সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫

গেটসের চায়ে পে চর্চা ও দুই ডলির গল্প

শেষ আপডেট:

  • অতনু বিশ্বাস

ধনকুবের মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে অনন্তের প্রাক বিবাহ উৎসবে যোগ দিতে আরও অনেকের মতো সম্প্রতি এদেশে এসেছিলেন মার্কিন ধনকুবের এবং মাইক্রোসফটের সহ প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, সে সময় দুনিয়ার ধনীদের তালিকায় তিনি চতুর্থ স্থানাধিকারী। তবে প্রাক বিয়ের ভোজ খাবার সঙ্গে সঙ্গে ভারত সফরে বেশ কিছু ‘চায়ে পে চর্চা’ সারার উদ্দেশ্য তাঁর ছিল নিশ্চয়ই। এমনই একটা ঘটনা– চায়ের পেয়ালায় তুফান- নিয়ে বিস্তর হইচই হল সম্প্রতি।

হ্যাঁ, সেটা পুরোদস্তুর ‘চায়ে পে চর্চা’র ঘটনাই। ঠ্যালাগাড়িতে চলমান নাগপুরের রবীন্দ্রনাথ টেগোর মার্গের এক চা বিক্রেতার কাছ থেকে এক কাপ চা খান দুনিয়ার সেরা ধনীদের অন্যতম বিল গেটস। আর সেই চা খেয়ে তিনি একেবারে অভিভূত। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন সেই চা বিক্রেতার চা তৈরির ভিডিও। সে নিয়ে শোরগোল পড়েছে অনেক। চা বিক্রেতার সঙ্গে বিল গেটসের ছবি ছড়িয়েছে মিডিয়ায়। এমনকি আমূল গার্লের চমৎকার সব কার্টুনের মধ্য দিয়ে ভারত এবং বিশ্বের প্রবহমানতাকে ধরে রাখায় সুপ্রসিদ্ধ আমূল এ নিয়ে তাদের এক কার্টুনও প্রকাশ করেছে, যার নাম দিয়েছে ‘চায়ক্রোসফট’। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যা ‘চায়’ আর ‘মাইক্রোসফট’-এর হাঁসজারু। এর ট্যাগলাইন তারা দিয়েছে, ‘গেটসওয়ে টু টেস্ট’। চমৎকার।

এই চা বিক্রেতার আসল নাম সুনীল পাতিল। তবে ‘ডলি চাওয়ালা’ নামেই সবিশেষ পরিচিত তিনি। এমনিতে অবশ্য তাঁর চা আর পাঁচজন চাওয়ালার মতোই– চা পাতা, দুধ, এলাচ, থেঁতো করা আদা, এসবের মিশ্রণ। আলাদা করে চায়ের মধ্যে বিশেষত্ব কিছু নেই। বিশেষত্ব যেটুকু আছে তা তাঁর চা তৈরির পদ্ধতির মধ্যে এবং সেই চা পরিবেশনার মধ্যে এবং ডলি চাওয়ালার পোশাক, চুলের স্টাইল, রংচঙে চশমা, গলায় চেন এবং অবশ্যই তার প্রাণশক্তির মধ্যে। তাঁর ফ্যাশন সেন্স এবং তাঁর প্রকাশভঙ্গি দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে যে তা সুপারস্টার রজনীকান্তকে দেখে অনুপ্রাণিত। বিল গেটস তাঁর দোকানে চা খেতে আসার আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তার প্রচুর ফলোয়ার। বিল গেটস সেই সংখ্যাটাকে আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছেন নিশ্চয়ই।

বিল গেটস ‘ডলি কি টাপরি’তে চা খেতে গিয়ে এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে ডলির ‘টাপরি চা’-কে আরও খানিকটা পরিচিতি দিয়েছেন বটে, ডলি চাওয়ালা কিন্তু প্রথমে বুঝতেই পারেননি, যে বিদেশি ব্যক্তিটিকে তিনি চা খাওয়াচ্ছেন তিনি আসলে কে। ঘটনার পরের দিন অন্যদের কথা শুনে তিনি নাকি বুঝতে পেরেছেন কে ছিলেন সেই চা খেতে আসা বিদেশিটি। কিংবা, সত্যিই কি তিনি পুরোটা বুঝতে পেরেছেন? খানিকটা হয়তো পেরেছেন পরে সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ দেখে। যাই হোক, বিল গেটস কিন্তু অভিভূত। তিনি ভারতের সবকিছুর মধ্যেই দেখেছেন ‘ইনোভেশন’। এমনকি এক কাপ ‘টি’ তৈরির মধ্যেও দেখেছেন এক ‘ইনোভেশন’ বা ‘সৃষ্টি’কে। অন্তত তেমনটাই বলেছেন তিনি। অবশ্য আর কী-ই বা বলতে পারতেন তিনি!

কিন্তু ‘টি’? ‘চায়’ আর ‘টি’ কি এক হল? না, অবশ্যই নয়। তা যে আলাদা সেটা অবশ্য আমি প্রথম বুঝি চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগে। কানাডার মন্ট্রিয়লে এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয় ডিনার খাবার পরে অভ্যাসবশে অর্ডার করি এক কাপ ‘টি’। যদ্দুর মনে পড়ছে সেই ওয়েটার ছিলেন বাংলাদেশি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন আমি ‘টি’ চাইছি, না ‘চায়’। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, পার্থক্যটা কী। তখনই জানলাম যে, গরম জল, টি ব্যাগ, প্রয়োজনে আলাদা করে চিনি, দুধ মিশিয়ে তৈরি হয় ‘টি’। একেবারে ব্রিটিশ স্টাইলে। আর চা, দুধ, চিনি, এলাচ, আদা, মশলা, ইত্যাদি মিশিয়ে আচ্ছা করে ফুটিয়ে তৈরি হয় ‘চায়’।

যাই হোক, ঘটনাচক্রে ‘ডলি’, ‘টি’ আর ‘ইনোভেশন’ বা ‘উদ্ভাবনা’ একযোগে কিন্তু আমাকে মনে করিয়ে দেয় সময় সারণি বেয়ে এক ভিন্ন প্রেক্ষিতকে, এক ভিন্ন ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে। দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়াতে দক্ষিণাপণ শপিং কমপ্লেক্সে অবস্থিত ‘ডলি’স টি শপ’-এর কথা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং দক্ষিণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্র গড়িয়াহাটের মাঝখানে, দু’জায়গা থেকেই ঢিল ছোড়া দূরত্বে। ডলি’স টি শপ কিন্তু তৈরি করেছে বহু চা রসিককে, তাদের করে তুলেছে চা-স্নব। বিশেষ করে আমাদের প্রজন্মের মানুষজন যারা দক্ষিণ কলকাতায় বড় হয়ে উঠেছে এবং যখন রাস্তার দু’পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো অজস্র ক্যাফে গজিয়ে ওঠেনি, তাদের কাছে ডলি’র টি শপের গুরুত্বই ছিল অন্য রকম। ভিজে সিদ্ধার্থর ‘কাফে কফি ডে’ যেমন এক প্রজন্মের ভারতবাসীকে শিখিয়েছে ‘আমেরিকানো’টা কী, ঠিক তেমনি ডলি’স আমাদের শিখিয়েছে ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’টা ঠিক কী বস্তু।

ডলি’স তৈরি হয় ১৯৮৮’তে, আর শিগগিরই তা হয়ে ওঠে দক্ষিণ কলকাতার এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ডলি রায় ছিলেন এ দেশের প্রথম ‘টি টেস্টার’ এবং চা নিলামকারী। তাঁর দার্জিলিংয়ে বেড়ে ওঠা, টি বোর্ডে চাকরি সূত্রে চা-সম্পর্কিত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে চা নিয়ে তাঁর আবেগ এবং ভালোবাসাকে একসঙ্গে মিশিয়ে শুরু হয় তাঁর এই ব্যবসা।

কলকাতায় এক ভিন্ন ধারার স্রষ্টা তিনি, একথা বলা যায় নির্দ্বিধায়। তিনি এই ধারা শুরু করেন, আর অন্য অনেকে দ্রুত সেই পথ অনুসরণ করেন। অসাধারণ চা-র সঙ্গে বাঙালির চিরাচরিত আড্ডার মিশেল ঘটে ডলি’স যেন দ্রুতই হয়ে ওঠে কলকাতার এক ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। এমনকি তা মনে করাতে পারে নিউ ইয়র্কের ‘ক্যাফে হোয়া’র কথাও, অবশ্যই বব ডিলন, জিমি হেনড্রিকস বা অ্যানেন গিনসবার্গের মতো প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিদের সেখান থেকে বাদ দিয়ে। মার্চের দার্জিলিং-এর হালকা, উজ্জ্বল, সুগন্ধযুক্ত ‘ফার্স্ট ফ্লাশ’ চা হোক বা হোক মে মাসের দ্বিতীয় পাতা থেকে পাওয়া কোমল, মিষ্টি ‘সেকেন্ড ফ্লাশ’, ডলি’স-এ সেসবের সঙ্গে যুক্ত থাকত আরও একটা কিছু। তা হল ‘পার্সোনাল টাচ’ এবং সেটা চায়ের স্বাদকে বাড়িয়ে দিতে পারে বহুগুণ।
এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে বিশ্ববিখ্যাত কফি চেন স্টারবাকসের প্রবাদপ্রতিম প্রাক্তন সিইও হাওয়ার্ড শুলজের কথা। শুলজ তাঁর কর্মীদের সর্বদা মনে করাতেন যে তাঁরা কফি ব্যবসায় মানুষজনকে পরিষেবা দিচ্ছেন না, বরং তাঁরা পরিষেবা দেবার ব্যবসায় কফির জোগান দিয়ে চলেছেন। যাই হোক, ২০২৩’এর এপ্রিলে তাঁর মৃত্যুর সময় ডলি রায় কলকাতায় শুধুমাত্র এক ব্যতিক্রমী টি শপ-ই রেখে যাননি, তিনি রেখে গিয়েছেন এক উজ্জ্বল লেগ্যাসিকেও। আজ যে শহরাঞ্চলে বাড়ি এবং কর্মক্ষেত্রের বাইরে তৃতীয় স্থান হিসেবে ক্যাফের জনপ্রিয়তার রমরমা, কলকাতার ক্ষেত্রে ডলি’স বোধকরি চার দশক আগেই সেই ধরনের সামাজিক পরীক্ষানিরীক্ষার এক সফল নিদর্শন।

চা-কফির বিপণির ব্যবসার ক্ষেত্রেও ব্র্যান্ড একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই ব্র্যান্ডও তৈরি করতে হয় যত্নে। যদিও তার প্রেক্ষিতটা বদলে যায়। বদলে যায় পদ্ধতিও। বদলায় কলকাতা থেকে নাগপুরে। পালটা যায় ১৯৯০’এর দশক থেকে ২০২৪-এ। আমূল পরিবর্তিত হয় ল্যান্ডলাইনের যুগ থেকে মোবাইল ফোন আর ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের যুগে। এই ক্রমশ বদলাতে থাকা স্থান, কাল ও সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ‘ডলি’ নামটা যেন ঘটনাচক্রে তাই একটা প্রতীক হয়ে দেখা দেয়।

শুধু বিল গেটস কলকাতার দক্ষিণাপণে ডলি’স টি শপে এসে কোনওদিন বলেননি ‘ওয়ান চায় প্লিজ’, এটাই যা আফসোস।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে লাল সংকেত

প্রশান্ত মল্লিক কুড়ি-বাইশ বছর আগে, যখন হোমস্টে পর্যটনের ধারণা সবেমাত্র...

যোগেন মণ্ডল : এক ইতিহাসের নায়ক

অশোক ভট্টাচার্য ১৮৭২ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলার...

কত রাধিকা ফুরোল  

  সেবন্তী ঘোষ   কবি পুরুষের চোখে নারী চিরকাল ‘শুশ্রূষার ...

তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না

লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ঝকঝকে নির্মেঘ আকাশ, বসন্তের মন প্রাণ উথাল...