Sunday, May 5, 2024
Homeকলামঅভাব না থাকে যদি থাকে না ঈশ্বর

অভাব না থাকে যদি থাকে না ঈশ্বর

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

শিলিগুড়ির এক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অর্থনীতির পরীক্ষার শেষে প্রশ্নপত্র জমা দিয়ে দিব্যি উত্তরপত্র নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। তার বাড়ি থেকে উত্তরপত্র আনার ব্যবস্থা করেন পরীক্ষকরা। রায়গঞ্জের দেবীনগরের এক পরীক্ষার্থী তার পরের দিনই এডুকেশন পরীক্ষা দিতে ভুলে গিয়ে বাড়িতে বসে রইল। পরে স্কুলের শিক্ষকরা বাড়ি গিয়ে তাকে নিয়ে আসেন পরীক্ষাকেন্দ্রে। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক, তিন পক্ষেরই কী দুর্দশা, তা বুঝিয়ে দিয়ে যায় দুটো টাটকা ঘটনা। সবাই এত দেরিতে ঘুম থেকে জেগে ওঠা বদভ্যেস করে ফেলেছেন যে কিছু বলার নেই।

আমাদের বাংলায় সব পার্টির নেতাদেরও এভাবে দেরিতে জেগে ওঠা অভ্যাস বহুদিনের। সন্দেশখালি নিয়ে সবাই এত চ্যাঁচামেচি করছেন, যেন এ সব ঘটনা নতুন হচ্ছে। বাস্তবে বহু বছর ধরে উত্তর ও দক্ষিণ, দুই ২৪ পরগনার বেশ কিছু অঞ্চলে সব নেতাই ত্রাস হয়ে উঠেছেন। এক একটা পকেটে এক এক পার্টি। তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম।

সুন্দরবনের অসংখ্য গ্রামে বহু যুগের প্রথা এসব। এক পদ্ধতিতে গৃহস্থের ধানি জমিতে, বহুদিনের লালিত মাছের ভেড়িতে লোনা জল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রতিশোধ নিতে। রাতের বেলা আঁধারে সাংকেতিক হুমকির বন্যা বয়েছে। নারী পাচারকারীর সঙ্গে জলদস্যুরা দাপট দেখিয়েছে বারবার। এক একটা ঘাটে তোলাবাজির বান ডেকেছে। বিকেল থেকে জনবিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশ থেকে ইচ্ছেমতো লোক এসেছে, ফিরে গিয়েছে। খাটানো হয়েছে বিনা মজুরিতে। সব পার্টির নেতারা জানতেন। অথচ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি গুন্ডাদের বিরুদ্ধে।

সিপিএমের আমলে সিপিএম নেয়নি, তৃণমূলের জমানায় তৃণমূল নিচ্ছে না, কেন্দ্রে বিজেপিও উচ্চবাচ্য করেনি। সন্ত্রাসের মু্ক্তাঞ্চল হয়ে ওঠা সব পার্টি দেখে গিয়েছে শুধু। এখন চ্যাঁচালে হবে? সব পার্টিতেই একাধিক ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আজ। শাহজাহানকে যেমন তৈরি করে গিয়েছেন জেলবন্দি বালু মল্লিক। অপরিসীম ক্ষমতা দিয়ে। সন্দেশখালি-হিঙ্গলগঞ্জের জেটি, রাস্তা, স্কুলের উন্নতি হয়েছে অবশ্যই। তবে বালুর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনদের আড়ালে চলে গিয়েছে উন্নতি।

লোকসভা ভোট সামনে না থাকলে এত হইচই কি হত বালুর ৈতরি দানবদের নিয়ে? এখন সব কুমিরের কান্নার মতো শোনাচ্ছে। গ্রামে যত গরিব থাকেন, তত কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলের লাভ। মৃণাল সেনের কোরাস ছবিতে রবি ঘোষের সেই গানের মতো- ‘রাজা বলে জ্ঞানীগণ শুনো মন দিয়া/কোথায় অভাব নাই বলো বোঝাইয়া/পণ্ডিতেরা বলে তারে সহজ উত্তর/অভাব না থাকে যদি থাকে না ঈশ্বর/অভাব সৃজিয়া বিধি ধর্মে রাখে মন/আর এই ভাবে ভক্তে-দেবে প্রগাঢ় মিলন/করো অভাব বরণ পাবে দেবের চরণ।’

তৃণমূল একদিকে শিখ আইপিএস অফিসারের জন্য সরব হলে বিজেপি ঢাল করতে থাকে হাওড়ার শিখ বিজেপি নেতার মারধরের ভিডিও। দিনহাটার সাহেবগঞ্জে বিজেপি কর্মী রাতের বেলা পিঠে তৈরির অভিযোগ করেন উদয়ন গুহদের বিরুদ্ধে। উদয়ন আবার ভদ্রমহিলার ভিডিও পোস্ট করে দেন। এসব ভোটারদের নিয়ে ছেলেখেলার মতো শোনায়। এই দাবার চালগুলো অতি বোকা বোকা এবং পুরোনো। এক অপরাধ ঢাকতে পুরোনো অপরাধকে অস্ত্র করাটাও এখন রাজ্যের তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেসের নেতাদের কাছে জলভাত। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি প্রথমেই নয়াদিল্লিতে যেভাবে সন্দেশখালিতে ধর্ষণ ঘিরে হিন্দু-মুসলমানের মিথ্যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন, তা তো ক্ষমার অযোগ্য। সাধারণ মানুষ এসব বললে গ্রেপ্তার হতেন না?

নেতাদের মতোই নিজেদের হাস্যকর করে তুলেছে জাতীয় কমিশনগুলো। সিবিআই-ইডি যেমন বেছে বেছে বিরোধী রাজ্যে যাচ্ছে, সেভাবে রেখা শর্মা অ্যান্ড কোং হাজির সন্দেশখালিতে। একই গতে তুলছেন রাষ্ট্রপতির শাসনের দাবি। ওঁরা উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডে ঝামেলা হলে ওদিকের ছায়া মাড়াবেন না নিশ্চিতভাবে।

সন্দেশখালি, সন্দেশখালি আমরা করে যাচ্ছি। জানি কি আসলে, সন্দেশখালির মানচিত্র আসলে কেমন? সুন্দরবনের কত গহীনে ব্লকের শেষ গ্রাম? ঠিক কোন এলাকাজুড়ে শাহজাহানের দাপট? বিস্তৃত সন্দেশখালির বাকি অংশের মানুষ কীরকম ভাবে বেঁচে আছেন? সন্দেশখালির এক নম্বর ব্লকে মাটবারি, চুঁচুড়া, আগরহাটি, রাজবাড়ি, নাটকোরা, ফকিরটাকিয়ার মতো অসংখ্য গ্রামের যাতায়াতের কত সমস্যা। বিদ্যাধরী, কালিন্দী, ডাসা নদীর জলের জন্য আতঙ্কে থাকতে হয় বারোমাস। সন্দেশখালি দু’নম্বর ব্লক আরও দক্ষিণে, আরও সমুদ্রের কাছে। দুর্গম। কলকাতা থেকে পৌঁছাতে দিন চলে যায়। খুলনা, মণিপুর, দুর্গামণ্ডপ- নামে জায়গা আছে সেখানে। আর আছে চিমটা, কুমিরমারি। একদিন হঠাৎ ফেরিতে গিয়ে টোটো ধরে হেঁটে গিয়ে দেখে এসে সব সিদ্ধান্ত নিলে, বক্তৃতা করলে হবে?

এক মিনিট দাঁড়ান। আমরা সন্দেশখালি সন্দেশখালি বলছি। শুধু কি সন্দেশখালি? আমরা নদীর ওপারে, সীমান্তের ধারে হিঙ্গলগঞ্জের গ্রামগুলোর কথা বলছি না। ওদিকের গ্রামগুলোতেও এইভাবে মস্তানরাজ চলে সব পার্টির। এত দুর্গম জায়গায় অনেক গ্রাম, যাওয়াই যায় না সেখানে। সেখানকার শাহজাহান, শিবু, উত্তমদের দাপট কে থামাবে? যারা সিপিএম থেকে মুহূর্তে তৃণমূল হয়ে আবার বিজেপি হয়ে, শাসকের জার্সিতে সাধারণের ওপর অত্যাচার করে। ওই সব এলাকার আরও কয়েকজন শাহজাহানকে ইডি ধরতে গেলে হয়তো স্পষ্ট হবে, কত তীব্র সমস্যার মধ্যে বেঁচে মানুষ। কোনও পার্টির নেতারাই তাঁদের কথা বলেন না।

সন্দেশখালিতে নেতাদের কাজ অনেকটাই দেিখয়ে গিয়েছেন বিশিষ্ট ফরাসি লেখক প্রয়াত ডমিনিক লাপিয়ের। ১৯৮১ থেকে বছরের পর বছর। ভাসমান ডিসপেনসারি করে, যক্ষ্মা-কুষ্ঠ সামলে, ডাকাতদের মূলস্রোতে এনে। শুধু সন্দেশখালি নয়, গোসাবা-কুলতলি-বাসন্তীতেও। রাজ্য বা কেন্দ্র যা পারেনি, তাই করেছেন লাপিয়ের। কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে দেখিয়েছেন, ভোটের রাজনীতির বাইরেও কী ভাবে উন্নয়ন হয়।

গত চল্লিশ বছরে গোসাবা থেকে পাথরপ্রতিমার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যতটা উন্নয়ন হয়েছে, পর্যটনের বান এসেছে, সন্দেশখালি-হিঙ্গলগঞ্জের দিকে তা হয়েছে কি? আদৌ হয়নি। সব থেমেছে টাকির কাছে। সন্দেশখালি-হিঙ্গলগঞ্জ ভৌগোলিক কারণে আগের মতোই ভয়ংকর দুর্গম থেকে গিয়েছে। মানুষের কাছে অনেক দূরের হয়ে থেকেছেন কলকাতার নেতারা। ওই দ্বীপগুলোর তুলনায় উত্তরবঙ্গই বরং কাছের কলকাতার। বড় নেতারা ওদিকে কেউ চট করে যান না। গেলে বুড়িছোঁয়ার মতো, একটা বড় গঞ্জে গিয়ে ফিরে আসা। হতমান গ্রামের মানুষের কাছে শাহজাহান, শিবুরাই হয়ে উঠেছেন মমতা বা িদলীপ ঘোষ বা বিমান বসু। আর একটা নতুন জেলা না হওয়া পর্যন্ত এটাই চলবে।

সন্দেশখালির ভোট ইতিহাস বলছে, ১৯৬৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত, দশবার বিধায়ক সিপিএমের। মাঝে ১৯৭২ সালে আসে শুধু কংগ্রেস। সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রী কান্তি বিশ্বাস বিধায়ক ছিলেন দু’বার। শেষ দু’বারের বিধায়ক তৃণমূলের সুকুমার মাহাতো। তাঁরা কী করেছেন সন্দেশখালির সামাজিক উন্নয়নে? নদীর ওপারে হিঙ্গলগঞ্জেও অবিকল এক প্যাটার্নে বিধায়ক এসেছেন। দশবার সিপিএম, একবার কংগ্রেস। শেষ দু’বারের বিধায়ক তৃণমূলের দেবেশ মণ্ডল। তাঁরাও শাহজাহান-শিবুদের কিছু করতে পারেননি। কলকাতায় উপযুক্ত জায়গায় নালিশ করার পথও দেখাননি।

আসলে এখন দুই চব্বিশ পরগনায় অনেক সন্দেশখািল, অনেক শিবু আর শাহজাহান। দমিনেক লাপিয়েররাও আর নেই। এবং সব পার্টির নেতারা সেই সার সত্য জানেন মৃণাল সেনের রাজনৈতিক ছবির গানের মতো- অভাব না থাকে যদি থাকে না ঈশ্বর।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Kickboxing | বাবা রাজমিস্ত্রী, কিকবক্সিংয়ে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় সোনা জিতল ছেলে ও মেয়ে

0
বেলাকোবা : বাবা পেশায় রাজমিস্ত্রী। সেই পরিবারেরই ছেলে ও মেয়ে দু’জনেই রাজ্য জুনিয়র কিকবক্সিং প্রতিযোগিতায় সোনার পদক জিতে আনল। গত ৪ ও ৫ মে...

Cough syrup smuggling | সাইকেলের যন্ত্রাংশের আড়ালে কাফসিরাপ পাচারের চেষ্টা! বানচাল করল পুলিশ ও...

0
শিলিগুড়ি: গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর আগেই অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ কাফসিরাফ উদ্ধার করল পুলিশ। সঙ্গে ফুলবাড়ির জিয়াগঞ্জ এলাকা থেকে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারও করে নিউ জলপাইগুড়ি থানার...

Siliguri | কখনও রাস্তায় শুয়ে পড়ছেন, কখনও হুমকি দিচ্ছেন! রিকশাওয়ালাকে সামলাতে নাজেহাল ট্রাফিক

0
শিলিগুড়ি: ভেনাস মোড়ে  রবিবারের সকালে কার্যত তাণ্ডব করতে দেখা গেল এক রিকশা চালককে। কখনও তাঁকে দেখা যায় ভেনাস মোড়ের এই মাথা থেকে সেই মাথায়...

Sandeshkhali Viral video | সিবিআইয়ের ক্ষমতা থাকলে আমাকে বাড়ি থেকে তুলুক, বিজেপিকে তোপ অভিষেকের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ সন্দেশখালির স্ট্রিং অপারেশনের ভাইরাল ভিডিওকে কেন্দ্র করে তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি। বিজেপির দাবি প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ভিডিও বানানো হয়েছে রাজনৈতিক...

Bagdogra | খুনের এক মাস পর ভুবনেশ্বর থেকে গ্রেপ্তার অভিযুক্ত আইনজীবী

0
বাগডোগরা: খুনের ঘটনায় (Murder Case) এক মাস ফেরার থাকার পর গ্রেপ্তার হল অভিযুক্ত আইনজীবী (Lawyer Arrested) রজত চক্রবর্তী। তবে ঘটনায় আরেক অভিযুক্ত রজতের স্ত্রী...

Most Popular