Monday, May 6, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়একসঙ্গে ম্যাজিক দেখাতে পারলেন না ওঁরা

একসঙ্গে ম্যাজিক দেখাতে পারলেন না ওঁরা

  • পি সি সরকার

আমার কাকা অতুলচন্দ্র সরকার পরিচিত ছিলেন জাদুকর এ সি সরকার নামে। আমার কাকা বলে বলছি না, সত্যিকার হিসেবে খুবই উঁচুমানের জাদুকর ছিলেন উনি। অসাধারণ ছিল কণ্ঠস্বর। ইংরেজি উচ্চারণ করতে পারতেন সাহেবদের মতো করে। আকাশবাণী দিল্লি থেকে ইংরেজিতে খবর পড়বার জন্য বারবার অনুরোধ এসেছিল ওঁর কাছে। নাক দিয়ে গিটারের আওয়াজ করে বাজাতেন কাকা। চোখ বুজে শুনলে মনে হত সত্যিকারের গিটার বাজছে। বাবার চেয়ে ষোলো বছরের ছোট ছিলেন তিনি। ছোটভাই। রাশভারী বাবাকে দেখতাম ছোটভাইয়ের ব্যাপারে বেশ দুর্বল। কাকা যখন বড় হলেন বাবা তখন মধ্যগগনে। নানা রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও ম্যাজিক ছাড়া কাকার পক্ষে অসুবিধে ছিল।

রসিক ছিলেন তিনি। কথায় কথায় রসিকতা করতে পারতেন। আমাকে ডাকতেন পটেশ বলে। ছেলেবেলায় আমি একটা দশ পয়সা হাতের মধ্যে থেকে অদৃশ্য করে পকেট থেকে বের করতাম। উচ্চারণগত ত্রুটির জন্য মুখ দিয়ে বেরোত ‘পটেশ থেকে পয়সা বেরোবে।’ পকেটটা পটেশ হয়ে যেত। সেজন্য কাকা আমাকে ডাকতেন পটেশ বলে। এখনও মনে আছে পটেশবাবু ডাকটার মধ্যে কেমন যেন একটা স্নেহ, একটা ভালোবাসার স্পর্শ পেতাম।

আমরা বেশ সুখেই ছিলাম। বাবা-কাকা একসঙ্গে ম্যাজিক করতেন। মায়ের পরামর্শে কাকাকে তাঁর স্টেজ ম্যানেজার করে নিলেন বাবা। কাকা বাবার সঙ্গে বিদেশ চলে গেলেন। মাসকয়েক পর দুজনে যখন ঘরে ফিরলেন, দুজনের মুখই গম্ভীর। আসলে এক আকাশে যেমন দুটো সূর্য ওঠে না তেমনই প্রতুলচন্দ্র আর অতুলচন্দ্র একসঙ্গে ম্যাজিক দেখাতে পারলেন না। কাকা দেখলেন, যতই তিনি তাঁর শিল্পের পরিচয় দিন না কেন, প্রত্যাশিত খ্যাতি, গ্ল্যামার কিংবা জনপ্রিয়তা তাঁর ভাগ্যে ঠিকমতো জুটছে না। আমাদের সমাজে দুর্বুদ্ধি দেওয়ার অভাব নেই। বেশ কিছু মানুষ জুটে গেল, যারা ক্রমাগত কাকাকে বোঝাতে লাগল, আপনি পি সি সরকারের গ্রুপ ছেড়ে দিন। আপনি কারও চেয়ে কম নন। পি সি সরকারের সঙ্গে থাকলে আপনি কোনও দিনই স্বাধীন হতে পারবেন না। আপনি কত বড় ম্যাজিশিয়ান তা লোকে বুঝবে না। অতএব যা ভবিতব্য তাই হল। প্রথমে মতান্তর, তারপর মনান্তর হল।

কাকা সেলিমপুরে বাড়ি করে চলে গেলেন। কাকা চলে যাওয়ার পর জগৎটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেল। বাবা আমাদের যত প্রিয় হোক, এত রাশভারী ছিলেন যে, একটু দূরত্ব থাকতই। কাকার সঙ্গে ওই দূরত্ব ছিল না। আমি তখন স্কুল ফাইনাল পাশ করে গেছি। একা একা শো করছি। শুনছি, বাবা লোক-টোক পাঠাচ্ছেন আমার শো দেখতে। এরকম সময় একদিন কাকার সঙ্গে দেখা। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সেই প্রথম।

‘তোরা তো আর আমাদের বাড়িতে যাবি না।’ কাকার এই কথাটুকুর মধ্যে কী ছিল জানি না! বাড়িতে এসে চিৎকার করে সবাইকে বললাম, ‘কাকার বাড়িতে কাল আমাদের সবার নেমন্তন্ন।’ মা তো কেঁদেই ফেলল। গেলাম আমরা সেলিমপুরে। আমি আর মা। জেঠিমা এসেছে দেখে নীতা-শিবানী-নানু-শঙ্কররা হইচই বাঁধিয়ে ফেলল। আমার কাকিমার নাম আলোরানি। ঠাকুমা তখনও বেঁচে। ঠাকুমা কিন্তু নিয়মিত যেতেন। কিন্তু মা সেই প্রথম। স্বাভাবিকভাবেই সবার মধ্যে বেশ খুশি খুশি ভাব। দুই পরিবারের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কের শুরু আবার। কিন্তু বাবা-কাকার মধ্যে সম্পর্ক আর সেভাবে স্থাপিত হল না। এমনকি আমার বড়দিদি ইলার বিয়েতেও নয়। দিদির বিয়ের দিন সকাল থেকে বাড়ি মাত করে ফেললেন কাকা। সব ব্যাপারে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। ‘ইলু’র বিয়ে বলে কথা। কিন্তু লক্ষ করলাম, বাবা আর কাকা মুখোমুখি হলে একে অপরকে যেন দেখেননি এমন ভাব করে পাশ কাটিয়ে যেতে ব্যস্ত। দুজনেই কাঠ বাঙাল তো! কে আগে কথা বলবে? কেউই ভাঙতে চাইছেন না। দুজনের মুখ দেখলেই বোঝা যায়, কথা বলবার জন্য পাগল। কিন্তু বাক্যালাপ শুরু হল না।

বাবা-কাকা, দুজনেই আর ইহলোকে নেই। পরবর্তীকালে এই নিয়ে অনেক ভেবেছি। আসলে স্বভাবশিল্পীদের একটা স্বাভাবিক স্বাভিমান থাকে। সেটার উৎপত্তি আত্মবিশ্বাস থেকে। কাকা নিজে জানতেন, তিনি কত বড় জাদুকর। কাকার এই গুণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বাবাও। তবে প্রতিভা অনুযায়ী সাফল্য পাননি কাকা। সবকিছু ছিল তাঁর। কিন্তু কীসের অভাবে পি সি সরকারের ম্যাজিকের মধ্যে তফাত হত, তা বুঝে ওঠা মুশকিল। এমন নয় যে দুজনে দু’রকম ঘরানার ম্যাজিশিয়ান। একই ঘরানার। একই পরম্পরা। তবু এই অসাফল্যই দুজনের সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছিল। হয়তো সেজন্যই কাকার একমাত্র ছেলে শঙ্কর প্রচুর গুণ থাকা সত্ত্বেও জাদুবিদ্যাকে পেশা করেনি। বাবা-জ্যাঠার ম্যাজিকের গুণ, সাহিত্য অনুরাগ কিংবা সুকণ্ঠ সবই পেয়েছে শঙ্কর। ও প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। আমার দাদুর খুব শখ ছিল তাঁর দুই ছেলের মধ্যে একজন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু দুজনেই হলেন ম্যাজিশিয়ান। পরের প্রজন্ম অবশ্য দাদুর ক্ষোভ খানিকটা কমিয়েছে। আমার দাদা ইঞ্জিনিয়ার। শঙ্কর ডাক্তার।

কাকা আলাদা হয়ে চলে যাওয়ার পর, আগেই বলেছি, আমার অনুসন্ধানী সত্তা খানিকটা ধাক্কা খেল। কাকার সঙ্গে নানা বিষয়ে আমার আলোচনা হত। বাবার কাছে যা পেতাম না, তার কিছু কিছু উশুল করতাম কাকার কাছ থেকে। কিন্তু ম্যাজিকের জগতে ঢুকেই বুঝতে পারলাম, কাকার কাছ থেকে শুধু বাবা নয়, আমিও অনেক দূরের মানুষ হয়ে গেছি। কাকার সঙ্গে আমার মনোভেদ! আমি ভাবতেও পারিনি। বাবার সঙ্গে যা ছিল ছিল, আমার সঙ্গে তোমার রাগ কেন? আর এত রাগ চড়ে যাওয়ার কী আছে!

স্বীকার করছি, তখন কাকাকে আমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছি। এই চিন্তার শুরু আমার দিক দিয়ে নয়। নিউটনের থার্ড ল’ অফ মোশন-টু এভরি অ্যাকশন, দেয়ার ইজ অ্যান ইকুয়াল অ্যান্ড অপোজিট রিঅ্যাকশন! আমার প্রতি কাকার অ্যাকশনগুলো রিঅ্যাকশন বা প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমার গা থেকে ঠিকরে বেরোতে লাগল। কী অদ্ভুত পরিস্থিতি! মহাভারতের ধর্মযুদ্ধের মতো। বুকে আমার নিখাদ শ্রদ্ধা, কিন্তু রক্তে টগবগ করছে প্রতিশোধ নেবার কাঁপুনি। জাদুকর প্রদীপচন্দ্র সরকারের সঙ্গে এবার শুরু হল জাদুকর অতুলচন্দ্র সরকারের লড়াই। লড়াই বলতে কাকাকে ছাপিয়ে যাওয়ার লড়াই। আমি চিরকালই অতুলচন্দ্রকে খুব বড় জাদুকর ভেবে এসেছি। আজও ভাবি।

আমার তখনকার শোগুলো কীরকম হচ্ছে, তা জানার জন্য বাবা লোক পাঠাতেন। ওরা গোপনে শো দেখে এসে রিপোর্ট দিত এবং বাবার সহকারীদের চোখের দৃষ্টিতেই আমি বুঝতে পারতাম কীরকম করছি! মনে মনে ভাবতাম, আমি বড় জাদুকর। কিন্তু আবার এও ভাবতাম, বড়ই যদি হব, তাহলে আমার শো করার জন্য লোক আসছে না কেন! কিশোর মনের মধ্যে উঁকি দিল, প্রচার চাই, প্রচার। কিন্তু কীভাবে প্রচার করব? আমি যে ম্যাজিক পারি, ম্যাজিক বুঝি, তার জানান দিতে হবে। কিন্তু বিজ্ঞাপন দিতে তো প্রচুর টাকা দরকার। আর আমার হয়ে বলারও কেউ নেই। ঠিক করলাম ম্যাজিকের ওপর লেখা নিয়ে নিজেই যাব বিভিন্ন ম্যাগাজিনের অফিসগুলোতে। তখন ছোটদের কাগজ বলতে বোঝাত শুকতারা। আমরা শুকতারা গোগ্রাসে গিলতাম। কলেজ স্ট্রিটের ওদিকে শুকতারার অফিস, তা জেনে নিলাম গ্রুপের বড়দের কাছ থেকে। কিন্তু যাব কী করে? মাধববাবু বললেন, টু-বি বাসে চড়ে গোলদিঘির সামনে নেমে খোঁজ করতে। ওভাবেই বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়ে খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম শুকতারার ঝামাপুকুর লেনের অফিসে। সম্পাদক মধুসূদন মজুমদার যে ‘দৃষ্টিহীন’ তা আমার জানা ছিল না। ঘরে ঢুকে পরিচয় দিতেই কাছে ডাকলেন, আর তারপর আমার মুখে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কম বয়সে তোমার বাবারও ঠিক এমন চেহারা ছিল।’ আমি অবাক হয়ে যাই। ভদ্রলোক হাতের স্পর্শ দিয়েই দেখতে পান নাকি?

ওঁকে বললাম আসার উদ্দেশ্য। আমার লেখা ‘ম্যাজিকের কথা’ আর্টিকেলটা উনি আমায় পড়ে শোনাতে বললেন। পড়তে শুরু করলাম। ভদ্রলোক সেসব শুনে হেসে ফেললেন। ‘ওভাবে নয়, এভাবে লেখো।’ আসলে ওইটুকু ছেলে নিজে থেকে নিজের লেখা প্রকাশ করতে এসেছে দেখে উনি মনে হয় অবাক হয়েছিলেন। আমি আরও অবাক হলাম মাস পাঁচেক পর শুকতারায় ওই লেখাটা বেরোতে দেখে। সাহস পেয়ে গেলাম। যেতে আরম্ভ করলাম লোকসেবক, যুগান্তর এবং অন্যান্য দপ্তরে। তখন ওই সব কাগজে ছোটদের বিভাগে আমার ম্যাজিকের লেখা বেরোতে লাগল। সংবাদও বেরোল। অবশ্যই প্রশংসা করে। সারা সপ্তাহ তাকিয়ে থাকতাম নির্দিষ্ট দিনটার দিকে। যেদিন সংবাদ বেরোত, সেদিন আমাকে আর পায় কে! সব কেটে কেটে সাজিয়ে রাখতাম। সেই ক্লিপিংগুলো এখনও আমার কাছে আছে। সারা জীবন থাকবে। ওগুলো আমার সম্পদ। আমার ম্যাজিকের খবর কাগজে বেরোচ্ছে, এ সংবাদ বাবার কানেও পৌঁছাল। মনে মনে আমি তখন নিজেকে বলছি, ‘হুঁ হুঁ বাবা। আমিও কম নাকি!’ আর রোজই ভাবি, বাবা হয়তো কোনও দিন সকালে মাকে দিয়ে আমাকে ডাকবেন এবং ম্যাজিক নিয়ে আলোচনায় বসবেন। দু’-চারটে ম্যাজিক শেখাবেন! না, তা আর হল কোথায়! অতএব সেই মহাবিদ্যার সাহায্য নিতেই হল। অপেক্ষা করে থাকতাম, উনি কখন বাড়ির বাইরে যাবেন! কাউকে কিছু না বলে ওঁর পড়ার ঘরে ঢুকে পড়তাম। জানতাম, ম্যাজিকের সব গোপন ব্যাপারগুলো উনি ডায়েরির মধ্যে লিখে রাখতেন। সাংকেতিক সব শব্দ, আঁকিবুকি। প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতাম না। তবে নিজের ডায়েরিতে সেগুলো নোট করে নিতাম। বারবার দেখেও বোধগম্য হত না। রাতে নিউ এম্পায়ারে শো দেখতে যেতাম বাবার। শো দেখার পর আঁকিবুকিগুলো আস্তে আস্তে প্রাণ পেত।

এখন বুঝি, আসলে গোপনীয়তা ম্যাজিকের প্রাণ। গোপনীয়তা নষ্ট হলে সব শেষ।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Cooch Behar | গ্রিনহাউসে অসময়ের চাষে লাভের মুখ দেখছেন কৃষকরা

0
রাকেশ শা ও দেবাশিস দত্ত, ঘোকসাডাঙ্গা ও পারডুবি: প্রথাগত প্রক্রিয়ার বাইরে চাষাবাদে নয়া প্রযুক্তির ব্যবহারে লাভের মুখ দেখছেন কৃষকরা। তাঁদের দেখাদেখি এখন অনেকেই নয়া...

Closed NH-10 | ৭২ ঘণ্টার জন্য বন্ধ হল কালিম্পং-সিকিমগামী ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক, ভোগান্তি...

0
শিলিগুড়িঃ সোমবার সকাল থেকে ফের বন্ধ কালিম্পং-সিকিমগামী ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক। গত বছরের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পুরোপুরি নষ্ট হয়েছিল জাতীয় সড়ক। পুনরায় মাটি, বালি, পাথর...

Huge Cash Recovery | ভোটের মধ্যে ইডি’র হানা, মন্ত্রীর আপ্তসহায়কের পরিচারকের বাড়িতে বিপুল টাকা...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: লোকসভা ভোটের (Lok Sabha Election 2024) মধ্যে ঝাড়খণ্ডে ইডি’র হানায় ফের বিপুল টাকা উদ্ধার (Huge Cash Recovery) হল। সোমবার সকালে...

Bomb blast | ভোটের আগেই বিস্ফোরণ পাণ্ডুয়ায়! বোমা ফেটে মৃত্যু কিশোরের, জখম ২

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ অভিষেকের সভার আগেই হুগলির পাণ্ডুয়ায় বোমা বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণে মৃত্যু হল এক কিশোরের। ঘটনায় গুরুতর জখম আরও দুই কিশোর। আহতদের একজনের...

শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখা কি অপরাধ

0
শাঁওলি দে মে মাসটা শুধু শ্রমিক দিবসের জন্যই বিখ্যাত নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে এইসময় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হয়৷ তাই মে মাস...

Most Popular