- অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য
সে যুগে সবে সতীদাহ প্রথার নিবারণ হয়েছে, বিধবাবিবাহ সবে আইনের দ্বারা সমর্থিত হয়েছে, বহুবিবাহ রহিত হওয়ার সপক্ষে বিদ্যাসাগরের আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেই সময়পর্বের পটভূমিতে বঙ্কিমসৃষ্ট রমণীরা অতিমাত্রায় আধুনিক, অতিমাত্রায় প্রাগ্রসর। এ যুগের বিবাহবিচ্ছেদ আইন সে যুগের বাঙালি রমণীদের কল্পনার বাইরে ছিল। বঙ্কিমের উপন্যাসে এমন বেশ কয়েকজন বিদ্রোহিণীর কথা উঠে আসে।
বিষবৃক্ষ উপন্যাসে দুই বিদ্রোহিণীকে দেখি— নগেন্দ্রনাথের স্ত্রী সূর্যমুখীকে এবং নগেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া পত্নী কুন্দনন্দিনীকে। এই রমণীযুগলের বিদ্রোহ কীসের বিরুদ্ধে এবং কীভাবে, সে কথাটাই বলি।
স্বামী নগেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধেই সূর্যমুখীর প্রধান ক্ষোভ। এই ক্ষোভের কারণ কী? কারণ, এতকাল পর নগেন্দ্র স্ত্রী সূর্যমুখীকে বিস্মৃত হয়ে বিধবা কুন্দনন্দিনীতে আকৃষ্ট। এমনকি, নগেন্দ্র কুন্দনন্দিনীকে বিবাহ পর্যন্ত করতে উদ্যোগী। পুরুষের বহুবিবাহ সমাজ অনুমোদিত হলেও সূর্যমুখীর মতো নারীর পক্ষে তা মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। শাস্ত্রের বিধান থাকে থাক, সমাজের অনুমোদন থাকে থাক, কিন্তু নারী হিসাবে সূর্যমুখী এই বিধান কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।
সূর্যমুখীর প্রকৃত বিরোধ কি বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে, নাকি পুরুষের বহুবিবাহের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে? নগেন্দ্রর প্রতি সূর্যমুখীর ক্ষোভ কি এই কারণে যে নগেন্দ্র একজন বিধবাকন্যাকে বিবাহ করছে, নাকি ক্ষোভের প্রকৃত কারণ হল, যেহেতু নগেন্দ্র দ্বিতীয়বার পরিণয়াবদ্ধ হচ্ছে—সে কন্যা বিধবাই হোক আর কুমারীই হোক, সূর্যমুখীর তাতে কি যায় আসে! স্ত্রীর বর্তমানে স্বামীর দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ তৎকালীন সমাজকর্তৃক অনুমোদিত হলেও পত্নী সূর্যমুখীর নিকট তা কিছুতেই স্বীকারযোগ্য নয়, অনুমোদনযোগ্য নয়। আর তাই দেখি, নগেন্দ্রর দ্বিতীয় বিবাহে সূর্যমুখীর তীব্র বেদনা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ প্রকাশ পেল তার গৃহত্যাগের মধ্য দিয়ে। যদি সূর্যমুখী গৃহত্যাগের মাধ্যমে তার ক্ষোভ তার প্রতিবাদ প্রকাশ না করত, তাহলে এই উপন্যাসে নগেন্দ্র-কুন্দর বিবাহের পর আর কোনও নতুন তরঙ্গ দেখা দিত না। হয়তো নগেন্দ্র তার বড় বৌ ও ছোট বৌকে নিয়ে দিব্যি ঘরসংসার করে আত্মসুখে কালাতিপাত করত। নারীর আত্মমর্যাদা দিয়ে সূর্যমুখী নিজেকে নগেন্দ্রনাথের সহধর্মিণী রূপেই ভাবতে পারে, কিন্তু কখনোই নগেন্দ্রের অন্যতম বধূ রূপে নয়। আর তাই কুন্দের সঙ্গে নগেন্দ্রর বিবাহের পরদিনই সকলের অলক্ষে রাতের অন্ধকারে সূর্যমুখী ঘর থেকে পথে এসে নামে, ঠিকানাবিহীন লক্ষ্যে এগিয়ে যায় নিঃসহায় ও নিঃসম্বল অবস্থায়। স্নেহময়ী সূর্যমুখীর গৃহত্যাগের ঘটনা নগেন্দ্রনাথকে তীব্রভাবে বিচলিত, বিহ্বল ও বিভ্রান্ত করে তোলে। সূর্যমুখীর গৃহত্যাগ নগেন্দ্রর পক্ষে একান্তই অপ্রত্যাশিত—হয়তো সেদিনের সমাজের চোখেও। মনে রাখতে হবে, তখনও দেশে বহুবিবাহ নিষেধক আইন প্রবর্তিত হয়নি। তবে বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রয়াসে বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত আইন পাশ হয়ে গিয়েছে।
মনে হয়, সূর্যমুখীর প্রধানতম ক্ষোভ তার স্বামীর প্রতি হলেও, তার আরেকটি ক্ষোভ থেকে গিয়েছে বিধবাবিবাহ আইনের বিরুদ্ধে এবং স্বভাবতই সেই কারণে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিরুদ্ধেও।
কমলমণিকে ব্যথিত সূর্যমুখী স্বামীর কুন্দানুরাগের প্রসঙ্গের শেষে লিখেছে, ‘একটা হাসির কথা। ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবাবিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?’
সূর্যমুখীর এই কথাটার প্রকৃত অর্থ কী? অনেকে মনে করেন, সূর্যমুখীর চিঠির এই অংশ আসলে বঙ্কিমেরই আপন মনের অভিব্যক্তি। তার মানে কি বঙ্কিম বিধবাবিবাহের সমর্থক ছিলেন না? বিদ্যাসাগর দেশে যে আন্দোলনের জোয়ার তুলেছিলেন বঙ্কিম কি তার পরিপন্থী ছিলেন?
এরূপ কল্পনা আদৌ সত্য নয়।
মনে রাখতে হবে, বঙ্কিম বিধবা কুন্দের বিবাহ দিয়ে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের অনুকূলতাই করেছিলেন। বালিকা বিধবা অন্তঃপুরে বসে জীবনের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে কেবল একাদশীর উপবাস করবে— বঙ্কিমচন্দ্র তা কখনোই চাননি। ‘ধর্ম এবং সাহিত্য’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রই বলেছেন, ‘আট বৎসরের কুমারী কন্যা বিধবা হইয়াছে, যে ব্রহ্মচর্যের সে কিছু জানে না, যাহা ষাট বৎসরের বুড়ারও দুরাচরণীয়, সেই ব্রহ্মচর্যের পীড়নে পীড়িত করিয়া তাহাকে কাঁদাইতে হইবে, আপনি কাঁদিতে হইবে, পরিবারবর্গকে কাঁদাইতে হইবে, নহিলে ধর্ম থাকে না। ধর্মোপার্জনের জন্য কেবল পুরোহিত মহাশয়কে দাও, গুরুঠাকুরকে দাও, নিষ্কর্মা, স্বার্থপর, লোভী, কুকর্মাসক্ত ভিক্ষোপজীবী ব্রাহ্মণদিগকে দাও, আপনার প্রাণপতনে উপার্জিত ধন সব অপাত্রে ন্যস্ত কর। এই মূর্তি ধর্মের মূর্তি নহে—একটা পৈশাচিক কল্পনা।’ বিদ্যাসাগর চিরজীবন সমাজের এই পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে লড়েছেন, বিদ্যাসাগরের মূল উদ্দেশ্যর সঙ্গে বঙ্কিমের মনোভাবের কোনও বিরোধ ছিল না।
বঙ্কিমচন্দ্রই তাঁর সাম্য গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘যদি কোনও বিধবা, হিন্দুই হউন, আর যে জাতীয়া হউন, পতির লোকান্তর পরে পুনঃপরিণয়ে ইচ্ছাবতী হয়েন, তবে তিনি অবশ্য তাহাতে অধিকারিণী। যদি পুরুষ পত্নীবিয়োগের পর পুনর্বার দার পরিগ্রহে অধিকারী হয়, তবে সাম্যনীতির ফলে স্ত্রী পতিবিয়োগের পর অবশ্য, ইচ্ছা করিলে, পুনর্বার পতিগ্রহণে অধিকারিণী। এখানে জিজ্ঞাসা হইতে পারে, ‘যদি’ পুরুষ পুনর্বিবাহে অধিকারী হয়, তবেই স্ত্রী অধিকারিণী, কিন্তু পুরুষেরই কি স্ত্রী বিয়োগান্তে দ্বিতীয়বার বিবাহ উচিত? উচিত, অনুচিত, স্বতন্ত্র কথা, ইহাতে ঔচিত্যানৌচিত্য কিছুই নাই। কিন্তু মনুষ্যমাত্রেরই অধিকার আছে যে, যাহাতে অন্যের অনিষ্ট নাই এমত কার্যমাত্রই প্রবৃত্তি অনুসারে করিতে পারে। সুতরাং পত্নীবিযুক্ত পতি, এবং পতিবিযুক্ত পত্নী ইচ্ছা হইলে পুনঃপরিণয়ে উভয়েই অধিকারী বটে। অতএব বিধবা, বিবাহে অধিকারিণী বটে। কিন্তু এই নৈতিক তত্ত্ব অদ্যাপি এ দেশে সচরাচর স্বীকৃত হয় নাই। যাঁহারা ইংরেজি শিক্ষার ফলে, অথবা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বা ব্রাহ্মধর্মের অনুরোধে, ইহা স্বীকার করেন, তাঁহারা ইহাকে কার্যে পরিণত করেন না। তিনি যিনি বিধবাকে বিবাহে অধিকারিণী বলিয়া স্বীকার করেন, তাঁহাদেরই গৃহস্থা বিধবা বিবাহার্থ ব্যাকুলা হইলেও তাঁহারা সে বিবাহে উদ্যোগী হইতে সাহস করেন না। তাহার কারণ, সমাজের ভয়।’
বঙ্কিম সমাজের এই ভয়ে ভীত না হয়ে বিষবৃক্ষ উপন্যাসে বিধবাবিবাহের ব্যবস্থা করলেন। বঙ্কিম বিধবাবিবাহ সমর্থন করেন বলেই সরলা কুন্দনন্দিনীর পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু এই বিবাহের পরিণাম শুভ হয়নি বলে অনেকেই মনে করেন, বঙ্কিম বুঝি মনেপ্রাণে বিধবাবিবাহের বিরোধী ছিলেন।
সত্যিই কি তাঁর বক্তব্য এমনটাই ছিল?
কুন্দ, নগেন্দ্রের বিবাহের পরিণাম যে সুখের হয়নি তার জন্য কুন্দের বৈধব্য কোনও সমস্যা সৃষ্টি করেনি কখনোই। নগেন্দ্র ও কুন্দের বিবাহের পর সূর্যমুখী যে গৃহত্যাগ করল— তার কারণ এই নয় যে সূর্যমুখীর স্বামী দ্বিতীয়বার যাকে বিবাহ করেছে সে বিধবা। কুন্দ কেবল বিধবা বলেই যে তাকে সপত্নীরূপে গ্রহণ করতে সূর্যমুখীর আপত্তি তা তো আদৌ নয়। আপত্তি তো একেবারে গোড়াতেই। প্রথমা পত্নীর উপস্থিতিতে নগেন্দ্র দ্বিতীয় বিবাহ করছে, তা সে বিবাহ কুমারীর সঙ্গেই হোক আর বিধবার সঙ্গেই হোক— সূর্যমুখীর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারী কিছুতেই তা মেনে নিতে পারে না। ঘটনাচক্রে কুন্দ বিধবা। কিন্তু সূর্যমুখীর বিদ্বেষ কোনও সময়েই কুন্দ বিধবা বলে নয়— সূর্যমুখীর লজ্জা অপমান ক্ষোভ সর্বদা এই কারণেই যে কুন্দ নগেন্দ্রনাথের দ্বিতীয়া পত্নী।
দ্বিতীয় পত্নীর আবির্ভাবই যদি এই উপন্যাসের সমস্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে, তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র কুমারী কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে নগেন্দ্রর বিবাহের ব্যবস্থা করলেন না কেন?
এর কারণ, বঙ্কিম এই উপন্যাসের মাধ্যমে এটাও দেখাতে চেয়েছেন যে— বিধবাবিবাহ আইনানুমোদিত হলেও এই মুহূর্তে সমাজে তার পরিণাম শুভ নয়। এতদিন সমাজে পুরুষ কেবল কুমারীদেরই বিবাহ করার অধিকারী ছিল, এখন বিধবা রমণীদেরও সে পুনর্বিবাহ করার অনুমোদন পেল। এ যেন বহু বিবাহে আগ্রহী পুরুষদের পক্ষে এই আইন সহায়ক হয়ে দেখা দিল। বিবাহযোগ্য কোনও সুযোগ্য পুত্রের পিতা-মাতা বিধবা কন্যাকে বরণ করে নিলেন আপন পুত্রবধূ রূপে? আমাদের দেশে মেয়েদের বিবাহ দিতেই পিতা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে— সে অবস্থায় সমাজের ক’টা মানুষ বিধবা নারীকে বিবাহ করতে আগ্রহী হবে! সমাজে তেমন আগ্রহের যে সম্ভাবনা নেই বঙ্কিমচন্দ্র তা স্পষ্ট লক্ষ করেছিলেন। তাই বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত এবং আইনসম্মত বলে স্বীকৃত হলেও সমাজ থেকে তেমন বিবাহের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। কিন্তু এই আইনানুমোদনের সুযোগ নিল সমাজে নগেন্দ্রনাথের মতো মানুষরা। বিধবাবিবাহে বঙ্কিমের আপত্তি নেই, কিন্তু তড়িঘড়ি বিধবাবিবাহকে আইনের দ্বারা প্রবর্তনের কুফল সমাজে কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই দিকটা বঙ্কিম সমাজের মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন। বিধবাবিবাহ আইনসম্মত বলেই নগেন্দ্র কুন্দনন্দিনীকে পুনর্বিবাহের সুযোগ পেল। সমাজের প্রকৃত সংস্কার ভিতর থেকে যতদিন না ঘটবে, ততদিন আইনের দ্বারা সমাজে সংস্কারের চেষ্টা সফল হবে না। পুরুষের বহুবিবাহের প্রবণতা ও মানসিকতা যতদিন না সম্পূর্ণ দূর হবে, ততদিন বিধবাবিবাহ আইনের দ্বারা সমর্থিত হলেও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রকৃত মনোবাঞ্ছা কিন্তু কখনোই পূর্ণ হবে না। কুন্দনন্দিনীর বৈধব্য ঘটিয়ে এবং তার পরে সূর্যমুখীর স্বামী নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে কুন্দের পুনর্বিবাহের উপাখ্যান রচনা করে সমাজের তৎকালীন অবস্থার ছবিটাই বঙ্কিম তুলে ধরতে চেয়েছেন।