উত্তম সেনগুপ্ত: সংসদের নিরাপত্তা লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধী সাংসদরা গত কয়েক দিন ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই দাবিকে আমল দেননি সরকারের দুই প্রধান মুখ। অথচ এ ব্যাপারে সংসদে মুখ না খুললেও তাঁরা কিন্তু মিডিয়ার কাছে গোটা বিষয়টি তুলে ধরেন। এতে দুজনের মর্যাদা কতটা বৃদ্ধি পেল, তার উত্তর তাঁরাই ভালো জানেন। সংসদ সদস্যদের কাছে জবাবদিহি করার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনেই বাইরের ‘আরও গুরুত্বপূর্ণ’ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় টানা তিন দিন সংসদে অনুপস্থিত থাকতে পারেন। দুজনের সংসদে বক্তৃতা দিতে অহংকারী মনোভাব সংসদের শীতকালীন অধিবেশনকে যে ব্যাহত করেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
গত ১৩ ডিসেম্বর দুই যুবক নতুন সংসদ ভবনের দর্শক গ্যালারি থেকে হাউসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা বেকারত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং মণিপুর কাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতার বিরুদ্ধে একটি নিরীহ ‘হলুদ গ্যাস’ স্প্রে করে। এমন কাজ কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। এই অন্যায় কাজ ছিল নিজেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার একটি মরিয়া প্রচেষ্টা মাত্র। সম্ভবত এমনটাই তারা বিশ্বাস করেছিল। তবে সেদিন প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেউই সংসদে উপস্থিত ছিলেন না। বরং তাঁরা সংসদের সমস্ত নিয়ম ও মর্যাদাকে গুরুত্বহীন করে সমস্ত নীরবতা ভেঙে বাইরে মুখ খোলাই ঠিক বলে মনে করেছিলেন।
সংসদের অধিবেশন চলাকালীন সকল গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ‘গণতন্ত্রের মন্দির’-এ আলোচনা হওয়াটাই দস্তুর। যা কিনা সাংসদদের মাধ্যমে গোটা দেশের আস্থায় পরিণত হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একটি সংবাদপত্রে নীরবতা ভাঙলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি টিভি চ্যানেলে।
বিরোধীরা কেন এই ঘটনার অভিঘাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি এবং সংসদের নিরাপত্তা লঙ্ঘন নিয়ে আলোচনার দাবি জানিয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলে শাসক ও বিরোধী সাংসদরা তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পেতেন। একইসঙ্গে এই আলোচনার মধ্যেই তাঁরা বর্তমান অর্থনীতি এবং মোদি সরকারের অর্থনৈতিক নীতি, বেকারত্ব এবং নতুন সংসদ ভবনের অপ্রতুলতা সংক্রান্ত সমস্যা তোলার সুযোগ পেতেন। নিঃসন্দেহে বিরোধীদের ভিন্নমতের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রে শাস্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সমস্ত উপায় বন্ধ করবে। আর তাই ওই যুবকরা সাহসী প্রতিবাদের মাধ্যমে কিছুটা নাটকীয়তা আনার চেষ্টা করেছে। এবং এজন্য অপেশাদার রাস্তা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।
বিরোধীদের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা ও প্রশ্নের উত্তরের দাবি অযৌক্তিক বা নজিরবিহীন ছিল না। ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সংসদ যখন সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হয়, তা অনেক বেশি গুরুতর ছিল। নিরাপত্তা লঙ্ঘনের আপেক্ষিকতা কম গুরুতর প্রকৃতির হওয়ার জন্য যদিও আলোচনাগুলিকে অনুমোদন না দেওয়া কোনও অজুহাত হতে পারে না। ২২ বছর আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি দুজনেই বিবৃতি দিয়েছিলেন। এভাবেই সংসদ কাজ করবে বলে আশা করা যায়। সরকারকেও বিরোধীদের কথা শুনতে হবে। স্পিকার যা বলেছেন, তাতে বিরোধীদের কথা বলার, প্রশ্নের অধিকার অস্বীকার করার প্রবণতাকে চিহ্নিত করে। ঘটনার জেরে একটি এফআইআর দায়ের করা এবং ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা তুচ্ছ, অবিশ্বাস্য এবং অগ্রহণযোগ্য অজুহাত ছাড়া কিছু হতে পারে না।
শীতকালীন অধিবেশন ভেস্তে যাওয়ার ঝুঁকির পরিবর্তে, সংসদে যদি শাসকপক্ষ এই বিষয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আলোচনা করত তবে কারও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত না। নিরাপত্তা লঙ্ঘনের বিষয়ে সরকারের অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানেরও সুরাহা করা দরকার। একদিকে স্পিকার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিরাপত্তা লঙ্ঘনকে একটি গৌণ, নিরীহ ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, ঘটনার রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টিকে এভাবে একদম উড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়। অন্যদিকে সরকার সন্ত্রাসের অভিযোগে এবং ইউএপিএ-র কঠোর বিধানের অধীনে ছয়জনকে অভিযুক্ত করেছে। যদি সত্যিই এটি একটি ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে থাকে, তা ক্ষমতাসীন দল জোর দিয়ে দাবি করেছিল, তাহলে অবশ্যই সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য আরও কড়া দাবি জানানো উচিত ছিল।
সংসদের উভয় কক্ষ থেকে কেন্দ্র সরকার বিরোধী ১৪৬ জন সাংসদকে সাময়িক বরখাস্ত করা নজিরবিহীন এবং একটি নতুন নিম্নগামী প্রবণতা। সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া সাংসদের মধ্যে এমন একজনের নাম জানানো হয়েছিল, যিনি ঘটনার আগে বা পরে সেদিন হাউসে উপস্থিতই ছিলেন না। এবং তাঁকে যখন বরখাস্ত করা হচ্ছিল, সেসময় তিনি তামিলনাডুতে ছিলেন। না, এই ঘটনাটি কিন্তু সংসদ বা অধ্যক্ষের চেয়ারের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করেনি। যদিও পরে নিজেদের ভুল অনুধাবন করে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার করা হয়েছিল। অন্যথায় ‘ব্যস্ত’ প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি তাঁদের মূল্যবান সময়ের আধঘণ্টা সময় ব্যয় করতেন এবং নিজ নিজ দপ্তরের তৈরি করে দেওয়া বিবৃতি পড়ে শোনাতেন, তাহলে যুক্তিযুক্তভাবে বিরোধী সংসদ সদস্যদের দাঁড়ানোর বা সংসদের ওয়েলে নামার প্রয়োজন হত না। সংসদের উভয় কক্ষের সর্বোচ্চ আধিকারিকরা অতীতে হাউস পরিচালনার ক্ষেত্রে বহু অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করেছিলেন। এবং তাঁদের শৃঙ্খলামূলক পদক্ষেপগুলি প্রায়শই সমস্ত বিরোধী সাংসদদের অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নির্দেশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে অতীতে তার পূর্বসুরি ডঃ মনমোহন সিং এবং প্রাক্তন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান এবং সহ সভাপতি হামিদ আনসারিকে উপহাস করেছেন। কিন্তু এটি হাউসের বা তাঁদের অফিসের মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে হয় না। ট্রেজারি বেঞ্চে থাকা সাংসদরা হাউসের কাজে বিঘ্ন ঘটানো, বিরোধী দলের বক্তাদের ভাষণে বাধা দেওয়া, নিজেরাই কারণে-অকারণে ওয়েলে নেমে আসা, অশালীন ভাষা ব্যবহার থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। ২০০৯ ও ২০১৪ সালে বিজেপি যখন কেন্দ্রে বিরোধী আসনে বসত তখন নানা ইস্যুতে তারা বিরোধিতা করার নামে প্রায়ই সংসদের উভয় কক্ষ অচল করে দিয়েছিল। সেসময় বিজেপির দুই নেতা-নেত্রী অরুণ জেটলি এবং সুষমা স্বরাজ দাবি করেছিলেন যে, সংসদের কাজে বাধাদানগুলি বৈধ সংসদীয় অনুশীলন ছিল মাত্র। তাঁদের সেই মন্তব্য সেসময় নানা ভাষার খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপাও হয়েছিল। এমন মন্তব্যের জন্য তাঁরা রাতারাতি বিখ্যাতও হয়েছিলেন।
পদ্ম শিবির সরকার গঠন করলে বিজেপির সেই সময়ের প্রতিদিনের বাধা সম্ভবত শেষ হতে পারেনি। তখন বিজেপির জন্য যা ‘সস’ ছিল, তা এখন বিরোধীদের জন্য ‘সস’ হতে হবে। তবে যাই হোক, একটি সংসদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা, আইন প্রণয়ন করা এবং জনগণের উদ্বেগের সমাধান খুঁজে বের করা। এটা দুঃখজনক হলেও সেই কাজ গুলি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
মোদির অধীনে বিজেপি সরকার সংসদকে ক্রমবর্ধমান একটি ইকো চেম্বার হিসাবে ব্যবহার করার প্রবণতা দেখাচ্ছে। একে সংসদের বাইরের রাজনৈতিক সমাবেশের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন এখানে গুরুতর বিষয়ভিত্তিক আলোচনার যাচাই-বাছাই নিয়ে অধৈর্যভাব দেখছি সব ক্ষেত্রে। সেই আলোচনার নির্যাসকে আইনে প্রণয়নের প্রহসন দেখতে পাচ্ছি। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলি বিলগুলিকে যাচাই-বাছাই করতে কমবেশি বলেছে। গোটা সংসদের কর্মপদ্ধতি এখন আর অলক্ষ্যে থাকছে না। ভি-ডেমের মতো আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি এখন ভারতের গণতন্ত্রকে ‘নির্বাচনি স্বৈরাচার’ হিসাবে চিহ্নিত করছে। সংসদকে চিয়ারলিডারদের চেম্বারে পরিণত করা হচ্ছে। ঐতিহাসিক জায়গাটি আপাতত ভারতীয় গণতন্ত্রের মর্যাদা বজায় রাখার জন্য কিছুই করে না।