- সৌমিত্র দস্তিদার
মাওবাদী রাজনীতি বলতেই চোখের সামনে যে চিত্রকল্প ভেসে ওঠে, তা ভয়ংকর এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। হাতে অস্ত্র নিয়ে ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে সরকার কর্পোরেট মিডিয়ার সাহায্যে এই ছবি এমনভাবে জনমনে ছড়িয়ে দিয়েছে যে, তাঁদের নির্বিচারে সরকার খুন করলেও বিপুল সংখ্যক মানুষ চুপ করে থাকেন। প্রশ্ন তোলেন না বুদ্ধিজীবীরাও। দু’একজন এক-আধবার প্রশ্ন তুললেই রাষ্ট্র তাঁদের মিথ্যে মামলায় জেলে ঢুকিয়ে দিয়ে একই সঙ্গে তাঁদের মুখ বন্ধ করে এবং অন্যদের বার্তা দেন ট্যাঁ-ফোঁ করলেই তোমার পরিণতিও একই রকম হবে। সোমা সেনের মতো খ্যাতিমান অধ্যাপককেও বছরের পর বছর জেলে রাখা হয়, তিনি নাকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খুনের ষড়যন্ত্রে যুক্ত। এসব যে মিথ্যা তা শিশুও বোঝে। কিন্তু ভয়ে কেউই সেভাবে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন না।
এই ভয়ের সংস্কৃতি নির্মাণ এই কয়েক বছরে মোদি সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব। ফলে এক বছরে তথাকথিত এনকাউন্টারে একশোর কাছাকাছি মাওবাদীর মৃত্যু হলেও, দেশের ভোট ও অন্যান্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উত্তেজনায় তা নিয়ে সামান্যতম আওয়াজ কেউ তোলেন না। সংবাদমাধ্যমে খুব ছোট করে পুলিশকে উদ্ধৃত করে খবর বের হয়, কখনও বস্তারে, কখনও দণ্ডকরণ্যের অন্য কোথাও ভয়ংকর মাওবাদীদের পুলিশ বা আধাসামরিক বাহিনী, আত্মরক্ষার স্বার্থে মেরে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। তারাই সর্বদা প্রথম আক্রমণ করে, তা রুখতে বীর জওয়ানরা পালটা আক্রমণে গিয়ে সাফল্য পান।
কাঁকের, গীদম, দান্তেওয়াড়া, গড়চৌলি, কেশকালঘাঁটি, বিস্তৃত অঞ্চলে, যেখানে মাওবাদীদের সঙ্গে পুলিশ, বিএসএফের ‘এনকাউন্টার’ ইদানীং রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেসব এলাকা আমি চিনি। দণ্ডকরণ্যের পাহাড়, জঙ্গল, নদী ছবির মতো সুন্দর। ভারতের অন্যতম প্রাচীন এই জনপদের উল্লেখ আছে বাল্মীকির রামায়ণেও। দেশের আদিম গোণ্ড জনজাতির ধাত্রী ভূমি। এই সেই গোণ্ডয়ানা ল্যান্ড। যা একদিন ভারত ভূখণ্ডের মানচিত্র বদলে দিয়েছিল। কথিত আছে যে দান্তেওয়াড়া হিন্দুদের একান্নপীঠের অন্যতম। এখানে দেবীর দাঁত পড়েছিল। যদিও আদিবাসী লোকবিশ্বাস, এ দেবী তাঁদের।
কয়েক দশক ধরে যে এলাকা মাওবাদী অধ্যুষিত। যেখানে এনকাউন্টার, ফেক এনকাউন্টার, মৃত্যু, সন্ত্রাস নিত্যদিনের ব্যাপার। খুব কাছ থেকে এই ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ এলাকাকে দেখেছি বলে বহুবার, বহু জায়গায় বলি, মাওবাদী রাজনীতির আড়ালে এ নিঃসন্দেহে আদিবাসী বিদ্রোহ। যা দমন করতে মোদি সরকার সর্বশক্তি দিয়ে নেমেছে বলেই দিনকে দিন রক্ত ঝরছে বস্তার দণ্ডকরণ্যের জঙ্গলে, পাহাড়ে। এমনিতেই কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে জল-জঙ্গল জমি থেকে আদিবাসী উচ্ছেদ সরকারি নীতি। আর ছত্তিশগড়, ওডিশা, মহারাষ্ট্রের বিস্তৃত এই এলাকায় তো খনিজ সম্পদের বিপুল প্রাচুর্য। আদিবাসী দমনে সরকারের কঠোর নীতি সংঘাত তীব্র করছে এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মাওবাদী শায়েস্তা করতে আকাশ থেকে বোমা ফেলা, কোনওমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাতে তথাকথিত মাওবাদীদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণ বিপন্ন হবে তা বলাই বাহুল্য। নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কোনও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হতে পারে না।
(লেখক তথ্যচিত্র পরিচালক)