- রন্তিদেব সেনগুপ্ত
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় আগেই বলেছিলেন, মোদি সরকারের চালু করা নির্বাচনি বন্ড একটি অস্বচ্ছ এবং অনৈতিক প্রক্রিয়া। এর ফলে বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠীগুলি সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা পেতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও কলুষিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের ধমক খাওয়ার পর স্টেট ব্যাংক এখনও পর্যন্ত নির্বাচনি বন্ড সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতেই বোঝা যাচ্ছে চন্দ্রচূড়ের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। শুধু তাই নয়, এমনও সন্দেহ করার অবকাশ থেকে যাচ্ছে যে, নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে পার্টি তহবিলে টাকা ঢেলে যাবতীয় অভিযোগ থেকে ছাড় পাওয়ার ব্যবস্থাটি কায়েম হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইডি এবং আয়কর দপ্তরের মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে।
নির্বাচনি বন্ড সংক্রান্ত যে তথ্য ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু সংস্থায় ইডি বা আয়কর দপ্তর হানা দেওয়ার পরই তারা তড়িঘড়ি নির্বাচনি বন্ড কিনেছে। এবং অত্যাশ্চর্যভাবে নির্বাচনি বন্ড কেনার পর সেইসব সংস্থায় আর কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা কোনও রকম অভিযান চালায়নি। এদের মধ্যে রয়েছে ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস। এরা ১৩৬৮ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। এই সংস্থার কর্ণধার লটারি সম্রাট সান্তিয়াগো মার্টিন, যাঁর বিরুদ্ধে বহু আর্থিক অভিযোগ রয়েছে। যাঁর সংস্থায় এর আগে বহুবার আয়কর হানা হয়েছে। ২০২২ সালের ২ এপ্রিল এই সংস্থায় ইডি হানা দেয়। তার পরই ৭ এপ্রিল থেকে এরা বন্ড কিনতে শুরু করে। এর পর এদের সংস্থায় আর কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা হানা দেয়নি। তেমনই অন্ধ্রপ্রদেশের মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এরা অন্ধ্রপ্রদেশের রেড্ডি পরিবারের সংস্থা। সিএজি রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছিল, অন্যায্যভাবে এদের অতিরিক্ত টাকা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এদের সংস্থাতেও আয়কর হানা হয়। নির্বাচনি বন্ড কেনার পর অবশ্য এরা আর কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থার হানাদারির মুখে পড়েনি। বেদান্ত গোষ্ঠী। এদের বিরুদ্ধে ছত্তিশগড় এবং ওডিশায় জঙ্গল কেটে সাফ করে, জনজাতিদের উচ্ছেদ করে খনি ব্যবসা করার দীর্ঘ অভিযোগ রয়েছে। এদের দপ্তরেও ইডি, আয়কর প্রভৃতি কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি বিভিন্ন সময়ে হানা দিয়েছে। প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনি বন্ড কেনার পর এরাও কোনওরকম হানাদারির মুখে পড়েনি। তালিকা আর দীর্ঘ করছি না। নির্বাচনি বন্ডে টাকা ঢালার পর কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির হানাদারির হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে এরকমই চোদ্দোটি সংস্থার হদিস পাওয়া গিয়েছে।
এই সংস্থাগুলির সবার বিরুদ্ধেই চালু হওয়া তদন্তগুলিও কোনও রহস্যজনক কারণে এখন বন্ধ হয়ে রয়েছে।
শুধু এরা নয়। বন্ড কেনার পর বিপুল অঙ্কের কেন্দ্রীয় সরকারি কাজের বরাত পেয়েছে এমন সংস্থার তথ্যও সামনে এসেছে। সিরডি সাঁই ইলেক্ট্রিক্স নামক একটি সংস্থা ২০২৩ সালে নির্বাচনি বন্ডে টাকা ঢালে। এরপর এই সংস্থাটিকে পিএম কুসুম প্রকল্পে ১৫৪০ কোটি টাকার বরাত দেওয়া হয়েছে।
এইসব তথ্যই কিন্তু নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিরোধীরা বলছে, এই সংস্থাগুলি নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে বিজেপির তহবিলে টাকা ঢেলে কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত এড়াচ্ছে। সেইসঙ্গে বিরোধীরা এই অভিযোগও করেছেন, ভয় দেখিয়ে এইভাবে টাকা তোলার কাজে ইডি, আয়কর দপ্তরের মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি এইসব অভিযোগকে অস্বীকার করেছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছেন, বিজেপির তহবিলেই যে এইসব টাকা এসেছে এরকম ভাবার পিছনে কোনও যুক্তি নেই।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এরকম বলবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সহজ স্বাভাবিক বুদ্ধিতে বিচার করলে তাঁর বক্তব্য কিন্তু ধোপে টিকছে না। নির্বাচনি বন্ড সংক্রান্ত তথ্যে ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে, বিজেপির তহবিলে সব থেকে বেশি টাকা ঢুকেছে। এক্ষেত্রে বিজেপির ধারেকাছেও কেউ নেই। শুধু নির্বাচনি বন্ড নয়, প্রুডেন্ট ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট নামক নির্বাচনি তহবিলের ৭৫ শতাংশ টাকা বিজেপির তহবিলেই গিয়েছে। প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এই তহবিলে টাকা জমা দেওয়ার পরই তা তড়িঘড়ি বিজেপির তহবিলে পাঠানো হয়েছে। যেমন, ফিউচার গেমিং ২০২১-এর ২৩ এবং ২৪ মার্চ দু’দিনে ৫০ কোটি করে টাকা প্রুডেন্ট তহবিলে জমা দিয়েছিল। পুরো টাকাটাই চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর বিজেপির তহবিলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ আর বেশি দীর্ঘ করলাম না।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবেই। মনে হবেই, গন্ধটা একটু সন্দেহজনক। নির্বাচনি তহবিলে বাকিদের দশ গোল দিয়ে এগিয়ে আছে যে দলটি— তার তহবিল এভাবে ভরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কারা নিয়েছে। প্রশ্ন উঠবেই যে, ইডি, আয়কর দপ্তরের মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি হানা দেওয়ার পরই এই সংস্থাগুলি নির্বাচনি বন্ডে টাকা ঢালতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কেন? এই প্রশ্নও উঠবে, নির্বাচনি বন্ডে টাকা ঢালার পর এই সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে যাবতীয় তদন্ত হিমঘরে চলে গেল কেন? নির্মলা সীতারামন যত যা-ই বলুন না কেন, এইসব প্রশ্নের মুখে তাঁর যুক্তি ঠুনকোই শোনাবে। যে কোনও স্বল্পবুদ্ধি মানুষও বুঝতে পারবে, কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি বা তৃণমূল কংগ্রেসের চরণে ফুল বেলপাতা চড়িয়ে কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্তের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। সেটা পেতে গেলে কার চরণে ফুল বেলপাতা চড়াতে হয়, সেটা অতি বোকাও বোধকরি বোঝে।
সন্দেহটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে স্বয়ং স্টেট ব্যাংক। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরও নির্বাচনি বন্ড সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করতে যে গড়িমসি তারা দেখাচ্ছিল, তাতে এই সন্দেহ হচ্ছিলই যে, চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়? তবে সুপ্রিম কোর্টও ছাড়নেওয়ালা নয়। তারা স্টেট ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে, প্রতিটি নির্বাচনি বন্ডের যে আলাদা আলাদা নম্বর রয়েছে তা প্রকাশ করতে হবে। এবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো স্টেট ব্যাংক যদি তা প্রকাশ করে দেয় তাহলেই বোঝা যাবে কে কত টাকার বন্ড কিনে কোন দলের তহবিল ভরিয়েছে।
শেষ অবধি কী হবে তা আমরা জানি না। তবে এটুকু বেশ আন্দাজ করা যাচ্ছে, নির্বাচনি বন্ডের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতিটি এই সময়ের সর্ববৃহৎ দুর্নীতি। কে খেয়েছে আর কে খেতে দিয়েছে— সবকিছুর উত্তরই এই নির্বাচনি বন্ডের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে।