- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
রামলীলা ময়দান, নয়াদিল্লি। ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৩। অরবিন্দ কেজরিওয়াল সেদিন প্রথম শপথ নিতে গিয়ে ভাষণের মাঝে একটি গান গেয়েছিলেন। বহু পুরোনো হিন্দি ছবির গান। হাত নাড়িয়ে, গলার শির ফুলিয়ে গাইছিলেন খড়্গপুর আইআইটির মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কত স্বপ্ন চোখে। বলেছিলেন, এই প্রার্থনার মতো ভারত চাই, সমাজ চাই।
ইনসান কা ইনসান সে হো ভাইচারা
ইয়েহি পয়গম হমারা
নয়ে জগৎ মে হুয়া পুরানা
উঁচ নিচ কা কিসসা
সব কো মিলে মহনত কে মুতাবিক
অপনা অপনা হিসসা
সব কে লিয়ে সুখ কা বরাবর
হো বটওয়ারা
ইয়েহি পয়গম হমারা
দিলীপকুমার-বৈজয়ন্তীমালা অভিনীত পয়গম ছবির গান। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল সে ছবি। গানটার লেখক প্রদীপ। গায়ক মান্না দে।
এগারো বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মানুষের ভ্রাতৃত্ববোধেরই স্বপ্ন ছড়াতে চেয়েছিলেন অরবিন্দ। তাই এই গান। বয়স তখন ৪৪। যে গানে বলা হয়েছিল, মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ জেগে উঠুক। এটাই আমাদের বার্তা। নতুন পৃথিবীতে ধনী ও গরিবের বিভেদ মুছে যাক। সবাই তাদের কঠিন শ্রমের মূল্য পাক, এই বার্তা। সবাই সমান সুখ পাক, এটাই আমাদের বার্তা।
কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর সব মনে পড়ছে।
টাটার দামি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন মানুষের জন্য কিছু করার সুযোগ নেই বলে। বয়স তখন ২৪। জামশেদপুর থেকে কলকাতা এসে দাঁড়িয়েছিলেন মিশনারিজ অফ চ্যারিটির সামনে দীর্ঘ লাইনে। শুধু মাদার টেরেজাকে দেখবেন বলে।
তুমি কী চাও?
মাদার জানতে চেয়েছিলেন বছর চব্বিশের কাছে।
উত্তর এসেছিল, ‘আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই।’
মাদার যা বলেছিলেন, জীবনে ভুলবেন না অরবিন্দ। ‘যাও। কালীঘাটে গিয়ে কাজ করো।’
কালীঘাটে দুঃস্থ ও পরিত্যক্ত শিশুদের মধ্যে মাসকয়েক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিলেন অরবিন্দ। অসুস্থ ও অনাথ বাচ্চাদের তিনি তুলে আনতেন আশ্রমে। অরবিন্দ তখন বলেছিলেন কলকাতা হল দারিদ্র্য আর অসীম ধনের সম্পদ।
কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর সব মনে পড়ছে।
আশার যে প্রদীপটি ভারতীয়দের মধ্যে জ্বালিয়েছিলেন কেজরিওয়াল, তা এক অনন্য। লোভী, প্রতিহিংসাপরায়ণ, ভাঁওতাবাজ, বাকপটু নেতাদের দেখে ভারতীয় জনতা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কেজরি সেখানে আশ্চর্য ফুলমালার মতো এসেছিলেন। দিল্লির শিক্ষাব্যবস্থা, সরকারি স্কুল, সরকারি হাসপাতালের চেহারা পালটে দেন দ্রুত। পাড়ায় পাড়ায় চিকিৎসার মহল্লা ক্লিনিক করা হল। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল, তা ভারতের কোনও রাজ্য আগে দেখেনি। রাজধানীর বেসরকারি স্কুল ও হাসপাতালের বিশিষ্ট মালিককুল কেজরির ওপর চটলেন ব্যবসা মার যাওয়ায়। তবু কেজরি অটল। পরে সেই ভদ্রলোকই অন্য নেতাদের মতো একনায়ক হয়ে গেলেন যে কেন!
কেজরিওয়াল গ্রেপ্তার হওয়ার পর সব মনে পড়ছে।
মনে পড়ছে ইন্দিরা গান্ধির আমলের শেষদিকের কথা। কোথায় যাচ্ছে ভারত? জরুরি অবস্থার সময়ও কি এভাবে বিরোধীদের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছিল না? নাকি তার থেকেও খারাপ অবস্থা এখন? দু’-দুজন মুখ্যমন্ত্রীকে জেলে পাঠানো হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে কার্যত দেউলিয়া করে দেওয়া হয়েছে, যাতে ভোটে বেশি টাকা খরচ করতে না পারে। যখন ইচ্ছে, বিরোধীদের বিরুদ্ধে ইডি-সিবিআই লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার শুভেন্দু অধিকারী, অর্জুন সিং, তাপস রায়দের মতো কেউ দল পালটে এপারে চলে এলে সব অভিযোগ উধাও হয়ে যাচ্ছে। এ কী চলছে?
ক্ষমতার অপব্যবহার করতে করতে মোদি সরকার একদিক দিয়ে বিরোধীদের সুবিধেই করে দিচ্ছে। এরপর দুর্নীতিগ্রস্ত কোনও বিরোধী নেতা গ্রেপ্তার হলে লোকের কাছে তিনি নায়ক হয়ে উঠবেন। লোকে বলবে, উনি দুর্নীতি করেননি। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ইচ্ছাকৃত ব্যবস্থা নিচ্ছেন মোদি-শা। মোদি-ভক্তরা বলে থাকেন, ইন্দিরা গান্ধিকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন নমো। স্টাইলে, বিশ্বজনীন আবেদনে। সেটা কতটা কী হচ্ছে জানা নেই। তবে প্রতিহিংসাপরায়ণতায় ইন্দিরাকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন মোদি। তাঁর থিওরি জলবৎ তরলং। আমার কাছে বশ্যতা স্বীকার করো, তা হলে তোমাকে আশ্রয় দেব। কথা না শুনলেই জেলে। প্রত্যেক রাজনীতিকেরই কিছু না কিছু ফাঁকফোকর থাকে। যে কোনও নেতার ত্রুটি থাকবেই। তাঁকে ব্ল্যাকমেল করা মোদি আমলে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতা থেকে মিডিয়া, সবাই এর শিকার।
নির্বাচনের মুখে মোদি কোম্পানির স্ট্র্যাটেজিগুলো যে কোনও নাবালকও ধরে ফেলবে। ১) প্রথমে শক্তিশালী মিডিয়া সেলের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রচার করে দেওয়া হবে, বিজেপি আবার আসছেই ক্ষমতায়। আব কি বার চারশো পার। ২) যে যে রাজ্যে বিরোধীরা শক্তিশালী, সেখানে রাজ্যপালকে দিয়ে অস্থিরতা তৈরি করা হবে। ৩) চারশো সম্পর্কে নিশ্চিত না হলেও বারবার বলতে বলতে সেটাই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ৪) নিজেরা নির্বাচনি বন্ড বা সিএএ ইস্যুতে চাপের মধ্যে থাকলে সেটাকে চাপা দেওয়ার জন্য নিজেদের পছন্দমতো ইস্যু তৈরি করে নেবেন রাতারাতি। ৫) মোদি ম্যাজিক দশ বছর থাকার সুবাদে ম্লান হয়ে গেলে সমস্যা নেই। হিন্দুত্ব ও রাম মন্দির ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু ভোট নিশ্চিত করে নেওয়া হবে। ৬) আগের নীতি থেকে সরে এসে জেতার জন্য যে কোনও আদর্শহীন দলবদলিয়াদেরও নিয়ে নেওয়া হবে। আরএসএস আপত্তি করলে বলা হবে, আমরা তো আপনাদের সব পরিকল্পনা সফল করছি। ভোটে যে কোনওভাবে জেতার ব্যাপারটা আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। ৭) মূল শত্রু কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও বিরোধীদের জোট করতে দেওয়া হবে না। কংগ্রেসকে বিচ্ছিন্ন করে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ চালাতে হবে ৮) ভোটে জেতার জন্য আগে কে শত্রু ছিল, ভাবলে চলবে না। নবীন পট্টনায়েকের মতো নির্বিরোধী লোক, যাঁর জাতীয় স্তরে কোনও স্বপ্ন নেই, তাঁদের সঙ্গে জোট চলবে। লক্ষ্য সেই এক। কংগ্রেসকে বাড়তে দেওয়া চলবে না। কমিউনিস্টদেরও না।
কেজরির গ্রেপ্তার পর্ব বলে দিল, রাজধানীর ভোটেও জেতার ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত নয় বিজেপি। সাতটা আসনে বেশি জিতলে তো হবে না। তাদের ৭-০ স্কোর চাই। কেজরি জেলে গেলে এই স্কোর করা সুবিধে। আপ এবং কংগ্রেস জোট না হলে হয়তো এই গ্রেপ্তার নাটক হত না। এসব দেখেশুনে রাজস্থানের আলোয়ারের একটি সাম্প্রতিক ঘটনা মনে পড়ে। যা পড়ে হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না প্রথমে। তারপর ভেবে দেখলাম, এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের দেশে এটাই এখন স্বাভাবিক নিয়ম। এক চোর নিয়মিত সেখানে মন্দিরে মন্দিরে চুরি করে বেড়াত। সিসিটিভিতে দেখা গিয়েছে, প্রতিবার চুরি করার সময় চোর মূর্তির সামনে বসে প্রণাম করছে। বলছে, আমার অপরাধ নিও না মা। তারপরই প্রবল বিক্রমে ঝাঁপাচ্ছে চুরি করার জন্য।
আমাদের দেশে অধিকাংশ পার্টির অধিকাংশ নেতার এই দুর্দশা।
কেজরিওয়াল তাঁর ভাঙা গলায় অনেকটাই বেসুরো গলায় আপ্রাণ গাইতেন,
হরেক মহল সে কহো কে
ঝোপড়িয়া মে দিয়া জলায়ে
ছোটো অউর বড়ো মে অব
কোই ফরক নহি রহ যায়ে
ইস ধরতি পর হো প্যায়ার কা
ঘর ঘর উজিয়ারা
ইয়ে পয়গম হমারা
কে আর এখন দিয়া জ্বালাবে? কে আর এখন ভালোবাসার বার্তা দেবে?
আপনার বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যদি প্রবাসী বাঙালি বন্ধু থাকেন, তা হলে খুব মুশকিল। প্রবাসীরা অধিকাংশই হিন্দুত্বের ধ্বজা ধরে বোঝানোর চেষ্টা করবেন, বাংলায় সবদিক থেকে কত দুরবস্থা। হোয়াটসঅ্যাপে এমন সব অর্ধসত্য ছড়ানো হবে, যেন ভিনরাজ্যের অবস্থা খুব ভালো। এ কথা সত্যি, বাংলায় তৃণমূল সরকার চারদিক থেকে ল্যাজেগোবরে। কিন্তু সোনার রাজ্য বলতে কি আমাদের ভারতে আর কোথাও রয়েছে? হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, মুম্বই, গুরগাঁও, পুনে, লখনউ- সব শহর থেকে দুর্বৃত্তায়নের খবর আসে। অসততার পাহাড় চুরিরও।
আর বাংলার এই দুরবস্থার দায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারী, অধীর চৌধুরী, বিমান বসু- সবাইকেই নিতে হবে এবং হ্যাঁ, মোদিকেও। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সব রাজ্যকে সমান চোখে দেখা উচিত ছিল। তা তিনি করেননি। জগদীপ ধনকর বা আনন্দ বোসদের মতো রাজ্যপালকে তোল্লাই দিয়ে তিনি বাংলায় আরও ডামাডোল তৈরিতে আগুন জ্বালিয়েছেন। সব বিরোধী রাজ্যেই রাজ্যপাল হয়ে উঠেছেন রাজনীতির বোড়ে।
জরুরি অবস্থার সময়ের ইন্দিরা গান্ধিকে তো আরও বেশি করে মনে পড়বে।