প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: সংসদীয় রাজনীতিতে ‘চরমপন্থা’ বলে কিছু হয় না। চরমপন্থীদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও আস্থাশীল নয় সংসদীয় গণতন্ত্র। কোনও একটি বিষয়ে অনড় থেকে যখন সংসদ অচল করবার লক্ষ্যে অগ্রসর হয় কোনও দল, বরাবর একটি ‘এগজিট রুট’ খুলে রাখাও দরকার হয়ে পড়ে। পর্যবেক্ষক মহলের একাংশের মতে, ‘এগজিট রুট’ বা ‘নিস্ক্রমনে’র এই রাস্তা খুলে রাখতে দেরি করলে, তা বিপদেও ফেলতে পারে যে কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অবস্থানগত আদর্শকে। বৃহস্পতিবার, সংসদীয় পরিসরে এই ‘এগজিট রুট’ দেরিতে খোলার কারণে এমনই কোনঠাসা অবস্থায় দেখা গেল বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে। দাবার এক ভুল চালের জন্য এদিন ‘মধ্যম পন্থা’ নামক খেসারত দিতে হয়েছে তাঁদের যা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রবল চর্চা শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় মহলে।
বৃহষ্পতিবার মণিপুর ইস্যুতে বিরোধী শিবিরের তরফে এক নতুন কৌশল গ্রহণ করা হয়৷ বাদল অধিবেশনের শেষলগ্নে অধিবেশন চলাকালীন সংসদীয় গতিরোধের সম্পূর্ণ দায় যাতে বিরোধী শিবিরের ঘাড়ে না এসে পড়ে, তা নিশ্চিত করার উদ্দেশে এদিন বিরোধী শিবিরের তরফে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদের সামনে ‘মধ্যম পন্থা’ হিসেবে বিকল্প প্রস্তাব পেশ করা হয়৷ সংসদীয় সূত্রের দাবি, কংগ্রেস সভাপতি তথা রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়গের কক্ষে আয়োজিত বৈঠকে সরকার পক্ষের তরফে এদিন উপস্থিত দুই প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযুষ গোয়েল এবং প্রহ্লাদ যোশীর সামনে বিরোধীরা প্রস্তাব দেন রুল ২৬৭ অনুযায়ী রাজ্যসভায় মণিপুর ইস্যুতে জরুরি ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে হবে না, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য না রাখলেও চলবে৷ এই মর্মে সরকার প্রস্তাবিত সংসদীয় রুল ১৭৬ অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত আলোচনারও প্রয়োজন নেই৷ তার পরিবর্তে এবার রুল ১৬৭ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করুক কেন্দ্রীয় সরকার, যেখানে সরকারের তরফে আলোচনায় মণিপুর নিয়ে বক্তব্য রাখুন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ৷ এই ক্ষেত্রে রাজ্যসভায় আলোচনা চলাকালীন কোনও একটা সময়ে প্রধানমন্ত্রী সভায় এলেই চলবে৷
কেন্দ্রীয় সূত্রের দাবি, বিরোধীদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি সরকারপক্ষ৷ দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীই জানান তাদের পক্ষে এখনই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর উপস্থিতি নিয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সংসদীয় ব্যস্ততার মধ্যে আছেন৷ মোদি সরকারের এই অবস্থানে চাপ বেড়েছে বিরোধীদের উপরেই৷ কারণ পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী মণিপুর ইস্যুতে আলোচনার দাবিতে হাতে একদমই সময় নেই বিরোধীদের। শুক্রবার সংসদে প্রাইভেট মেম্বার্স বিল পেশ হওয়ার কথা৷ আগামী সপ্তাহে চারটি কাজের দিন, তারপরেই শেষ হবে সংসদের বাদল অধিবেশন৷ এই পরিস্থিতিতে রাজ্যসভায় মণিপুর ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য রাখার সম্ভাবনা যে একেবারেই ক্ষীণ, সেটা হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছে বিরোধী শিবির৷ এই কারণেই বৃহষ্পতিবার রাতে কিছুটা হতাশ গলায় বিরোধী শিবিরের প্রতিনিধি রাজ্যসভার এক সাংসদকে বলতে শোনা যায়, ‘আইন শৃঙ্খলা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ বিষয়৷ এই মর্মে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে যদি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বক্তব্য রাখেন, তাহলে তাতে আপত্তি কিভাবে করা যায়, তার উপায় খুঁজে দেখতে হবে আগে৷’
সংসদীয় রাজনীতিতে নিছক মুখরক্ষার তাগিদে বিরোধী শিবিরের প্রস্তাবিত এই ‘মধ্যম পন্থা’ নিয়ে আড়াআড়ি বিভাজন দেখা দিয়েছে খোদ বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের অন্দরমহলেই। এদিন সংসদীয় পরিসরে মণিপুর নিয়ে শাসক-বিরোধী বৈঠক শুরু হওয়ার আগেই কংগ্রেস সভাপতি তথা বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়গে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন, ‘বিরোধীরা তাদের অবস্থান থেকে একইঞ্চিও সরবে না। আমাদের দাবি রুল ২৬৭ অনুযায়ী মণিপুর নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এবং সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি।’ কিন্তু এদিন বৈঠকের শেষে অপ্রত্যাশিত ভাবেই আত্মপ্রকাশ হয় বিরোধী শিবিরের ‘মধ্যম পন্থা’র অর্থাৎ রুল ১৬৭ অনুযায়ী, ১৬৮ রুলে নোটিস পেশ করে প্রস্তাবনার বিরুদ্ধে আলোচনা এবং ভোটাভুটির প্রস্তাব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বামদলীয় সাংসদের মতে, সরকারপক্ষকে রুল ১৬৭ প্রস্তাব দেওয়ার আগে অন্য বিরোধী দলগুলির সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। কংগ্রেস, তৃণমূল ব্যতিত কমবেশি বেশ কিছু দলের তরফে এহেন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দেখা গেছে ‘অনাস্থা’। স্বয়ং কংগ্রেস লোকসভা দলনেতা অধীর চৌধুরীকে রেগে-মেগে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়।
বৃহস্পতিবারের সংসদীয় অধিবেশন শেষ হওয়ার পরে স্ব-অবস্থান নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন বিরোধী শিবিরের একটা বড় অংশ৷ কেন এমন ভাবনা তার তত্বতালাশ করতে গিয়ে প্রথমেই সামনে এসেছে বিরোধী শিবিরের প্রাথমিক ঘোষিত অবস্থান যেখানে দাবি করা হয়েছিল মণিপুর ইস্যুতে যতক্ষণ না প্রধানমন্ত্রী মোদি সংসদ কক্ষে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও বিল সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নেবে না বিরোধী শিবির৷ তাহলে দিল্লি অর্ডিন্যান্স বিল নিয়ে বৃহষ্পতিবার লোকসভায় আলোচনায় কেন রাজি হল বিরোধী পক্ষ? ইন্ডিয়া জোটের কয়েকজন সদস্য, বিরোধী শিবিরের প্রতিনিধি সাংসদরাও একই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী বৈঠকে, দাবি সংসদীয় সূত্রের৷ লোকসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে এদিন একই প্রশ্ন তুলে বিরোধী জোটকে নিশানা করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ৷ এর পাল্টা ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিরোধী শিবিরের সদস্য তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ শান্তনু সেনের দাবি, ‘দিল্লি অর্ডিন্যান্স বিলটি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় আঘাত হানছে৷ এই বিল অসাংবিধানিক, অনৈতিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার নির্দশন স্বরূপ৷ দেশের সংবিধানিক মূল্যবোধ এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সুরক্ষার জন্যই এই বিলের বিরোধিতায় অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিরোধী জোট৷’ কিন্তু মণিপুর ইস্যুতে বিরোধী শিবির প্রস্তাবিত ‘মধ্যম পন্থা’ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের প্রতিনিধিরা।