- শুভময় সরকার
বসন্তের এইসব উড়ুউড়ু দিনে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একটি অনুষঙ্গ মনে পড়ে, যে স্মৃতি বসন্তদিনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নিবিড়ভাবে। সেসময় ক্যাম্পাসে শাল বাগানের পাশে কনভোকেশন প্যান্ডেলে একটা মেলা হত। সম্ভবত সেটার উদ্যোক্তা ছিল ক্যাম্পাসেরই কোনও মহিলা সংগঠন। নানা রকম স্টল হত সে মেলায়।
আমরা সেবার বন্ধুরা মিলে কবিতা-ছড়ার স্টল দিলাম। অর্ডার করলে আমরা বিষয়ভিত্তিক কবিতা এবং ছড়া লিখে দেব, বিনিময়ে টাকা। লাভও হয়েছিল সেই স্টল থেকে। বেশ মনে আছে, এক ভদ্রমহিলা, সম্ভবত কোনও অধ্যাপকের স্ত্রী, আমাদের এসে বললেন- বসন্ত এবং আড্ডা নিয়ে ছড়া লিখে দিতে। আমাদের এক বন্ধু তৎক্ষণাৎ লিখে দিল- ‘বসন্ত ক্যাম্পাস ঘিরে, বলে আমাদের ফিরে ফিরে, এ জগৎ অ-নিত্য নেহাত, ভিড়ে যাও আড্ডার ভিড়ে।’
সেই কতদিন আগেকার এই স্মৃতি মনে পড়ার কারণ আছে। অতি সম্প্রতি শহর শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার শান্তি মোড়ে একটা ব্যানার চোখে পড়ল, যেখানে লেখা – ‘আড্ডার ৫০ বছর’। ব্যানারটা দেখে অন্যরকম এক অনুভূতিতে জারিত হলাম। এরকম একটি ব্যানার দেখে অনুভব করা যায় ‘রঙ্গে ভরা বঙ্গজীবনে’ আড্ডা আসলে কতটা গভীরে প্রোথিত।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ভীষণরকম আড্ডা-ঘরানায় বড় হয়েছি, ফলে এই আড্ডা নিয়েই আমার যাপনচর্চা। আবহমান বঙ্গজীবনে উত্তর কলকাতার রোয়াকে আড্ডার এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত রয়েছে কিন্তু মফসসলি বৃত্তান্তেও আড্ডাযাপন বড় কম নয়। এই উত্তর-পশ্চিমবঙ্গের তোর্ষাপাড় থেকে তিস্তা হয়ে একদম মহানন্দা, আড্ডায় মেতে ওঠে জনজীবন। কলেজ-জীবন জলপাইগুড়িতে কাটানোর ফলে সে শহরের মজলিশি মেজাজের সঙ্গেও আমার বিলকুল সখ্য, বিখ্যাত সেই চাটাইয়ের ঠেক থেকে কদমতলার আড্ডা, গুরজংঝোরা বিল্ডিংয়ের সামনের আড্ডা থেকে কেসি দাসের ঠেকে নরকগুলজার…! সত্যি বলতে কী, এসব ছাড়া তিস্তাপাড়ের শহরটাকে বড় অচেনা লাগে। আলিপুরদুয়ারের আড্ডাও কম সৃজনশীল নয়। বহু সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হয়েছে আলিপুরের সেইসব আড্ডা থেকে। একসময় আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশনেও জমত তুমুল আড্ডা। রাজনগর কোচবিহারে তোর্ষাপাড়ের আড্ডা কিংবা মহারাজা ক্লাবের অভিজাত পরিবেশের আড্ডাও উল্লেখ্য আর শহর শিলিগুড়ির আড্ডার উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্য দলিল ‘পাহাড়তলি’-র স্মৃতিবিজড়িত সংখ্যাগুলো।
এ লেখা নেহাতই এই উত্তরের বিভিন্ন জায়গার আড্ডার নথি নয়, বরং সৃজনের সঙ্গে আড্ডার নিবিড় সম্পর্ক নিয়ে দু’চার কথা বলার জন্যই হয়তো বা। সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’-ছবিতে আড্ডা নিয়ে উৎপল দত্ত’র সেই কথাগুলো মনে পড়ল। ইউরোপের নানান মেধাবী আড্ডার কথা উঠেছিল তাঁর ডায়ালগে। সৃজনশীল মানুষের আড্ডায় মেধার ঝলক থাকাটাই দস্তুর, তবে মজলিশি বঙ্গজীবনে নন-মেধাবী আড্ডাও কিন্তু চলমান জীবন স্রোতের এক অনিবার্য অঙ্গ। ইউনিভার্সিটি হস্টেলের একটি ঘরের বাইরে সাঁটানো পোস্টারটার কথা মনে পড়ল, যেখানে লেখা ছিল- ‘এই আড্ডায় রোনাল্ড রেগন হইতে কপিল দেব সবাই আলোচিত হন’…! ব্যস্ত বঙ্গজীবন তার আড্ডার অতীত গরিমা হারিয়েছে অনেকটাই তবু আজও সকালবেলা, দুপুরবেলা, সন্ধেবেলা কিংবা রাতেরবেলা ছাড়িয়ে যা প্রধান হয়ে দাঁড়ায়, তার নাম আড্ডাবেলা, সে মেধাবী আড্ডা কিংবা নেহাতই নরকগুলজার যাই হোক। আসল কথা হল- ঠেকের আমি, ঠেকের তুমি, ঠেক দিয়ে যায় চেনা…!
(লেখক সাহিত্যিক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)