Thursday, May 9, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ভোটার কোথাও আবিষ্কারক, কোথাও দুর্নীতিগ্রস্ত

ভোটার কোথাও আবিষ্কারক, কোথাও দুর্নীতিগ্রস্ত

প্রশ্ন হল, সংসদে যাঁরাই জিতুন, তাতে একেবারে সাধারণ মানুষের লাভ হবে কিছু? নিউ কোচবিহার স্টেশনে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ঘুরে বাচ্চা কোলে পপকর্ন বিক্রি করে বেড়ান এক তরুণী। তাঁর সামগ্রিক লাভ হবে কোনও?

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

চৈত্রের সকালে ট্রেনে শিলিগুড়ি থেকে কোচবিহার যাওয়ার সময় চোখে পড়ে, কীভাবে রেললাইনের দু’পাশে কৃষিজমির ভূগোল-ইতিহাস পালটে যাচ্ছে দ্রুত। কীভাবে বদলেছে চাষের ইতিবৃত্ত। কী জাদুতে ধান-পাটের চিরায়ত সবুজ জমির দখলদার চা এবং ভুট্টা।

শেষ বসন্তে দুই মেদিনীপুর, হাওড়া-হুগলির নীচু জমিতে বোরো ধান বাতাসে ওড়ে এসময়। আর এখানে নিউ দোমোহনি স্টেশন পর্যন্ত রেললাইনের দু’দিকে বিস্তর চা বাগান। সমতলে যে এভাবে গণহারে চা চাষ হতে পারে, আগে কে জানত? ধূপগুড়ির কাছাকাছি দু’তিনটি স্টেশনের লাগোয়া খেতে যথারীতি অজস্র আলুর লাল বস্তা সার দিয়ে রাখা। সেসব ম্লান করে সবুজ ভুট্টা আলো ছড়াচ্ছে সেখানেও। তিস্তা, জলঢাকা বা তোর্ষা পাড়ের উর্বরতর জমিতে ধানের সঙ্গে পাল্লায় ভুট্টা।

আরও একটু কোচবিহারের দিকে এগোলে যে ভুট্টাখেত প্রায় সম্রাট। চিরাচরিত তামাককে ভুলিয়ে। জলপাইগুড়ি? দশ বছর আগে জেলায় ভুট্টা চাষ হত  দেড় হাজার হেক্টর জমিতে। এখন হয় প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে।

সবুজের দৃশ্য বুঝিয়ে দিয়ে যায়, বেশ কয়েক বছরের প্রবণতা আরও প্রাণ পাচ্ছে ইদানীং। বহু পরিচিত ধান এবং পাট যেন নতুন ঘোড়ার দাপটে থমকে দাঁড়িয়ে। জলপাইগুড়ির সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম চাউলহাটি তো চা-হাটি হয়ে গিয়েছে কার্যত। সব কৃষকেরই ধানিজমিতে চা চাষ হচ্ছে। সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ মহেন্দ্র রায়েরও সব জমিতে চা বাগান। ধানিজমিকে চায়ের বাগানে পালটানো কতটা আইনি, কতটা বেআইনি, সে প্রসঙ্গ থাক। আরও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, বিবর্তন। আর্থিক লাভের কথা ভেবে বিবর্তন।

বঙ্গ রাজনীতির আজকের ছবিটা যেন ওই কৃষিজমিগুলোর মতো। কোচবিহারে সাগরদিঘির অদূরে, দু’দিকে সিপিএম ও ফরওয়ার্ড ব্লকের বিশাল অফিসে শূন্যতা। ঠিক যেভাবে শিলিগুড়ি হিলকার্ট রোডে রাস্তার এ পার ও পারে অনিল বিশ্বাস ভবন এবং জগদীশ ভবনে আগের তুলনায় অক্ষয় শূন্যতা। ভুট্টা এবং চায়ের মতো জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে তৃণমূল এবং বিজেপি।

নিলে কী হবে, দুটো পার্টিরই আক্ষরিক অর্থে আজকের স্লোগান ‘ইধার কা মাল উধার, উধার কা মাল ইধার।’ বিজেপি যে দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রার্থীতালিকা ঘোষণা করল, তাতে চমক হল দলবদলিয়াদের ওপর আস্থা রাখা। ভেবে দেখুন, তাপস রায়-অর্জুন সিং-শীলভদ্র দত্ত-কা‌র্তিক পালদের বাছার ক্ষেত্রে কোনও দ্বিধা এবার কাজ করেনি। অথচ যত দ্বিধা ছিল দিলীপ ঘোষকে বাছার ক্ষেত্রে। এই জায়গাটায় আলোকোজ্জ্বল সত্য, রাজ্য বিজেপিতে এখন শুভেন্দু অধিকারী-সুকান্ত মজুমদার জুটি কৃশানু-বিকাশ স্টাইলে খেলছেন। অধিকাংশ প্রার্থী এই দুজনের বেছে দেওয়া। তৃণমূলে যেমন এই দায়িত্বে অভিষেক। শুভেন্দু তৃণমূলে থাকার সময় নিজস্ব লোক তৈরি করেছিলেন। এখন বিজেপিতেও তাঁরাই অনেক ভরসাস্থল। দার্জিলিংয়ে যে হর্ষবর্ধন শ্রিংলাকে জেতা ম্যাচ হারতে হল রাজু বিস্টের কাছে, তার প্রধান কারণও শুভেন্দু-সুকান্তের আপত্তি।

অবশ্যই দল বদলিয়াদের নিয়ে ভোটের পটভূমিতে এত বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা অর্থহীন। তাতে নেতাদের সমস্যা হবে না এতটুকুও। মানুষই এখন অধিকাংশ আদর্শহীন, নীতিভ্রষ্ট হয়ে উঠেছে ক্রমে। কে দল বদল করল, কে কাটমানি খেল, তাঁদের এসে যায় না কিছু। আমরাও জেনে, না জেনে নাম লিখিয়ে ফেলি ওই নেতাদের দলে। আমরা মুখে বলি, কুকথার ভাষণ চাই না। অথচ আমরা বেশি হাততালি দিই দিলীপ ঘোষ বা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুলভ কথা শুনে। তাঁরাও বাড়তি উৎসাহ পেয়ে পালটা বিক্রমে অকথ্য ভাষণ দিতে থাকেন। টিভি এবং মঞ্চে যাঁর যত কুকথা, তাঁর তত বাজার। আমরা বলব, সন্ধ্যায় টিভিতে একই লোকের কলতলার ঝগড়া হয়। তবু আমরাই তা শুনব। আমরা বলি, শিক্ষা দুর্নীতি, কয়লা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া নেতাদের কথা। তাঁরা কি ফুলেফেঁপে উঠতে পারতেন, আমরা এগিয়ে গিয়ে তাঁদের ঘুষ না দিলে?

প্রশ্ন হল, সংসদে যাঁরাই জিতুন, তাতে একেবারে সাধারণ মানুষের লাভ হবে কিছু? নিউ কোচবিহার স্টেশনে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ঘুরে বাচ্চা কোলে পপকর্ন বিক্রি করে বেড়ান এক তরুণী। তাঁর সামগ্রিক লাভ হবে কোনও? শিলিগুড়ি বিধান রোডে অটোস্ট্যান্ডের উলটোদিকে, কোচবিহারে সাগরদিঘির কোণে ‘আমার আদর্শ পথ’ লেখা বোর্ডের নীচে সকালে  ফুল বিক্রি করেন দুই মধ্যবয়সিনী। তাঁদের সামগ্রিক লাভ হবে কোনও? মালদার পাকুড়তলার মোড়ে যে প্রবীণা প্রতি সন্ধেয় কলাইয়ের রুটি, তেলপোয়া ভেজে বিক্রি করেন, তাঁর লাভ হবে কোনও? এই যে ধানিজমিতে ভুট্টা ও ঘরোয়া চা তৈরির অভিনব পথে শরিক হলেন অনেক গৃহস্থ ঘরনি, তাঁদের সামগ্রিক লাভ হবে কোনও? সব পার্টি এখন মুখে মহিলা ভোটারদের উন্নতির কথা বলছে। তবু সামগ্রিক উন্নতি কোথাও যেন থেমে।

বাংলা ১২৭৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ নামে বহুখ্যাত প্রবন্ধ। কত যুগ আগে বুঝতেই পারছেন, ১৫১ বছর হতে চলল। সাহিত্যসম্রাটের কিছু লেখার উদাহরণ দিয়ে ইদানীং অনেকে তাঁকে সাম্প্রদায়িক দেগে দিতে চান অকারণ। সেই বঙ্কিমই এই প্রবন্ধে একসঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান প্রজার দুঃসহ জীবন নিয়ে সোচ্চার হন। কোনও ভেদাভেদ না করে। লিখেছিলেন,  ‘দুই চারিজন অতি ধনবান ব্যক্তির পরিবর্তে ছয় কোটি সুখী প্রজা’ দেশের মঙ্গল এবং শ্রীবৃদ্ধিকে সূচিত করবে। এবং এই ছয় কোটি প্রজার মধ্যে তিন কোটি হাসিম শেখ আর তিন কোটি রামা কৈবর্ত্ত।’

ভেবে দেখুন, আজকের ভারতে, আজকের বাংলাতেও সেই একরকম চূড়ান্ত অর্থনৈতিক অসাম্য নিয়ে কত লেখালেখি করেন বিশ্বকাঁপানো অর্থনীতিবিদরা। রামা কৈবর্ত্ত এবং হাসিম শেখদের যন্ত্রণার শেষ ১৫১ বছরেও হয় না। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই পালটে যায় কৃষকের ভাবনা। কিছু উদ্যোগী অফিসার গ্রামে এসে উৎসাহ দেন, তারপর হারিয়ে যান বদলির ঠেলায়। চরম ঔদাসীন্যের শিকার হয়ে কৃষকসমাজ নিজেরাই বেছে নেন নিজস্ব পথ। তার মধ্যে ঢুকে পড়ে বেআইনি পথে হাঁটা নেতাদের বিশাল টোপ।

মানুষ কোথাও আবিষ্কার করেন নতুন পথ। কোথাও দুর্নীতিবাজ নেতাদের ছোঁয়ায় নিজেরাই হয়ে ওঠেন ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত।

নেতারা বেঁচে যান। তাঁরা এটাই চেয়েছিলেন তো! দুর্নীতরা আর কোন মুখে দুর্নীতিপরায়ণদের সমালোচনা করবে?

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

IPL-2024 | ২২ গজে ট্রাভিস হেডের তাণ্ডব! লখনউকে গোহারা হারিয়ে প্লে-অফে জায়গা পাকা হায়দরাবাদের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ অভিষেক শর্মাকে সঙ্গে নিয়ে ২২গজে ঝড় তুললেন ট্র্যাভিস হেড। ৬২ বল বাকি থাকতেই দুই ব্যাটারের তাণ্ডবে লখনউ সুপার জায়ান্টসকে ১০...

Siliguri Hospital | ওষুধের দোকানের ক্যাশবাক্স খুলে টাকা নিয়ে চম্পট দিল রোগীর পরিজন, শোরগোল...

0
শিলিগুড়িঃ ওষুধের দোকানের ক্যাশবাক্স খুলে সব টাকা নিয়ে হাপিস হয়ে গেল রোগীর এক পরিজন। বুধবার সকালে ঘটনাটি ঘটেছে শিলিগুড়ি হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে।...

Viral | পরীক্ষায় অঙ্কে ২০০-তে ২১২! ভাইরাল মার্কশিটকে ঘিরে নেটদুনিয়ায় চর্চা তুঙ্গে

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: পরীক্ষায় অঙ্কে ২০০-তে ২১২! বর্তমানে পরীক্ষায় কাড়ি কাড়ি নম্বর না পেলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা দায়। এরই মাঝে পুরো নম্বর পাওয়ার...

Raiganj | মেলেনি ফিট সার্টিফিকেট! ২৫শে বৈশাখে এবারও দরজা খুলল না রবীন্দ্র ভবনের  

0
রায়গঞ্জঃ রবীন্দ্রজয়ন্তীতে এবারও বন্ধ থাকল রবীন্দ্র ভবন। ফলে রবীন্দ্র ভবনে রবীন্দ্র মূর্তিতে মাল্যদান ও শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের আয়োজন  করতে পারলেন না রবীন্দ্রপ্রেমীরা। রবীন্দ্র ভবনের...

Sangeeth Sivan | প্রয়াত বিশিষ্ট পরিচালক সংগীত শিবন, শোকের ছায়া বিনোদন জগতে

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: প্রয়াত বিশিষ্ট পরিচালক তথা সিনেমাটোগ্রাফার সংগীত শিবন (Sangeeth Sivan)। বুধবার মুম্বইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে...

Most Popular