Tuesday, April 30, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে মাঝপথে বাংলা ছাড়ার সংখ্যা বাড়ছে

উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে মাঝপথে বাংলা ছাড়ার সংখ্যা বাড়ছে

 

  • অংশুমান কর

বাংলা নববর্ষ নিয়ে বাঙালিদের আহ্লাদের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাঙালিদের যত উৎসব রয়েছে তার মধ্যে এটিই একমাত্র উৎসব যার সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগই নেই। এই একটিদিন আমরা যথেষ্ট পরিমাণে বাঙালি হয়েও উঠি। বছরের অন্য দিনগুলিতে বাংলা তারিখের হিসেব না রাখলেও, বাংলা ক্যালেন্ডারের এই দিনটিকে তো ভুলে যাওয়া অসম্ভব। এই দিনটিতেই আবার হা-হুতাশও শোনা যায় যে, বাঙালি আর যথেষ্ট বাঙালি নেই।

কাকে বলা হবে বাঙালি তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। বাঙালিয়ানাও নিশ্চিতভাবেই নিশ্চল কোনও ধারণা নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বিবর্তিত হয়েছে। বেশি পেছনে যেতে হবে না, উনিশ শতকের বাঙালির সঙ্গেই একবিংশ শতকের বাঙালির ফারাক বিস্তর। তবে বিবর্তন সত্ত্বেও বাঙালিয়ানার মূল কিছু বৈশিষ্ট্য একই রয়ে গিয়েছে। এর নানা কারণ আছে। একটি কারণ অবশ্যই বাঙালিয়ানা রক্ষার পেছনে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতেই হয়।

এ কথা ঠিক যে, শ্রেণিকক্ষের অন্দরে একটি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি বেঁচে থাকে না। ভাষা ও সংস্কৃতি আসলে বেঁচে থাকে রাস্তায়, খোলা মাঠে। কিন্তু শ্রেণিকক্ষের সমর্থন না পেলে রাস্তা বা মাঠের সংস্কৃতিচর্চাকেও দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব। বাস্তবিকই একটি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের অবদানটিকে কোনওমতেই অস্বীকার করা যায় না। এ কথাটি সহজ করে বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর আজীবনের কর্ম ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সুকুমার সেন, নীহাররঞ্জন রায় বা শঙ্খ ঘোষের মতো মানুষেরা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা ও চর্চার ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের বিপুল প্রভাবকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে। সত্যি বলতে কী, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চাকে পুষ্ট করে এসেছেন যাঁরা, তাঁরা অনেকেই কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষায়তনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পাঠদানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। বাংলা নববর্ষের এই মাহেন্দ্রক্ষণে তাই প্রশ্ন জাগে, আজ কী অবস্থায় আছে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা?

এই লেখাটির প্রয়োজনেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলছিলাম পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকদের সঙ্গে। যে চিত্রটি সামনে এল, তা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগগুলিতে গত কয়েক বছরে আসন সংখ্যা সম্পূর্ণ ভর্তি হচ্ছে না।  অনেক ক্ষেত্রে আবার প্রাথমিকভাবে ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হলেও কিছুদিন পরেই তারা শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করছে পাকাপাকিভাবে। ইংরেজিতে এদেরই গালভরা নাম হল ‘ড্রপআউট’।

যে কয়েকজন অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বললাম, তাঁরা সকলেই জানালেন যে, বাংলা বিভাগগুলিতে এই ড্রপআউটদের সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে প্রায় সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। মনে হয় যে, এ ক্ষেত্রে কলেজগুলির চিত্রও খুব একটা আলাদা হবে না। অধ্যাপকদের সকলেই জানালেন যে, বাংলা সাহিত্যের ক্লাসে ভালো ছাত্রছাত্রীদের শতাংশও ক্রমশ কমছে।

এমনটা হচ্ছে কেন? সার্বিকভাবেই এই রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাটির ওপর সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের বিশ্বাস অনেকখানি নড়ে গিয়েছে। স্কুল শিক্ষকতায় সুযোগ পেতে গেলে যোগ্যতা নয় থাকতে হবে ব্যাগ ভর্তি টাকা — এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরে, সামগ্রিকভাবেই সাধারণ বিষয়গুলি নিয়ে উচ্চশিক্ষালাভের ইচ্ছে ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের মধ্যে কমেছে গত কয়েক বছরে। বাংলা বিষয়টিও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং এই প্রবণতায় উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে বাংলা সাহিত্য পাঠ আক্রান্ত হয়েছে একটু বেশি রকমই।

কেন? নিজেদের ছাত্রাবস্থা থেকেই দেখেছি যে, ভালোবেসে বাংলা সাহিত্য পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নগণ্য। একটি বিরাট অংশের ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষায় বাংলা সাহিত্যকে বিষয় হিসেবে পছন্দ করত তার কারণ, উচ্চপ্রাথমিক স্তর থেকেই একটি নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা মানেই অন্তত বাংলার শিক্ষকতার সুযোগ বাংলা সাহিত্য পাঠরত একজন ছাত্র বা ছাত্রীর সামনে খুলে যাওয়া। স্কুল থাকলেই থাকতেই হবে অন্তত একজন বাংলার শিক্ষক–এমনটাই দস্তুর। স্কুল সার্ভিস কমিশনের দুর্নীতি, এই পরীক্ষাটির ডুমুরের ফুল হয়ে যাওয়া অন্য পাঠ্য বিষয়গুলিকে যতখানি না আক্রান্ত করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে দিয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পাঠের। কারণ অন্য বিষয়গুলি পড়ে চাকরির ক্ষেত্রে স্কুল শিক্ষকতার বাইরে আরও নানাবিধ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের যে সুযোগ একজন ছাত্র বা ছাত্রী পায়, বাংলা পড়লে সেই সুযোগগুলি সেইভাবে তারা পায় না। ভাষাতাত্ত্বিক জিএন ডেভি সাম্প্রতিক সময়ে বারবার বলছেন যে, একটি ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে সেই ভাষাশিক্ষা সমাপনান্তে যাতে কর্মসংস্থান হয়, সেই সম্ভাবনাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনকে দুর্নীতিমুক্ত করে রাজ্যের বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক নিয়োগকে নিয়মিত করা না গেলে আগামীদিনে বাংলা সাহিত্য পড়ার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আরও কমবে। কেবলমাত্র রাস্তা এবং খোলা মাঠে ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করে তখন কিন্তু বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।

কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও অনেক সময় একটি বিষয় পড়তে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহী করে তোলা যায়। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় আধুনিক সিলেবাস ও দক্ষ শিক্ষকের। বলতে দ্বিধা নেই যে, সরকারি স্তরে যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি স্তরে সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়টি  ছাড়া বাংলা সাহিত্যের সিলেবাসের আধুনিকীকরণের বিষয়ে অধ্যাপককুল ভীষণভাবে গোঁড়া। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের সিলেবাসগুলির সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সিলেবাসগুলির তুলনা করলেই এই মানসিকতাটি স্পষ্ট হবে। ইংরেজি বিভাগগুলি যেখানে এমনকি ২০২০ সালে প্রকাশিত উপন্যাসকেও সিলেবাসের অংশ করে নেয়, বাংলা বিভাগগুলি সেখানে বাংলা সাহিত্যের গত শতাব্দীর সাতের দশকের রথীমহারথীদের পড়াতেও অনীহা প্রকাশ করে। এর ফলেই দেখা যায়, বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাশ করা ছাত্র বা ছাত্রীদের অধিকাংশই সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের কণামাত্র খবর রাখে না। বেদনার হলেও একথাও সত্য যে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কোন পথে এগোল বাংলা সাহিত্য তার একটি সামগ্রিক রূপরেখা পাওয়ার মতো প্রামাণ্য কোনও পুস্তক আজও রচিত হল না। পাঠক এবং গবেষকদের জন্য আজও সুকুমার সেন এবং অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইগুলিই ভরসা! অথচ গত চল্লিশ বছরে বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের বিস্তৃত ইতিহাস সংগত কারণেই এই পুস্তকগুলিতে অনুপস্থিত।

বাংলা সাহিত্য পাঠে ভালো ছাত্রদের অনাগ্রহের আরেকটি কারণকে সামনে আনলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঋতম মুখোপাধ্যায়। তিনি বললেন ভালো ছাত্রছাত্রীদের এই বিষয়টি পড়ার আগ্রহ কমছে কারণ ‘নানা রকমের ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি বা প্রতিশোধের শিকার হয় ছাত্রছাত্রীরা উচ্চতর গবেষণা ও চাকরির সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে’। এ তো বড়ই উদ্বেগের বিষয়! উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের সামগ্রিক দুর্নীতির পাশাপাশি উচ্চশিক্ষায় বাংলা সাহিত্য পাঠের জগৎটিও যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়, ছাত্রছাত্রীরা হয় অধ্যাপকদের ‘প্রতিশোধস্পৃহার শিকার’, তাহলে কেবলমাত্র একটিদিন ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালন করে বাংলা সংস্কৃতির রক্ষণাবেক্ষণ এবং চর্চার প্রসার ঘটানো অসম্ভব।

মোদ্দা কথাটি হল এই যে, বাঙালিয়ানাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের পাঠ ও চর্চায় গতি চাই। ব্যক্তি উদ্যোগে এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে এই বিষয়ে অবিলম্বে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। শুকনো কথায় চিঁড়ে ভেজার দিন কিন্তু দ্রুত শেষ হয়ে আসছে।

(লেখক অধ্যাপক ও সাহিত্যিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Raiganj | স্বামীর পরকীয়ার প্রতিবাদ করার পরই নিখোঁজ বধূ, খুনের আশঙ্কা পরিবারের

0
রায়গঞ্জ: স্বামীর পরকীয়ার প্রতিবাদ করার পর থেকেই নিখোঁজ স্ত্রী। রায়গঞ্জের মেরুয়াল এলাকার ঘটনা। নিখোঁজ মহিলার নাম সীমা ধর। তার পরিবারের অভিযোগ, সীমার ওপর প্রায়...

Telangana | অমিত শাহের ভিডিও বিকৃতির জের, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীকে সমন দিল্লি পুলিশের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ-র বিকৃত করা ভিডিও তেলেঙ্গানা কংগ্রেসের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে শেয়ার করার অভিযোগে দিল্লি পুলিশ সমন পাঠাল তেলেঙ্গানার...

Narendra Modi | বাতিল শা’র সভা, ৩ মে নির্বাচনি প্রচারে কৃষ্ণনগরে আসছেন মোদি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আগামী ১৩ মে চতুর্থ দফায় লোকসভা ভোট (Lok Sabha Election 2024) কৃষ্ণনগরে (Krishnanagar)। তার আগে মহুয়া মৈত্রের (Mahua Moitra) কৃষ্ণনগরে...

CM Mamata Banerjee | ‘সিপিএম কিনলে কংগ্রেস ফ্রি’, জোটকে কটাক্ষ মমতার

0
খড়গ্রাম: দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন নিয়োগ দুর্নীতিতে রাজ্যকে ধাক্কা দিল, ঠিক তখন মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামের নির্বাচনি জনসভা থেকে ফের শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবিকে উসকে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী...

TMC | নির্বাচনি আচরণবিধির পরোয়া নেই, সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন তৃণমূলনেত্রী

0
হরিশ্চন্দ্রপুর: নির্বাচনি আচরণবিধি চলছে। কিন্তু তা তোয়াক্কা করছেন না তৃণমূলের ব্লক সভানেত্রী তথা জেলা পরিষদের সদস্য। নির্বাচনি আচরণবিধি চলাকালীনই তৃণমূলের(TMC) হরিশ্চন্দ্রপুর-১ (বি) সাংগঠনিক ব্লকের...

Most Popular