সমীর দাস, হাসিমারা: র্যাশন বণ্টনের কেন্দ্রটা রয়েছে বাগানেরই কারখানা সংলগ্ন এলাকায়। শুক্রবার দুপুরে মধু বাগানের সেই র্যাশন বণ্টন কেন্দ্রের সামনে গিয়ে দেখা গেল, দুটি লাইন করা আছে। না, লাইনে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কেউ চটের বস্তা দিয়ে, কেউ বা পলিথিনের ব্যাগ দিয়ে, আবার কেউ পাথরের টুকরো রেখে যে যার মতো করে জায়গা রেখেছেন। ঝাঁপ বন্ধ র্যাশন বণ্টন কেন্দ্রের।
এভাবে লাইন রাখার কারণ কী? প্রশ্নটা করতেই এগিয়ে এলেন এক অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক বিরসু টোপ্পো। বললেন, ‘সকাল ৭টা থেকে র্যাশন নেওয়ার জন্য লাইন দিয়েছি। এখনও দোকান খুলল না। আজ আর আশা নেই র্যাশন পাওয়ার। আবার কাল লাইনে দাঁড়াতে হবে।’
মধু চা বাগানের শ্রমিক ধনী ওরাওঁয়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এখন চর্চা চলছে জেলার রাজনীতিতে। অপুষ্টিতে মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রথমেই উড়িয়ে দিয়েছেন রাজ্যসভার সাংসদ তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি প্রকাশ চিকবড়াইক। তাঁর যুক্তি ছিল, যেহেতু র্যাশন মেলে, তাই অপুষ্টি বা অর্ধাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতেই পারে না। অথচ মধু বাগানে গিয়ে দেখা গেল, নিয়মিত র্যাশন পাওয়াটা বাগান শ্রমিকদের কাছে যেন বিলাসিতা।
বাগানটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর প্রায় দু’বছর আগে খুলেছে। তবে শ্রমিকদের অভিযোগ, মজুরি ঠিক সময়ে দেওয়া হচ্ছে না। এই অবস্থায় তাঁদের ভরসা সরকারি র্যাশন। সেই র্যাশনটুকুও তাঁরা সময়মতো পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ।
ওই র্যাশন দোকানের সামনেই দেখা হল আরেক শ্রমিক আগনু ওরাওঁয়ের সঙ্গে। বললেন, ‘কত মাস ধরে একই অবস্থা চলছে। কোনও মাসেই র্যাশন সামগ্রী ঠিকমতো বণ্টন হচ্ছে না।’ কীভাবে র্যাশন বিলি হয়? আগনুদের কথায়, গত মাসের সামগ্রীর টোকেন এই মাসে ধরিয়ে দেবে। আবার এই মাসের চিনি বা আটার জন্য সামনের মাসে লাইনে দাঁড়াতে হবে। এই চলছে।
একটু এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল যোগী লাইনের বাসিন্দা, বাগানের শ্রমিক ইন্দিরা বাখলা, নাগি ওরাওঁয়ের। র্যাশন প্রসঙ্গে জানতে চাইলেই ক্ষোভ ধরা পড়ল তাঁদের কথায়। বললেন, কাজ বাদ দিয়ে র্যাশন দোকানের লাইনে দাঁড়াই। দিনের শেষে দেখা গেল র্যাশন পেলাম না, আবার হাজিরাও কাটা গেল। তাঁরা বলেন আমাদের মতো শ্রমিকরা র্যাশনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু র্যাশন পরিষেবা থেকে দিনের পর দিন আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
বাগানের র্যাশন বণ্টনের দায়িত্বে রয়েছে একটি মহিলা পরিচালিত স্বনির্ভর গোষ্ঠী। অনেকদিন ধরেই ওই গোষ্ঠীর কার্যকলাপের বিরোধিতা করছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। দলের শাখা সংগঠনের তরফে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর র্যাশন দোকানের সামনে তুমুল বিক্ষোভও দেখানো হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সভাপতি আরতি বিশ্বকর্মার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ফোন ধরলেও তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।
তৃণমূলের চা শ্রমিক সংগঠনের নেতা তথা সাতালি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ইসদোর খাড়িয়া বলেন, ‘র্যাশন সমস্যা নিয়ে আমরা আগেও প্রশাসনকে জানিয়েছি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ডাকযোগে জেলা প্রশাসন ও খাদ্য দপ্তরের জেলা আধিকারিককে চিঠি পাঠিয়েছি।’ সংগঠনের নেতা জয়প্রকাশ খাখা, সুরেশ তুরি, রাজ কেরকেট্টা প্রত্যেকেই র্যাশন সমস্যার বিষয়ে সরব হয়েছেন।
যদিও আলিপুরদুয়ার জেলা খাদ্য নিয়ামক বাবুল ভক্ত জানিয়েছেন, মধু বাগানে র্যাশন বণ্টনে অনিয়ম নিয়ে কোনও অভিযোগ কখনও তাঁর কাছে আসেনি। বলেছেন, ‘অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখব।’ আর কালচিনি ব্লকের ফুড ইনস্পেকটর পল্লবকুমার দাস জানিয়েছেন, চা বাগানের র্যাশন বণ্টন যাতে স্বাভাবিক থাকে তার জন্য তাঁরা সবসময় চেষ্টা চালান।