- অজন্তা সিনহা
বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি মিশ্রিত খিচুড়ি ভাষার বহুল ব্যবহার ইদানীং আমাদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তারই পাশাপাশি এখন যেটা বাড়তি অত্যাচার যুক্ত হয়েছে, সেটা বাংলা ভাষার ভুল ও খারাপ উচ্চারণ, অনুপযুক্ত শব্দের প্রয়োগ ও অসংলগ্ন বাক্য বিন্যাসের প্রাদুর্ভাব। সিনেমায় এখনও ততটা না হলেও বাংলা টেলিভিশন, পডকাস্ট, ওয়েব সিরিজের ক্ষেত্রে বিষয়টা আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে ক্রমশ। সিকোয়েন্স নির্মাণে, কথোপকথনে প্রতি পদে ব্যাকরণ মেনে চলার আবশ্যকীয়তার কথা আমি বলছি না। কিন্তু সংলাপ বা নেপথ্য ভাষণের ক্ষেত্রে ভাষার ন্যূনতম গঠন প্রণালী অনুসরণ করা কি জরুরি নয়? ভাষা দিবস গেল দু’দিন আগে। সেজন্য কথাটা মনে হচ্ছে বারবার।
সবচেয়ে অস্বস্তি হয় বিভিন্ন পডকাস্ট চ্যানেলে প্রচারিত অডিও ড্রামাগুলি শুনলে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের রমরমার যুগে এই মাধ্যমটি কী পরিমাণ বিস্তার লাভ করেছে, সে ব্যাপারে আমরা সকলেই ওয়াকিবহাল। কয়েকটি চ্যানেল বাদ দিয়ে বাকিদের বাংলা ভাষা (হিন্দি বা ইংরেজিও তথৈবচ) নিয়ে অশিক্ষা, অবহেলার জায়গাটি ভয়াবহভাবে প্রকট। ব্যাকরণসম্মত উচ্চারণের সঙ্গে যে একটি শব্দের অর্থ নির্ভর করে, একথা অনেকেই মনে রাখেন না। বাঁশ হয়ে যায় বাস। বাস হয়ে যায় বাশ। র, ড়, শ, ষ, স নিয়ে দ্বন্দ্ব, দুটি স্বরবর্ণ পাশাপাশি থাকলে কীভাবে তার উচ্চারণ হবে, প বর্গের বর্ণগুলি কোন পদ্ধতিতে উচ্চারণ করা উচিত–ভাবনার আশপাশে কোথাও এসব নেই।
সংলাপের ক্ষেত্রে একই ব্যক্তিকে পরপর দুটি বাক্যে ‘তুমি’ ও ‘আপনি’ দু’রকম সম্বোধনই করা হতে পারে। এমন গুরুচণ্ডালি দোষ প্রায়ই কানে লাগে। আর শ্লীল-অশ্লীলতার প্রসঙ্গ না তোলাই ভালো। যাঁরা শ্রোতা, তাঁরাও মন্তব্য করার ক্ষেত্রে যে বাংলা ভাষার প্রয়োগ করেন, সেটা একশোভাগ খিচুড়ি তো বটেই। তারই সঙ্গে তাঁদের প্রশংসা-উচ্ছ্বাসে ঢাকা পড়ে যায়, মুষ্টিমেয় শ্রোতার যথার্থ বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যতে মাতৃভাষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তার আশঙ্কা! ভাষার ভুল প্রয়োগ যে এভাবেই পর প্রজন্মেও প্রবাহিত হচ্ছে, সেটা কি একেবারেই অমূলক ?
পাঠক দয়া করে এটা বলবেন না, ‘আমি তো নিতান্তই একজন ছাপোষা মানুষ। সিনেমা-টিভি-ওয়েব সিরিজ-পডকাস্ট-এ কে কী বলছে বা কীভাবে বলছে, তাতে আমাদের কী’? আজ্ঞে না, আপনাদেরও দায় আছে। আপনি একজন উপভোক্তা শুধু নন, একজন বাঙালিও বটে! শুধু বিনোদিত হওয়াই আপনার একমাত্র কাজ নয়। এখানে বিনোদনের মাধ্যম হল সেই ভাষা, যা আপনার পরিচয় এবং সংস্কৃতির ধারক-বাহক। এর ভালোমন্দ বিচার করার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না আপনি।
একজন ভণ্ড, আত্মপ্রতারক জাতির প্রতিনিধি রূপে আজকাল নিজেকে বেশ চিনতে পারি। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই নিজেকে বাঙালি ভেবে আত্মশ্লাঘা অনুভব করি। প্রমাণস্বরূপ গুড মর্নিং মেসেজে বং সংস্কৃতির ধ্বজা ওড়াই এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর ছবি ও কর্মকাণ্ড পোস্ট করি। যাঁরা ঢাকার শহিদ বেদির সামনে দণ্ডায়মান অবস্থায় ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে সেই সব ছবিতে ছবিতে ছয়লাপ করে দেন ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম। কিন্তু ওই যে বলেছি ভণ্ড–তাই, দিবারাত্র বিভিন্ন বিনোদন প্ল্যাটফর্মে সেই বাংলাভাষার চরম অপমান দেখলেও চোখ-কান বন্ধই রাখি আমরা।
(লেখক সাংবাদিক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)