- অর্ক ভাদুড়ি
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতার আঁচ আরও খানিকটা গনগনে হয়ে উঠল গত সপ্তাহান্তে। গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলের নৃশংস গণহত্যা এবং প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলির প্রতিরোধের মধ্যেই স্পটলাইটের আলো কেড়ে নিয়েছে ইরান-ইজরায়েল সংঘাত। শনিবার রাতে ইজরায়েলের ভূখণ্ডে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইরান৷ ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ আশঙ্কা করছেন, এর ফলে বৃহত্তর সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেল পশ্চিম এশিয়া। এই আশঙ্কা সত্যি হবে কি না তা নির্ভর করছে ইজরায়েলের প্রতিক্রিয়ার উপরে৷ কিন্তু একইসঙ্গে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে গোটা পৃথিবী। ইরানের এই হামলায় আসলে লাভবান হল কে- ইরান, নাকি ইজরায়েল? প্রশ্ন উঠছে, গাজা থেকে কি নজর খানিকটা ঘুরে গেল বিশ্বের? নেতানিয়াহু কি গত কয়েকমাসের বিস্তর টানাপোড়েনের পর পশ্চিমী দুনিয়ার কিছুটা সমর্থন ফিরে পেলেন? নাকি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নিজের প্রবল উপস্থিতি জানান দিয়ে হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধার করল ইরান? এইসব প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা।
শনিবারের হামলার রাজনৈতিক গুরুত্ব বিপুল। তবে ইজরায়েলের সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি জানিয়েছেন, ইরান তিন শতাধিক ব্যালিস্টিক মিসাইল, ড্রোন ও ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করলেও ক্ষয়ক্ষতি কিছুই প্রায় হয়নি। ১৭০টি ড্রোন ও ৩০টি ক্রুজ মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়, যেগুলির একটিও ইজরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেনি। ইজরায়েল জানিয়েছে, ইরান ১১০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, সেগুলির কয়েকটি ইজরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে।
সত্যি কথা বলতে, ইরান আদৌ ইজরায়েলের বড় কোনও ক্ষতি করতে চায়নি বলেই অভিমত ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকের। ইরান গুরুতর কোনও ক্ষতি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি জানিয়েছেন, সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে ইজরায়েলের আক্রমণের জবাব দিতেই এই সামরিক পদক্ষেপ করেছে ইরান৷ ইজরায়েল যদি প্রতিশোধ নেয়, তাহলে এর চেয়েও ভয়াবহ মাত্রায় হামলা চালানো হবে। বাঘেরির দাবি, সুইৎজারল্যান্ডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে তেহরান জানিয়েছে, আমেরিকা যদি কোনওভাবে ইরানের বিরত সামরিক অভিযানে ইজরায়েলকে সাহায্য করে, তাহলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করবে।
গত ৬ মাস ধরে একটানা ছায়াযুদ্ধ চলে আসছে ইরান এবং ইজরায়েলের। গত ১ এপ্রিলের ঘটনা সেই ছায়াযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সরাসরি সংঘাতে টেনে আনল দুই দেশকে। ওই দিন সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে ইরানি দূতাবাসে হামলা হয়। তাতে ইরানের ‘বিপ্লবী গার্ডের’ ৭ সদস্য এবং ৬ জন সিরিয়ান মারা যান৷ যদিও এই হামলার সঙ্গে ইজরায়েল জড়িত নয় বলে দাবি করেছে নেতানিয়াহু প্রশাসন।
ইরান দাবি করেছে, গত শনিবারের হামলা সফল। কিন্তু ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই সেকথা মানতে নারাজ। লন্ডনভিত্তিক ‘সেন্টার ফর আরব ইরানিয়ান স্টাডিজের’ পরিচালক আলি নুরি জাদেহর মতে, ইরান আদতে বড় ভুল করল। তেহরান ইজরায়েলের কোনও লক্ষ্যবস্তুতেই আঘাত হানতে পারেনি। তাদের উচিত ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। এই হামলার ফলে ইজরায়েল পশ্চিমী দুনিয়ার খানিকটা সমর্থন ফিরে পেল। তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোশে দায়ান সেন্টারের মিডল ইস্ট স্টাডিজের গবেষক এরিক রুন্ডটস্কিও মনে করছেন, এই হামলায় ইজরায়েলের সুবিধা হল। কারণ গাজায় ইজরায়েলের কার্যকলাপ তাকে বিশ্ব মানচিত্রে বিপুল ধিক্কারের মুখে ফেলছিল৷ ইরানের নিষ্ফল হামলা সেই দিক থেকে কিছুটা নজর ঘুরিয়ে দিল।
বস্তুত ইজরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নেতানিয়াহু এখন রীতিমতো চাপে। দীর্ঘ যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত বাড়ছে। রাজধানীর রাস্তায় যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। গাজায় হামাস সহ প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতাকামী শক্তিগুলির হাতে এখনও পণবন্দি হয়ে আছেন অনেক ইজরায়েলি নাগরিক। গোটা গাজা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েও তাঁদের উদ্ধার করতে পারেনি নেতানিয়াহু সরকার। ইরানের আক্রমণ তাঁকে এই বিপুল চাপ থেকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে।
ইরানের আলি খোমেইনিরও ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ‘প্রতীকী’ হামলা না করে উপায় ছিল না। বিশেষ করে পয়লা এপ্রিল সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে হামলার পর তাঁর ‘বিপ্লবী গার্ড’ পালটা হামলার জন্য ফুঁসছিল। তিনি এমন হামলা করলেন, যা মোটের উপর ব্যালেন্সড। এবার বল ইজরায়েলের কোর্টে। তারা প্রতি আক্রমণ করলে জল অনেকদূর গড়াবে। আর যদি নেতানিয়াহু তা না করেন, তাহলে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের আগে পর্যন্ত ইজরায়েলের সঙ্গে ইরানের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। বিপ্লবের পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত। আয়াতুল্লা আল খোমেইনি বলেছিলেন, ইজরায়েল একটি ক্যানসারযুক্ত টিউমার৷ একে নির্মূল করা প্রয়োজন। গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তার মিত্রশক্তিগুলিকে নিয়ে একটি বলয় তৈরি করেছে, যাকে তেহরান ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ বলে চিহ্নিত করে। এই অক্ষটি মার্কিন ও ইজরায়েল বিরোধী শক্তিগুলি নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শরিক সিরিয়া। রাশিয়ার মতোই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল আসাদকে সমর্থন করেছে ইরান৷ আছে লেবাননের দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিজবুল্লা। আছে বেশ কিছু শিয়া মিলিশিয়া, যারা সম্প্রতি মার্কিন ঘাঁটিগুলিকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। কিছুদিন আগেই জর্ডনের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে তারা, যাতে মৃত্যু হয়েছে তিনজন মার্কিন সেনার। এই অক্ষে আছে ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীরা, সমুদ্রে যাদের দাপট নিয়ে রীতিমতো চিন্তিত পশ্চিমী দুনিয়া। এই ‘প্রতিরোধ অক্ষ’টির আড়ালেই এতদিন ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে আসছিল ইরান। শনিবারের পর সম্ভবত সংঘাতের সেই পর্বের অবসান ঘটল।
লেবাননের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল হিশাম জাবের অবশ্য মনে করেন, এই হামলা ইরানের সামরিক মর্যাদা বিপুল বৃদ্ধি করল। ইরান প্রমাণ করল, পশ্চিমীদের সাহায্য ছাড়া ইজরায়েল নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ নয়। কারণ ইরানের সব ক্ষেপণাস্ত্র ইজরায়েলের আয়রন ডোম আটকাতে পারেনি। তার জন্য ব্রিটিশ, আমেরিকান ও জর্ডনের বাহিনীর সাহায্য প্রয়োজন হয়েছে।
ইজরায়েল গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইরানের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইরানের বহু গুরুত্বপূর্ণ সেনা আধিকারিক, পরমাণু বিজ্ঞানী এবং আমলা গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন৷ গত ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের হামলার পর এই আক্রমণ আরও বেড়েছে। হিজবুল্লা এবং ইরান হামাসকে সমর্থন করলেও সরাসরি যুদ্ধে জড়ায়নি। কিন্তু পয়লা এপ্রিলের ঘটনার পর ইরানের পক্ষে কিছু না করে বসে থাকা ছিল কঠিন৷ গাজায় ইজরায়েলের গণহত্যার পর গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ফুঁসছে। জর্ডন যেহেতু ইজরায়েলের পক্ষে, সেহেতু সেদেশে প্রতিদিন বিপুল বিক্ষোভ হচ্ছে। শনিবারের হামলা এই বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে তেহরানকে নায়কে পরিণত করল। নিঃসন্দেহে ইরানের হাতে আরও বিকল্প ছিল। গুপ্তহত্যা এবং দূতাবাসের হামলার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসংঘে কিংবা হেগের আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের দ্বারস্থ হতে পারত তেহরান। জি২০ বা ব্রিকসে ইরানের মিত্রদেশগুলির সহযোগিতা নিতে পারত। কিন্তু ইরান সরাসরি প্রত্যাঘাতের পথে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে তার রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেকখানি বেড়েছে।
আপাতত ম্যাচের হাফটাইম চলছে। গোল হয়নি। ইরানের আক্রমণ ইজরায়েলের গোলপোস্ট নাড়িয়ে দিয়েছে মাত্র। দ্বিতীয়ার্ধে কী হবে, তার জন্য অপেক্ষা আর কয়েকদিনের। তবে বিশ্ব রাজনীতির এই কচকচি প্রখর বৈশাখে মধ্যবিত্ত বাঙালির ঘাম ছোটানোর উপকরণও মজুত রেখেছে। ইরান ইজরায়েলে হামলা করতে পারে এমন সম্ভাবনাতেই তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। শনিবারের হামলার পর তো শিরেসংক্রান্তি। মধ্যপ্রাচ্যের তেল পরিবহণে বড় বাধার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অপরিশোধিত তেলের দাম ২.৭ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল ৯২ ডলারে পৌঁছেছে। জ্বালানি তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ২২ লক্ষ ব্যারেল তেল কম উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওপেক। ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ যদি ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা। পারস্যের সংঘাত যদি তেলের দাম বাড়ায়, তার পরোক্ষ প্রভাবে কলকাতা বা শিলিগুড়িতে বাজার অগ্নিশর্মা হবে না তো? আশঙ্কা কিন্তু থাকছেই।
(লেখক সাংবাদিক)