মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম ‘ভোটের’ ঠিকানা

শেষ আপডেট:

  • অম্লান দেব

বুড়ি বসে আছে গাছের তলায়। কোঁচকানো গাল, ঝাপসা দুটো চোখ আকাশের দিকে স্থির। ঝড়ে উড়ে গিয়েছে মুলিবাঁশের বেড়া, টিনের চাল। লন্ডভন্ড অবস্থায় পড়ে আছে শেষ সম্বল জমা করা কালো দুটো ট্রাংক। কবে কোথায় কীভাবে কোন ঝড় উঠবে তার সবটুকু খবর বোধহয় আবহাওয়া দপ্তরও রাখে না। মাথা ঢাকার পলিথিন নেই, পেটে নেই দানাপানি। বার্নিশ গ্রাম পঞ্চায়েতের কায়েতপাড়ার বুড়ি বসে আছে স্থির।

খবর পেয়ে বড় ছেলে এসেছে দিল্লি থেকে। ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, সঙ্গে লোকলস্কর, পাইক-বরকন্দাজ। ছোট ছেলেও এসেছে কলকাতা থেকে। এরও সাদা জামা, সাদা গাড়ি। সঙ্গে নোকর-চাকর, ইয়ার-দোস্ত। বুড়ির দুই ছেলেই মস্ত বড় মানুষ। অর্থ কিংবা ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। সাদা রংয়ে দুজনকেই সাধু সাধু লাগে।

চিৎকার শুরু করেছে ছোট ছেলে আগে। বড়জন গাড়ি থেকে নামার আগেই দখল নিয়েছে মাইক্রোফোন। ‘ঠিক সময় যদি বড় ছেলে টাকা পাঠাত তবে তো একটা পাকা বাড়ি তৈরি করে দেওয়া যেত বুড়িকে। আহা বুড়ি! বেচারা বুড়ি’! বড় ছেলে গাড়ি থেকে নেমেই আন্দাজ করে নিল অবস্থা। গাছের গুঁড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা উঁচু আলের ওপর দাঁড়িয়ে সেও জবাব দিতে শুরু করল। গত শীতে বুড়িকে সোয়েটার, কম্বল কিনে দেওয়া বাবদ সে কত টাকা দিয়েছিল ছোট ভাইকে… প্রতিবেশীরা জানিয়েছে, উত্তরবঙ্গের কনকনে ঠান্ডায় আলুর বস্তা গায়ে ঘুমিয়েছে বুড়ি। সোয়েটার, কম্বল জোটেনি। সে টাকার হিসাবও দেয়নি ছোট জন। গত ডিসেম্বরের টাকার হিসাব না পেলে তো তার পক্ষে আর টাকা দেওয়া সম্ভব না। যতই হোক সে বড়, তার দায়িত্ব অনেক। ছোটজন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের খাতা বের করে। দুই ভাইয়ের ‘জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট’। গত বছর বর্ষায় বুড়ির রান্নাঘরের চালে প্লাস্টিক দেওয়ার জন্য টাকা চাওয়া হয়েছিল। বড়জন সে টাকাও দেয়নি। বড়জন দেখায় অনলাইন পেমেন্টের স্ক্রিনশট। বুড়ির বাড়ির পাঁচিল পাকা করার জন্য সে কত টাকা পাঠিয়েছে ছোট ভাইকে। পাঁচিল তো দূরের কথা বুড়ির উঠোনের সীমানায় কঞ্চিও পোঁতা হয়নি। অথচ তারপরের মাসে কলকাতায় ছোটজনের নতুন ফ্ল্যাট হয়েছে- এ খবর তার কাছে আছে।

দুই ছেলে বুড়িকে সামনে রেখে গ্রামবাসীদের সাক্ষী মানে। বুড়ির পাকা বাড়ি করে দেওয়ার জন্য তারা যে কত আগ্রহী সেকথা ছন্দ অলংকার সমেত জানায়। বুড়ির ওষুধ, ফলের রস, র‌্যাশন সবকিছুর ব্যবস্থা তারা করতে চায়। তাদের সাদা মনের আন্তরিকতায় কোথাও কোনও কাদা নেই। বুড়ির কথা ভেবে যে কলকাতায় দিল্লিতে তাদের ঘুম আসে না সে কথায় আর কারও কোনও সন্দেহ থাকে না। ছেলেদের দায়িত্ববোধে মুগ্ধ গ্রামবাসীরা ঘরে ফিরে যায়। আজ আবার উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস। ‘বড় মানুষ’ ছেলেরা তো আর আল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না বেশিক্ষণ। ধুলো ওড়ানো রাস্তায় জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি শহরের পাঁচতারা হোটেলের দিকে ফেরে দিল্লিওয়ালা কলকাতাওয়ালা দুই ছেলের গাড়ি।

ময়নাগুড়ির প্রত্যন্ত গ্রামের এক নাম না জানা গাছের গোড়ায় মাথা ঠেস দিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে বসে থাকে উত্তরবঙ্গের বুড়ি, উত্তরবঙ্গের মা!

(লেখক কোচবিহার দেওয়ানহাটের ভূমিপুত্র। বর্তমানে নিউ বালিগঞ্জ কলেজের অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.

Share post:

Popular

More like this
Related

পাহাড়ে হোমস্টে বিপ্লবে লাল সংকেত

প্রশান্ত মল্লিক কুড়ি-বাইশ বছর আগে, যখন হোমস্টে পর্যটনের ধারণা সবেমাত্র...

যোগেন মণ্ডল : এক ইতিহাসের নায়ক

অশোক ভট্টাচার্য ১৮৭২ সালের জনগণনা থেকে জানা যায়, অবিভক্ত বাংলার...

কত রাধিকা ফুরোল  

  সেবন্তী ঘোষ   কবি পুরুষের চোখে নারী চিরকাল ‘শুশ্রূষার ...

তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না

লীনা গঙ্গোপাধ্যায় ঝকঝকে নির্মেঘ আকাশ, বসন্তের মন প্রাণ উথাল...