জ্যোতি সরকার ও অভিরূপ দে, জলপাইগুড়ি ও ময়নাগুড়ি : মন্ত্রী বুলু চিকবড়াইকের মেয়ে শুধু নন, আদালতের নির্দেশে চাকরি খোয়ানোর অপেক্ষায় জলপাইগুড়ির বেশ কিছু তৃণমূল নেতা-নেত্রীর ঘনিষ্ঠরা। কোথাও একই পরিবারের একাধিক সদস্যও রয়েছেন তালিকায়। একের পর এক নাম প্রকাশ্যে আসতেই বিঁধতে শুরু করেছে বিরোধীরা। যদিও বিষয়টিকে খুব বেশি আমল দিতে নারাজ তৃণমূল। তাই মুখে আইনি লড়াইয়ে কথা বলে দুর্নীতির অভিযোগ আড়াল করতে চাইছেন নেতারা।
হাইকোর্ট যে ৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে সেই তালিকায় জ্বলজ্বল করছে জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের সহকারী সভাধিপতি দুলাল দেবনাথের ছেলে রাহুল আমিনের নাম। শুধু ছেলেই নন, চাকরি হারানোর অপেক্ষায় দুলালের পুত্রবধূ মেহনাজ নুরও। রাহুল চাকরি করতেন দশদরগা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তাঁর স্ত্রী কর্মরত ছিলেন নাওয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাড়ির দুই সদস্যের চাকরি বাতিল হতে চললেও দুলাল নির্ভীক। তাঁর কথায়, বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারের তরফে আপিল করা হবে। বিষয়টির উপর আমরা নজর রাখছি। এলাকায় কানাঘুষো, শুধু পুত্র ও পুত্রবধূই নয়, ওই তালিকায় দুলালের আরও এক ঘনিষ্ঠের নাম রয়েছে। যদিও তা মানতে চাননি তিনি।
জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ পদে রয়েছেন গীতা রাজবংশী। তিনিও স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আদালতের নির্দেশে তাঁরও চাকরি যাওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা। গীতা বলছেন, আমাদের চাকরির সমস্ত নথি যথার্থ রয়েছে। কেন প্যানেল বাতিল করা হল তা নিশ্চয়ই আমরা আইনগত দিক থেকে খতিয়ে দেখব। বিষয়টি এখন প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ দেখছে। পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে আইনি পদক্ষেপ করব। জলপাইগুড়ি পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাক্তন কাউন্সিলার সম্রাট রায়চৌধুরীর স্ত্রীর নামও রয়েছে বাতিলের তালিকায়।
ময়নাগুড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শিবম রায়বসুনিয়া ও তাঁর আত্মীয় শতাব্দী রায়বসুনিয়া, রেশ্মিতা রায়বসুনিয়া সহ বেশ কয়েকজনের চাকরি বাতিল হতে চলেছে। শিবম বাড়ি থেকে সামান্য দূরে জল্পেশ এলকে মাধ্যমিক স্কুল সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। রেশ্মিতা ২০১৭ সাল থেকেই চাকরি করেন বাড়ির পাশে ময়নাগুড়ি ভুস্কাডাঙ্গা ১ নম্বর বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শতাব্দী একই বছর থেকে চাকরি করছেন ময়নাগুড়ি রাজারহাট সংলগ্ন গুরুচরণ বিদ্যাপীঠে। শিবমের বাবা শশাঙ্ক রায়বসুনিয়া বর্তমানে জলপাইগুড়ি জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সিনিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট। যে সময় শিবম, রেশ্মিতাদের নিয়োগ হয়েছিল তখন শশাঙ্ক ময়নাগুড়ি-২ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি ছিলেন।
শশাঙ্ক-ঘনিষ্ঠ ময়নাগুড়ি পঞ্চায়েত সমিতির কৃষি কর্মাধ্যক্ষ বিমলেন্দু চৌধুরীর স্ত্রী সঞ্চিয়া নন্দীও একই সময় চাকরি পান। সঞ্চিতা ময়নাগুড়ি স্টেশন লাগোয়া সুভাষপল্লি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত।
শশাঙ্ক-ঘনিষ্ঠ এতজন একসঙ্গে চাকরি পাওয়ার পরই বেআইনিভাবে নিয়োগ হয়েছে, এই অভিযোগ তুলে ২০১৭ সালে আলাদাভাবে আন্দোলনে নেমেছিল বামফ্রন্ট ও বিজেপি। ময়নাগুড়ির একাধিক জায়গায় এঁদের নাম দিয়ে পোস্টারও সাঁটা হয়েছিল। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে চাকরি বাতিলের তালিকায় এঁদের নাম দেখে তাই আবারও বেআইনি নিয়োগের প্রসঙ্গ টেনে আনছে বিজেপি।
শিবম বলছেন, বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। তাই এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। স্ত্রীর চাকরির বিষয়ে বিমলেন্দুর মন্তব্য, হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার নাম রয়েছে বাতিলের তালিকায়। সবাই যে পদক্ষেপ করবে আমরাও তাই করব।
এদিকে, হাইকোর্টের নির্দেশে চাকরি বাতিলের তালিকায় তৃণমূল নেতা সহ ঘনিষ্ঠদের নাম থাকায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছে তৃণমূলকে। ময়নাগুড়ি ব্লক কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ঘোষাল বলছেন, শিক্ষিত যোগ্য ছেলেমেয়েদের বদলে শুধুমাত্র পয়সার বিনিময়ে বেআইনিভাবে তৃণমূল নেতাদের পরিবারের লোকেরা চাকরি পেয়েছে। তালিকায় যেসব যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন তাঁদের পুনর্বহাল করা জরুরি।
সিপিএমের জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হরিহর রায়বসুনিয়ার বক্তব্য, নিয়মের তোয়াক্কা না করে অযোগ্যদের নিযোগ করা বিষয়টি আদালতের রায়ে প্রতিফলিত হয়েছে। শুরু থেকেই আমরা অযোগ্যদের নিয়োগের বিরোধিতা করে আসছি, এখনও বিরোধিতা করি।
বিজেপির জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক বাপি গোস্বামীর কথায়, অযোগ্য শিক্ষকদের চাকরি বাতিলের দাবিতে আমরা লাগাতার আন্দোলন করছি। প্রযোজনে আরও আন্দোলন করব। জলপাইগুড়ি জেলা তৃণমূল সভানেত্রী মহুয়া গোপের প্রতিক্রিয়া জানতে তাঁকে একাধিকবার ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি।
এদিকে, নিযোগ দুর্নীতি নিয়ে আন্দোলনের কথা শুনিয়েছে নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক ধ্রুবশেখর মণ্ডল বলছেন, আগামী ১৬ মে রাজ্য প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ দপ্তর ঘেরাও করব আমরা। পরবর্তীতে জেলার প্রতিটি পর্ষদের অন্যায়ে বিরুদ্ধে ঘেরাও অভিয়ান চলবে।