- গৌতম হোড়
অসমের বরাক উপত্যকায় এলে মনে হবে পশ্চিমবঙ্গের কোনও একটা শহরে এসেছি। দোকানপাটের নাম বাংলায় লেখা। সর্বত্র কানে আসবে বাংলা ভাষায় কথোপকথন। বরং পশ্চিমবঙ্গের থেকেও অনেক বেশি করে বাংলা শুনতে পাবেন এই ভূখণ্ডে। শিলচর স্টেশনের সামনেই রয়েছে ভাষা শহিদদের স্মরণে ভাস্কর্য। বাংলা ভাষার, মাতৃভাষার মর্যাদারক্ষার জন্য ১৯৬১ সালের ১৯ মে শহিদ হয়েছিলেন ১১ জন। বাঙালি ছাড়া নিজের ভাষার জন্য এভাবে কেউ প্রাণ দিয়েছেন কি না আমার অন্তত জানা নেই।
শিলচরের খাবার, শিলচরের নদী, চা বাগান, শহর ছাড়ালেই জল-জঙ্গল তাই বড় বেশি করে চেনা লাগে। কিন্তু ভোটের ছবিটা কি এতটাই চেনা? আসলে বরাক উপত্যকার ভোটে অনেক কিছু মিশে আছে। এনআরসি আছে, বিদেশি চিহ্নিতকরণ আছে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (ওখানে যাকে বলা হয় কা) আছে, ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেস আছে, কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হওয়া তৃণমূল আছে, বদরুদ্দিন আজমলের এআইইউডিএফ আছে এবং আছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।
করিমগঞ্জ কথা
দিল্লিতে কিছু ভোটপণ্ডিত আছেন, যাঁরা সংখ্যা দিয়ে ভোটের হারজিত নির্ধারণ করে দেন। করিমগঞ্জে এলে তাঁরা যারপরনাই হতাশ হবেন। কারণ, করিমগঞ্জের ভোটদাতাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ মুসলিম। অসমের মুসলিমরা বিজেপিকে ভোট দেবেন না। তাই এখানে হিমন্ত বিশ্বশর্মার দল জিততে পারবে না, এমন একটা অঙ্ক দিল্লির বিশেষজ্ঞরা আগেভাগেই কষে ফেলবেন।
করিমগঞ্জে এলে তাঁরা বুঝতে পারবেন, রাজনীতির অঙ্কে সবসময় একের সঙ্গে এক যোগ করলে দুই হয় না, এগারোও হতে পারে। কীভাবে? সেই কাহিনী বড়ই চিত্তাকর্ষক। সেলিম আহমেদ পেশায় আইনজীবী। তাছাড়া তার আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি হলেন মাইমাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। মাইমাল হল মুসলিমদের একটা গোষ্ঠী। বরাক উপত্যকায় প্রায় আড়াই লাখ মাইমাল। তাঁদের আদি পেশা মাছ ধরা। এখন কিছু মানুষ চাষও করেন। মাহি ও মাল্লা শব্দ দুটো মিলে হয়েছিল মাহিমাল, সেখান থেকে মাইমাল।
মাইমালরা মুসলিম এবং গরিব প্রান্তিক মুসলিম। তাঁদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা উন্নয়ন পরিষদ করে দিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন, লোকসভা ভোট মিটে গেলে মাইমালদের তিনি খিলোঞ্জিয়ার স্বীকৃতি দেবেন। খিলোঞ্জিয়া মানে ভূমিপুত্র। সেলিম বলছিলেন, এই স্বীকৃতি পেলে তাঁদের আর এনআরসি, সিএএ বা কা, বিদেশি ট্রাইবিউনালের ঝামেলা পোহাতে হবে না। তাঁরা যে অসমের আদি বাসিন্দা তা সরকার স্বীকার করে নিচ্ছে। তাই সেলিমকে বলতে শুনলাম, এবার তিনি ও অন্য মাইমালরা ভোটটা বিজেপিকে দেবেন।
ইতিমধ্যেই গোরিয়া, মোরিয়া, দেশি, জোলহার মতো পাঁচটি মুসলিম গোষ্ঠীকে ভূমিপুত্রের স্বীকৃতি দিয়ে হিমন্ত বিশ্বশর্মা তাদের জন্য উন্নয়ন পরিষদ গঠন করে দিয়েছেন। তারাও জানিয়ে দিয়েছে, ভোটটা তারা বিজেপিকে দেবে। তাদের কারও এক লাখ, কারও পঞ্চাশ হাজার, কারও দেড় লাখ ভোট আছে। তাই সব হিসাব উলটেপালটে যাচ্ছে। হিমন্তর রাজনৈতিক চালে পিছনের পায়ে কংগ্রেস। যে কেন্দ্রে তাদের হইহই করে জেতার কথা, সেখানে তাদের দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে হচ্ছে।
বিরোধীদের ভোট ভাগ
বিজেপি হিন্দুদের ভোট ধরে রেখে মুসলিম গোষ্ঠীগুলির ভোট জোগাড় করতে উঠেপড়ে লেগেছে। সেখানে কংগ্রেস ও এআইইউডিএফ লড়াই করছে মুসলিম ভোট নিয়ে। এআইইউডিএফ হল বদরুদ্দিন আজমলের পার্টি। তারা মুসলিমপ্রধান কেন্দ্রগুলিতে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। করিমগঞ্জে তাদের হয়ে লড়ছেন শাহবুল আলম চৌধুরী। তাঁর দাবি, ‘করিমগঞ্জ, ধুবড়ি, নগাঁও-র মতো চারটি আসন আমরা চেয়েছিলাম কংগ্রেসের কাছ থেকে। বাকি আসনে ওরা লড়ত। কিন্তু কংগ্রেস জোট করতে আগ্রহ দেখাল না।’
দেখাবে কী করে, অসমে কংগ্রেস তো জেতার জন্য ওই চারটি আসনই ধরে রেখেছে। সেসব এআইইউডিএফকে ছেড়ে দিলে হাতে পেন্সিল থাকে। ফলে করিমগঞ্জে কংগ্রেস প্রার্থী হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরী শুধু যে বিজেপির সঙ্গে লড়ছেন তাই নয়, এআইইউডিএফের বিরুদ্ধেও লড়ছেন। হাফিজ শক্তিশালী প্রার্থী। গুয়াহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী। এনআরসি’র সময় বহু মানুষের মামলা বিনা পয়সায় করে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁকেও প্রতি ইঞ্চি জমির জন্য লড়তে হচ্ছে। গতবার কংগ্রেস ও এআইইউডিএফ প্রার্থীর মধ্যে ভোট কাটাকাটিতে বিজেপি করিমগঞ্জ জিতে নিয়েছিল। এবার কী হবে? শুধু দুটি তথ্য দেওয়া যথেষ্ট। এক, কংগ্রেস ও এআইইউডিএফের ভোট কাটাকাটি হলে বিজেপির জয়ের সম্ভাবনা প্রবল হবে। দুই, কিছু মহলের আশা, মুসলিমরা এবার একটি পার্টিকে বেছে নিতে পারেন। যারা বিজেপিকে হারাবে তাদের ভোট দেবেন। সেটা হলে কংগ্রেস বা আজমলের দলের আশা আছে। নাহলে, তাদের লড়াই কঠিন।
শিলচরের হতবল সুস্মিতা
২০১৯ সালে শিলচরে কংগ্রেস প্রার্থী সুস্মিতা দেব ৮১ হাজারের বেশি ভোটে হেরেছিলেন। সুস্মিতা বরাক উপত্যকায় অবিসংবাদী কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেবের মেয়ে। কংগ্রেসে থাকার সময় রাহুল, প্রিয়াংকা, সোনিয়া গান্ধির কাছের নেত্রী ছিলেন। তিনি এখন দলবদল করে তৃণমূল কংগ্রেসে। তবে তিনি লোকসভায় লড়ছেন না। তাঁকে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে। তিনি তৃণমূলের হয়ে ভরপুর প্রচার করছেন।
গতবার তৃণমূল প্রার্থী হিতব্রত রায় পেয়েছিলেন সাড়ে তিন হাজারের মতো ভোট। নোটার অর্ধেক ভোটও তিনি পাননি। এবার সুস্মিতা ঘুরছেন। কংগ্রেসের সংগঠন থেকে মানুষদের ভাঙিয়ে এনেছেন। কিন্তু শিলচর শহরে তাঁর পথসভাতেও যে মানুষ নেই। শিলচরে বঙ্গসন্তানদের জিজ্ঞাসা করলে তাঁদের সিংহভাগ বলবেন, তাঁদের ভোট পদ্মে পড়বে।
কা আছে, আবেদনকারী নেই
ভোটের আগে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চালু হয়েছে। প্রথম দিকে অসমে প্রতিবাদও হয়েছে। অসমে ১৯ লাখ মানুষের নাম এনআরসি থেকে বাদ, আর বাদ পড়ার তালিকায় হিন্দুদের নাম সবচেয়ে বেশি। সেখানে তো সিএএ নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের বন্যা বয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু এতদিনে সাকুল্যে মাত্র একজন আবেদন জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কা অসমে কোনও ইস্যু নয়।
কিন্তু কেন এই ছবি? সিটিজেনস রাইটস প্রোটোকল কমিটির কিশোরকুমার ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘আমরাই মানুষকে বলছি, আবেদন না করতে। কারণ, এই আইনে আবেদন করলে মেনে নিতে হবে, তাঁরা আদতে বিদেশি। তাঁরা বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে এসেছেন। তাঁদের এফআইআরের কপি বা অন্য প্রমাণ দিতে বলা হচ্ছে। এসব দিয়ে আবেদন করার পর খারিজ হয়ে গেলে আবেদনকারীর ঠঁাই হবে ডিটেনশন সেন্টারে। তাই আগে এই আইনের নিয়মে পরিবর্তন করতে হবে। না হলে, এতে আবেদন করলে ঝুঁকি আছে।’
সেই ঝুঁকি নিয়ে মানুষ অসমে আবেদন করতে খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছেন না।
মণীন্দ্র দাসের কথা
বরাক নদীর ধারে বসবাস করা মণীন্দ্র দাসের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। ৬৪ বছর আগে চার বছর বয়সে বাবার হাত ধরে তিনি অসমে আসেন। যে শিবিরে ছিলেন, তার রসিদ আছে। ভোটার আই কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড সবই আছে। কিন্তু ফরেন ট্রাইবিউনাল তাঁকে বিদেশি বলে ঘোষণা করেছে। দুই বছর তিনি জেল খেটে হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে এখন মুক্ত। সপ্তাহে একদিন করে থানায় যেতে হয়।
অথচ এনআরসি-তে তার নাম আছে। অর্থাৎ, এনআরসি অনুযায়ী তিনি ভারতীয় নাগরিক। এবারও তিনি ভোট দেবেন। তাঁর নিকানো মেঝে ও বাঁশের কঞ্চির দেওয়ালের বাড়ির পাশে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। এই বয়স্ক মানুষটি অসম্ভব চিন্তায় নাগরিকত্ব নিয়ে। বারবার বলছিলেন, ‘আমাদের নাগরিক করে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। না হলে আমার পরিবারের কী হবে?’ বরাক নদীতে মাছ ধরে জীবন চালানো মণীন্দ্রর আড়াই লাখ টাকা চলে গিয়েছে আদালতে আইনি লড়াই লড়তে গিয়ে।
অথচ এবারও তিনি নরেন্দ্র মোদিকেই ভোট দেবেন। কারণ, তাঁর বিশ্বাস, মোদি তাঁকে বাড়ি দিয়েছেন, তাঁর জন্যই তিনি জেলের বাইরে বেরোতে পেরেছেন। নাগরিকত্বও মোদিই দিয়ে দেবেন।
বলছিলাম না, অসমের ভোটের অঙ্ক বড়ই জটিল।
(লেখক সাংবাদিক)