- অনিন্দিতা গুপ্ত রায়
‘বড় হয়ে কী হতে চাও’ তার উত্তরে ক্লাস ফোরের মেধাবী ছেলেটি বলে ‘টিচার’। কারণ নাকি শিক্ষক হয়েই একমাত্র নিজের চেয়ে ছোটদের সঙ্গে থাকা যায়, তাদের শ্রদ্ধা সমীহ পাওয়া যায়, তাদের নিজের ইচ্ছেমতো চালানো যায়। দু’মিনিট থমকে ভাবি শিক্ষকতার পেশাটির অযুত ক্ষমতার বিষয়ে! একথা তো অনস্বীকার্য যে, ছাত্রের প্রেক্ষিতে একজন শিক্ষক অত্যন্ত ক্ষমতাশালী মানুষ আর ক্ষমতাবিন্দু স্পর্শ করার আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত প্রবণতা।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল সময় ও সমাজে, তা নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই মনে হয় বর্তমানে ‘শিক্ষক’ এই মান্য ভাবমূর্তিটির গায়ে তৈরি করা বা চাপিয়ে দেওয়া হাওয়ার আলখাল্লাটির অপসারণ, অন্যতর স্তরে পেশাটিকে বসিয়ে ধূপধুনো দেওয়ার প্রবণতার ‘ডিমিথিফিকেশন’। না, শ্রদ্ধা ভক্তি সমীহ হ্রাসের কথা বলছি না। যে সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তাতে বিভিন্ন পেশা বিষয়েই রূপকথাসদৃশ ধ্যানধারণার অবসানে মানুষগুলো অনেক বাস্তবের এখন। শিক্ষকেরাও তার ব্যতিক্রম নন। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে এক অলীক দূরত্বের অপ্রয়োজনীয় গাম্ভীর্যের সমীকরণ এখন যথেষ্টই সহজ ও সাবলীল।
শিক্ষক মানেই যে তাঁর কাছে সব সঠিক উত্তর আছে, এমন ধারণা গুগলজমানায় আর জরুরিই নয়। বরং শিক্ষকদের এখন নিয়মিত তথ্যচর্চায় না থাকলে পিছিয়ে পড়তে হয়। তথ্য আর জ্ঞানের মাঝখানে যে গভীর সমুদ্র, তাতে পাড়ি দিয়ে প্রজ্ঞা অর্জন করতে শেখানোই তো আসলে শিক্ষকের কাজ যুগযুগান্ত ধরে। এই কাজে, পরিবারে পিতার ভূমিকার মতোই ছিল এককালে সমাজে শিক্ষকের ভূমিকা। সম্পর্কও ছিল তেমনই রাশভারী- দূরত্ব, সমীহ, ভয়, শাসন, প্রয়োজনে তিরস্কার এমনকি শারীরিক শাস্তিদানের মধ্যে দিয়ে গড়েপিটে নেওয়ার পদ্ধতি। পরিবারে পিতার ভূমিকা বা আচরণও কিন্তু অনেক সহজ এই সময়ে। সহজ হওয়া মানেই লঘু হওয়া যেমন নয়, তেমন নয় গুরুত্বহীন হওয়া। ধরনধারণ কোনটি ভালো তা বিচার না করে শুধু চিহ্নিত করতে চাইছি পরিবর্তনটুকুই। নিজেদের জীবনেও যে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহাশয়দের ফ্রেন্ড-ফিলজফার-গাইড হিসেবে পেয়েছি, তাঁদের কাছে ঋণ কিছু অধিকতর রয়ে গিয়েছে খোলা হাওয়ার প্রবাহ উভমুখী ছিল বলেই। স্কুলজীবনে শৃঙ্খলার পাঠ শেখা অত্যন্ত জরুরি বলেই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপেক্ষাকৃত দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যেস কিছুটা মান্যতা পায় বরাবর। কিন্তু আজকের ছাত্রকে সেই শৃঙ্খলার পাঠ দিতে হলে নিজের তা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এই ছাত্রসমাজ প্রশ্ন তুলতে ভয় পায় না।
প্রশ্ন তোলা মানেই ঔদ্ধত্য নয়। সাহস এবং স্পর্ধার তফাত তাদের শিক্ষকই শেখাবেন। আজ পালটে যাওয়া সময়ে শিক্ষকের ভূমিকা অনেকটাই মনোবিদের। শুধু কেরিয়ার গঠনেই নয়, জীবনের বিবিধ সংকটে আশ্বাসস্থল খোঁজা তরুণ অসহায় মুখটির জন্য সত্যিকারের নিরপেক্ষ সহানুভূতিশীল শিক্ষক তার প্রকৃত অভিভাবক আজও। এক্ষেত্রে বরাবরই সেই শিক্ষকেরা অনেকেই চূড়ান্ত সফল যাঁরা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে ক্ষমতার সম্পর্কে মাপেন না, আর ছাত্রও শিক্ষকের কাছে নিঃসংকোচে যেতে পারে। শিক্ষক লিঙ্গ নির্বিশেষেই হতে পারেন ‘মায়ের মতো ভালো’, স্নেহে, শাসনে, সখ্যে, শিক্ষাদানে। স্কুল-কলেজের বিভিন্ন সামাজিক গ্রুপে অনায়াস যোগাযোগ মাধ্যমে পড়ুয়াদের কাছে শিক্ষকমশাইরা এখন অনেক বেশি সহজলভ্য। ছাত্রদের মাত্রাবোধটুকু শেখালে এই যোগাযোগ খুব সহজ সম্পর্ক তৈরি করে উভয়পক্ষে, যাতে শ্রদ্ধা ভালোবাসা সমীহ কোনওটাই কম হতে এত বছরের অভিজ্ঞতায় দেখিনি।
(লেখক জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। শিক্ষক, সাহিত্যিক)