Tuesday, April 30, 2024
Homeকলামচণ্ডীদাস আর বিদ্যাপতির যুগ ফিরল ভোট প্রচারে

চণ্ডীদাস আর বিদ্যাপতির যুগ ফিরল ভোট প্রচারে

রংদার উত্তরীয়তে বস্তাপচা ভাষণ শুনে মনে পড়বে কেন্দ্র বা রাজ্যের বাজেটের সাম্প্রতিক দুরবস্থা। সারাবছর ধরে দুই সরকারই এত রকমারি ঘোষণা করে, বাজেটের জন্য বিশেষ কিছু পড়ে থাকে না। আগেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায় সব। এভাবেই রেলবাজেটের অপমৃত্যু ঘটেছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেটও মৃত্যুপথযাত্রী।

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

ভোটের ভাষণগুলো মন দিয়ে শুনুন। সব দলের নেতাদেরই। মনে হবে, রিপিট টেলিকাস্ট চলছে। ঘুরেফিরে এক কথা প্রত্যেকের। সংলাপ কি কম পড়িয়াছে? হয়তো।

চারটি বড় পার্টির নেতাদের ভাষণের সারাংশ কার্যত এক। সংবাদমাধ্যম যতই হুংকার, বিস্ফোরণ, তোপ জাতীয় শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করুক না, ওসব বাস্তবে ওপরের আস্তরণ। লাবে ডাব, লাবে ডাব, চার জনে ভারি ভাব। সংলাপ কম পড়িয়াছে, শুধু উত্তরীয় কম পড়ে নাই। একেক নেতার একেকরকম বাহারি উত্তরীয়।

রংদার উত্তরীয়তে বস্তাপচা ভাষণ শুনে মনে পড়বে কেন্দ্র বা রাজ্যের বাজেটের সাম্প্রতিক দুরবস্থা। সারাবছর ধরে দুই সরকারই এত রকমারি ঘোষণা করে, বাজেটের জন্য বিশেষ কিছু পড়ে থাকে না। আগেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায় সব। এভাবেই রেলবাজেটের অপমৃত্যু ঘটেছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেটও মৃত্যুপথযাত্রী। তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস বা সিপিএম নেতারা সারাবছর এমন বকে চলেন, এত লাইভ রেকর্ডিং, এক্স হ্যান্ডেল, ফেসবুকে কটাক্ষ, ভোটের মুখে আর নতুন কী বলবেন? উলটোপালটা বাক্য প্রয়োগে কাদা ছোড়াছুড়ির চিত্রনাট্যে মেদ যোগ করে চলেছেন শুধু।

সম্পূর্ণ এক নতুন দিক খুলে গিয়েছে অবশ্য।

নির্বাচনি প্রচারের হাত ধরে চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, কাশীরাম দাশ, কৃত্তিবাস ওঝা, লালন ফকির, জ্ঞানদাসদের দিন যেন ফিরে আসছে। লাইন দিয়ে চণ্ডীদাস, বড়ু চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাসের ছায়া দেখবেন ভোটের মঞ্চে। যে চার চণ্ডীদাসের কে যে আসল, তা নিয়ে আজও বিতর্ক। চূড়ান্ত সমস্যা। চার পার্টির কে ঠিক, তা নিয়ে যেমন যাবতীয় বিতর্ক ও সমস্যা।

প্রশ্ন করবেন, কীভাবে। খেয়াল করে দেখুন, বহু যুগ আগে বঙ্গসাহিত্যের এককালীন রাজাধিরাজরা নিজেরা কিছু লেখার সময়, বাক্যের মাঝে নিজেদের নাম জুড়ে দিতেন। মনে আছে তো, ‘কহে চণ্ডীদাস, কানুর পিরীতি- জাতিকুলশীল ছাড়া’ কিংবা ‘কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান’? অথবা ‘লালন বলে জাতের কী রূপ…’?

এবার বর্তমানে ফিরে এসে মেলাই। মোদির ভাষণ শুনুন একবার। তিনি নিজেই এবার ‘মোদি মোদি’ করছেন ভাষণে। বলেই ফেলেছেন, ‘দেশজুড়ে লোকে মোদি কি গ্যারান্টিওয়ালি গাড়িকে স্বাগত জানিয়েছে।’  আর বিজেপি সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার নয়। একেবারে সরাসরি নিজের নাম বক্তৃতায় জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর কী বলছেন তিনি? নমো উবাচ, ‘মোদির গ্যারান্টি যে ভ্যালিড তা জনতা বুঝিয়ে দেবে।’

আগে মনে হত, নিজেই নিজের নাম বলব, লোকে কী ভাববে? এখন আর ভাবাভাবির ব্যাপার নেই। বলো, বলো। নিজের নাম বলো হে। সেটাই স্মার্টনেস। সেটাই আত্মবিশ্বাস। সেটাই নতুনত্ব। সেটাই পাবলিক খাবে। মোদি বাড়াবাড়ি করলে দিদিও কি কম যান? তিনি বলছেন, ভোটটা দেওয়ার সময় আমার মুখটা মনে করবেন। তিনিও নিজের নামে গ্যারান্টি দিচ্ছেন দুর্জন সতীর্থদের সামলাতে। দুজনেই আসলে এমনভাবে দেশ বা রাজ্য চালাচ্ছেন, তাতে অন্য মন্ত্রীরা গুরুত্বহীন ক্রমশ। যা কিছু বড় ঘোষণা করছেন দুজনে। বাংলার ভোট যথারীতি দাঁড়িয়ে গিয়েছে দিদি বনাম মোদিতে।

চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির যুগ এত বছর বাদে ফিরে এল, বলব না?

এবং এটাই গোটা দেশের নতুন ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। আপের কেজরিওয়াল, সিপিএমের বিজয়ন, বিজেপির হিমন্ত বিশ্বশর্মা, বিজেডির নবীন পট্টনায়ক, জনতা দলের নীতীশ, ডিএমকের স্ট্যালিন সবাই এরকমই একনায়ক হয়ে উঠেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বাদে অন্য মন্ত্রীরা সব রাজ্যেই অস্তিত্বহীন। এঁরা নিজেই নিজের কথার বিপরীত কথা বলেন। কেউ জানতে চায় না, কেন হঠাৎ পালটে ফেললেন স্টান্স। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কিসিকো খানে নেহি দুঙ্গা। তো ভাই, নীরব মোদি-ললিত মোদি-বিজয় মাল্য তো দিব্যি করেকম্মে খাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ছোট ভাইকে ত্যাজ্য ভাই করলেন। অথচ যে ভাইটি বাংলার খেলার সর্বনাশ করেছেন, তিনি তো আবার দেখি, দিব্যি পার্টিতে জাঁকিয়ে বসেছেন।

নিজের নাম বলে গ্যারান্টি দেওয়ার ব্যাপারটা এমনিতে নতুন নয়। অতীতে আমরা পাড়া বা বাজারের দোকানদারের কাছে শুনেছি। যদু স্বর্ণকার বলতেন, এমন সোনার গ্যারান্টি যদু স্বর্ণকার ছাড়া কেউ দিতে পারবেন না। স্বপন মাছওয়ালা বলতেন, হুঁ-হুঁ বাবা, স্বপনের মাছ কখনও খারাপ হবে না। এক স্টাইলে বলতেন, একশো ভাগ গ্যারান্টি। মধু হালুইকর বলে দিতেন, মধুর মতো খাঁটি ছানার রসগোল্লা-চমচম এ তল্লাটে কোথাও পাবেন না। তো এখন মোদি-দিদির সাম্রাজ্যে ব্যবসা ও রাজনীতি সমার্থক। বন্ড কেলেঙ্কারি নিয়ে বিজেপি-তৃণমূল-কংগ্রেসের নীরবতাই সব বুঝিয়ে দিচ্ছে।

শুধু ভাবছি, এভাবে যদি বড়-ছোট সব নেতা-ই নিজের নাম ধরে অক্লেশে গ্যারান্টি দিতে থাকেন, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে? ধরুন, অভিষেক বলতে শুরু করলেন, ‘অভিষেক যা বলে দেখায়, তা করে দেখায়।’ শুভেন্দুর বার্তা, ‘শুভেন্দুই শুধু করে দিতে পারে, দেখাচ্ছে কাঁথি’। নিশীথ হয়তো বললেন, ‘দিনহাটাকে শান্তির নগরী করে দিতে পারে শুধু নিশীথ।’ অধীর বললেন, ‘অধীরই বহরমপুরকে স্বর্গরাজ্যের গ্যারান্টি দিতে পারে।’ সেলিম চুপ থাকবেন কেন? তিনি বলছেন, ‘রায়গঞ্জ থেকে মুর্শিদাবাদ সব জায়গাকে নিজের করে নিতে পারে শুধু সেলিম’। সুকান্ত বলছেন, বালুরঘাট দেখাচ্ছে সুকান্ত কী উন্নয়নের জোয়ার আনতে পারে। গৌতম দেব হয়তো বলছেন, শিলিগুড়িতে জলের জোয়ার আনতে গৌতম দেবই শুধু পথ দেখাতে পারে।

সব নেতাই যদি অন্তত একটা শহরের গ্যারান্টি নিতেন, তাহলে তো আর চিন্তা থাকত না। আরও একটা নয়ডা, একটা গুরুগ্রাম, নভি মুম্বই, একটা বেঙ্গালুরুর ইলেক্ট্রনিক সিটি, হায়দরাবাদের হাইটেক সিটি চলে আসতে পারত বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। সে তো এল না। কিশোরকুমারের গান হয়ে উঠল তারপর- কেন এল না, জানি না।

তার চেয়ে চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির মতো নিজের কথাই উড়তে থাকুক প্রচারে। চণ্ডীদাসও যে বলে গিয়েছেন, ‘চণ্ডীদাস কয়, করি অনুনয়/ ঠেকেছে কালিয়া ফাঁদে।’

দুজনের আরও দুটি পদ শুনিয়ে শেষ করা যেতে পারে। প্রথমে চণ্ডীদাস। ‘কহে চণ্ডীদাস, শুন বিনোদিনী/সুখ দুখ দুটি ভাই/সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি/দুখ যায় তার ঠাঁই।’ পরে বিদ্যাপতি ‘ভণয়ে বিদ্যাপতি, শেষ শমন-ভয়/ তুয়া বিনু গতি নাহি আরা’।

এই পদাবলি চলতে থাকুক, মনে ভেসে উঠবে অনেক নেতার গোলাবর্ষণ ভাষণ। এবং বাংলার ভোটারদের ভাগ্যে শেষপর্যন্ত ওই দুটি কথাই লেখা আছে সম্ভবত।

আপনারাও সবাই নিজের নাম মিশিয়ে ভাষণ দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিন ভাইসব।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Raiganj | স্বামীর পরকীয়ার প্রতিবাদ করার পরই নিখোঁজ বধূ, খুনের আশঙ্কা পরিবারের

0
রায়গঞ্জ: স্বামীর পরকীয়ার প্রতিবাদ করার পর থেকেই নিখোঁজ স্ত্রী। রায়গঞ্জের মেরুয়াল এলাকার ঘটনা। নিখোঁজ মহিলার নাম সীমা ধর। তার পরিবারের অভিযোগ, সীমার ওপর প্রায়...

Telangana | অমিত শাহের ভিডিও বিকৃতির জের, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীকে সমন দিল্লি পুলিশের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ-র বিকৃত করা ভিডিও তেলেঙ্গানা কংগ্রেসের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে শেয়ার করার অভিযোগে দিল্লি পুলিশ সমন পাঠাল তেলেঙ্গানার...

Narendra Modi | বাতিল শা’র সভা, ৩ মে নির্বাচনি প্রচারে কৃষ্ণনগরে আসছেন মোদি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আগামী ১৩ মে চতুর্থ দফায় লোকসভা ভোট (Lok Sabha Election 2024) কৃষ্ণনগরে (Krishnanagar)। তার আগে মহুয়া মৈত্রের (Mahua Moitra) কৃষ্ণনগরে...

CM Mamata Banerjee | ‘সিপিএম কিনলে কংগ্রেস ফ্রি’, জোটকে কটাক্ষ মমতার

0
খড়গ্রাম: দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন নিয়োগ দুর্নীতিতে রাজ্যকে ধাক্কা দিল, ঠিক তখন মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামের নির্বাচনি জনসভা থেকে ফের শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবিকে উসকে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী...

TMC | নির্বাচনি আচরণবিধির পরোয়া নেই, সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন তৃণমূলনেত্রী

0
হরিশ্চন্দ্রপুর: নির্বাচনি আচরণবিধি চলছে। কিন্তু তা তোয়াক্কা করছেন না তৃণমূলের ব্লক সভানেত্রী তথা জেলা পরিষদের সদস্য। নির্বাচনি আচরণবিধি চলাকালীনই তৃণমূলের(TMC) হরিশ্চন্দ্রপুর-১ (বি) সাংগঠনিক ব্লকের...

Most Popular