মতো। অত জেল্লা সেই সময় আর কোনও বামপন্থী নেতার প্রচারে ছিল না। সুভাষবাবুকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘প্রচারের এই বিপুল খরচ জোগায় কারা?’ উনি নির্বিকারভাবে বলেছিলেন, ‘ভূতে।’ সুভাষবাবুদের সেই যুগ গিয়েছে। এখনকার প্রচারে তার দশগুণ জেল্লা। ব্যানার-ফ্লেক্স- পোস্টার-হোর্ডিং এসব তো আছেই। আছে গ্লো সাইনবোর্ড। এই বিপুল খরচ জোগায় কে? সহজ উত্তর- ভূতে।
নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের ভিতর তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এমন মহিলারও সন্ধান পেয়েছি, যাঁর স্বামীর তেমন মাসিক আয় নেই। তিনি উত্তর কলকাতায় হাতিবাগানের ব্লাউজের দোকানে অর্ডার নিয়ে ব্লাউজ বানিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করেন। অনেক সময়ই ব্লাউজের দোকানের মালিকরা সময়মতো মজুরিটুকুও তাঁকে দেন না। মালদা-মুর্শিদাবাদ, এমনকি বিহার-উত্তরপ্রদেশের গ্রাম থেকে অনেক মানুষ অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে চলে যান। এখন তো দেখা যাচ্ছে নিজের দেশে কোনও কাজের সন্ধান না পেয়ে বিপদ মাথায় নিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেনেও দালাল ধরে চাকরি করতে চলে যাচ্ছে এদেশের বেকাররা। অসহায় সেসব তরুণকে জোর করে যুদ্ধ করতে পাঠাচ্ছে বিদেশি রাষ্ট্র। এই সব পরিযায়ী কর্মীর কেউ কেউ দেশে ফেরে। কেউ কেউ ফেরেই না।
এই সেদিন সমাজমাধ্যমে একটা কার্টুন দেখছিলাম। এক প্রার্থী হাতজোড় করে ভোট চাইতে গিয়েছেন। ভোটাররা তাঁকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘গতবার তো আপনি ওই দলের হয়ে ভোট চাইতে এসেছিলেন। এবার আপনি কোন দলে।’ ঠিকই তো। আপনি যাকে যে দলের প্রার্থী ভেবে ভোট দিলেন তিনি যে পাঁচবছর সেই দলেই থাকবেন এমন গ্যারান্টি তিনি দিচ্ছেন না। তিনি যে কোনও দিন অন্য দলের হয়ে খেলতে চলে যেতে পারেন। এই দলবদলের জন্য শোনা যায়, কোটি টাকার বেশি হাতবদল হয়। কে জোগায় এই টাকা। উত্তর, ভূতে।
ভোট আসছে। আপনি ভোট দেবেন। আমি ভোট দেব। কাজ হারিয়ে যে বেকার হয়েছে সে ভোট দেবে। কোভিডকালে কাজ হারিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বেঘোরে প্রাণ গেল যে পরিযায়ী শ্রমিকটির, তার অকাল বিধবা বৌটি ভোট দেবে। যে সমাজের সকলের থেকে মুখ লুকিয়ে পাঁচ টাকার ডিমভাত খেয়ে এল সে-ও ভোট দেবে। এই গণতন্ত্রে আমাদের সকলের সমানাধিকার। কি কিউট না!