- সিদ্ধার্থ সিংহ
আগের মতো অত না হলেও কলকাতা বইমেলায় কিছু বই বিক্রি হয় বইকি। যাঁরা কস্মিনকালেও বই কেনেন না, বইয়ের সঙ্গে যাঁদের কোনও সম্পর্কই নেই, বইমেলা ঘুরতে এসে তাঁরাও কেউ কেউ একটা-দুটো বই কিনে নিয়ে যান। এবার মেলার মাঠে আমি এমনই একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কি গত বছর বইমেলায় বই কিনেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, এবারও কিনেছেন তো? তিনি বললেন, হ্যাঁ, এই হাঁদাভোঁদাটা কিনেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি গতবার আর এবারের বইমেলার মধ্যবর্তী সময়ে কোনও বই কিনেছেন? তাঁর অকপট উত্তর, না।
কারণ একটাই। তাঁরা আর পড়তে চাইছেন না। লেখার মান অত্যন্ত নিম্নগামী।
আপনি কীভাবে দেখেন ব্যাপারটা? বিশিষ্ট কবি জয় গোস্বামীর জবাব, ‘বইয়ের বিক্রি কমেছে না বেড়েছে, আমি ঠিক বলতে পারব না। আমি তো প্রকাশক নই। আর কেউ কাউকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে কি না, বা কাঁকড়ার মতো টেনে নীচে নামানোর চেষ্টা করে কি না এ বিষয়েও আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আমি ঠিক বলতে পারব না।’
অনেকেই মনে করেন, ফেসবুক, ইউটিউব আর বিভিন্ন চ্যানেলের দৌলতে এবং নানা কলাকৌশলে মধ্যমান বা তার চেয়েও নিম্নমানের কিছু সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। পাঠকরা ভাবছেন এঁরাই বুঝি এখনকার খুব বড় মাপের লেখক। ফলে তাঁদের বই কিনছেন। কিন্তু তাঁদের লেখা পড়ার পরে পাঠকেরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বাংলা বইয়ের বাজার মুখ থুবড়ে পড়ছে। বিক্রি হচ্ছে না দেখে প্রকাশকেরাও আর কোনও লেখকের বই ছাপতে চাইছেন না।
বাংলার অনেক সাহিত্যিক অসাধারণ কৌশলের দ্বারা নিজেদের জায়গা তৈরি করেছেন এবং সেটা ধরে রাখার জন্য তাঁরা মরিয়া। আর তাঁদের এই রাজনীতির কূটকৌশলে সত্যিকারের মেধার উপরে নেমে আসছে ভয়ংকর অবিচার। এই মধ্যমানের কবি-লেখকরা সবসময় একটা গোষ্ঠী তৈরি করেন এবং সেই গোষ্ঠীতে তার চেয়েও নিম্নমানের কবি-লেখকদের জন্য সদর দরজা খুলে দেন, যাতে ওঁরাই তাঁকে মহান কবি বলে প্রচার করেন।
অনেকে বড় পত্রপত্রিকার সাহিত্যের পাতা সম্পাদনার দায়িত্বে যান, তাই নিজে কত বড় মাপের লেখক সেটা প্রমাণ করার জন্য তিনি সবসময় নিম্নমানের লেখাই ছাপেন। এটাও একটি অদ্ভুত কৌশল। পাঠককে দেখান, এই তো এখনকার কবি-লেখকেরা, এই সব ছাইপাঁশ লিখছেন। আর আমি কী লিখছি দেখুন।
এর বাইরেও আছে একটা চক্র। তুমি আমাকে দেখো আমি তোমাকে দেখব। তুমি আমাকে ওই প্রকাশনীতে ঢুকিয়ে দাও, আমি তোমাকে এই পুরস্কার পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। তুমি আমাকে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে পাঠানোর ব্যবস্থা করো, আমি তোমার কবিতা অমুক বাজারি পত্রিকায় ছেপে দিচ্ছি। গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি।
লন্ডন প্রবাসী বিশিষ্ট লেখক নবকুমার বসু এখন কলকাতায়। বলছিলেন, ‘কবি-লেখক সম্পাদকদের রাজনীতি নিয়ে কিছু বলা খুব মুশকিল। কিছু কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ চিরকালই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবে। নেবেও। এটা আগেও ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আমার মনে হয়, রাজনীতির ছত্রছায়ায় বা অনুকম্পায় যতদিন চলচ্চিত্র, সংগীত, শিল্প, সাহিত্য থাকবে, ততদিন এটা চলতেই থাকবে।’
এক কবিকে বলতে শুনলাম, আসল রাজনীতির নেতাদের ছাপিয়ে যাবে সাহিত্যের রাজনীতিকরা। যাঁরা সত্যি সত্যিই রাজনীতিবিদ, তাঁদের উচিত এদের কাছে এসে তালিম নেওয়া কীভাবে একজনকে কোণঠাসা করতে হয়, কীভাবে একজনকে চেপে রাখতে হয়, কীভাবে একজনকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে হয়।
আরেক বিশিষ্ট লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী কথাটা শুনে হাসলেন, ‘এটা তো চিরকালই ছিল। প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর সঙ্গে যখন কারও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, তখন তাঁর হয়ে হয়তো বলেছেন, এ আমার বন্ধু। একে এবার পুরস্কারটা দিতে হবে কিংবা এবার শারদীয়ায় এর উপন্যাসটা ছাপুন। এটা তো চিরকাল ছিল। এখনও আছে।’
কবি বিভাস রায়চৌধুরীর দুঃখ, ‘এত বেশি ফেসবুক পেজ নির্ভর প্রকাশনা গড়ে উঠেছে যে কী বলব! তাঁরা লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই করেন। লেখক যত কপি বই চান, তত কপিই তাঁরা পিওডিতে ছেপে নেন। কোথাও বই রাখেন না। ওই বইগুলোর বেশিরভাগই আবর্জনা। এত জালি বইয়ের মধ্যে থেকে ভালো বইটা পাঠক বেছে নেবে কী করে!’ তিনি বলছিলেন, ‘কলেজ স্ট্রিটে তো আর কোনও জায়গা নেই। সরকারের উচিত ওখানে একটা ঘর তৈরি করা। যেখানে তরুণ কবি-লেখকেরা তাঁদের বই রাখতে পারবেন। একটা কমিশনের ভিত্তিতে।’ আরেক কবি সৌমিত বসুর মন্তব্য, ‘সুবিমল মিশ্র কেমন লেখেন এটা কোনও বাণিজ্যিক কাগজ বিচার করেনি। কিন্তু সরকার তো দেখতে পারত! সরকারও তো একটা ক্ষমতা। কেদার ভাদুড়ীর কথা সরকার একবার ভাবতে পারত! বিনয় মজুমদারকে আবিষ্কার করতে পারত। কিন্তু কেউ করেনি।’
কীরকম রাজনীতি হয় আজকের বাংলা সাহিত্যে?
যাঁরা মাঝারি মানের লেখক, তাঁরা সবসময়ই যেনতেনপ্রকারেণ যোগ্য লেখককে সরিয়ে দিয়ে নিজের একটা জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করেন। বন্ধুদের দিয়ে রটিয়ে দেন ওর লেখা হয় না। সম্পাদকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তাঁর লেখা ছাপানো বন্ধ করার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন পুরস্কার কমিটির ওপর প্রভাব খাটিয়ে তাঁকে পুরস্কার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেন। আর এসব করার জন্যই তাঁদের দ্বারস্থ হতে হয় রাজনৈতিক নেতা, আমলা, মন্ত্রীর। কারণ রাজনৈতিক নেতাদের হাত মাথার উপরে না থাকলে এগুলো খুব সহজে করা যায় না।
ভারতে ১৯৫৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার চালু হয়। বাংলা ভাষায় ১৯৫৫ সালে প্রথম সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান জীবনানন্দ দাশ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার জন্য (মরণোত্তর)। পরের বছর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আরোগ্য নিকেতন উপন্যাসের জন্য। তারপর একে একে প্রেমেন্দ্র মিত্র, রাজশেখর বসু, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, শঙ্করের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় লেখকেরা এই পুরস্কার পেয়েছেন। ইদানীং শুরু হয়ে গিয়েছে এর রাজনীতিকরণ।
এখন সরকারি টাকায় কবিতার অনুষ্ঠান হয়। তা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন উঠছে। এখানে নেতা সম্পাদকের কাগজে বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দিলে কিংবা কমিটির প্রধানের পিছনে পিছনে ঘুরলে অথবা তাঁর দলে নাম লেখালেই নাকি ডাক পাওয়া যায়। এটাই একমাত্র যোগ্যতা। আর সেখানে সেইসব বাচিক শিল্পীরাই সুযোগ পান বলে অভিযোগ, যাঁরা সারা বছর ধরে বিভিন্ন মঞ্চে, ইউটিউবে কমিটির প্রধানের লেখা কবিতা পড়েন। বছরান্তে প্রাপ্তি ২০০০ টাকা। তবু কবি নেতাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই নাকি অনেক যোগ্য কবি-লেখক বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। লবিবাজি, গোষ্ঠীবাজি হয় চরম।
কবি চৈতালি চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন তুললেন, ‘কোথায় পলিটিক্স নেই? গানের জগতে, চলচ্চিত্রের জগতে, কর্পোরেট জগতে, পত্রিকা অফিসে, এমনকি সরকারি অফিসেও। এটা কবিতার জগতেও আছে। আর আমরা যেহেতু মেয়ে, ফলে ভয়ংকর রকমের জেন্ডার পলিটিক্স হয়। সবচেয়ে বেশি হয়। সেটা কাটিয়ে উঠতে না পারলে মুশকিল। কে শিকার হননি? কবিতা সিংহ, নবনীতা দেবসেন থেকে বিজয়া মুখোপাধ্যায়। সবাই এই জেন্ডার পলিটিক্সের শিকার হয়েছেন। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তখন একটা বীজমন্ত্র জপ করে যেতে হয়। আমি লিখবই।’
হ্যাঁ, বাংলা সাহিত্যে রাজনীতি আছে। আর তার শিকারও হচ্ছেন অনেকে। ফলে অনেক অযোগ্যর নাম যেমন উঠে আসছে প্রথম সারিতে। আবার অনেক যোগ্য কবি-লেখকের নাম তলিয়ে যাচ্ছে অতলে। কিন্তু এরা যখন থাকবেন না, তখন পাঠকই আসল বিচার করবেন।
অনেক সময় পরিচয় না থাকলে অথবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও কবি-লেখকদের কোণঠাসা হতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ছিলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী। তিনি সবসময় বলতেন, ‘আপনার শত্রুও যদি ভালো লেখে তাঁর বাড়ি বয়ে গিয়ে লেখা চেয়ে নিয়ে আসবেন। আর আপনার বন্ধুর লেখা যদি আপ টু দ্য মার্ক না হয়, হাতজোড় করে তাঁকে বিদায় করবেন।’
ওই ধরনের সাহিত্যিক এখন কোথায়?
(লেখক সাহিত্যিক)