- দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী
নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরে আসা এখন কার্যত একটি পূর্বনির্ধারিত উপসংহার। শেষপর্যন্ত সেটাই ঘটলে ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম কোনও একটি দল টানা তিনবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহ জয়ী হবে। এটি অবশ্যই ভারতীয় রাজনীতিতে একটি বিশাল দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যেমন প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের জয় ছিল অবধারিত, এখন দেখা যাচ্ছে তেমনই একটা পর্যায়ে আবার আমরা প্রবেশ করেছি, যেখানে ‘জিতবে কে’ আর প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে কে কত আসন পাবে।
১৯৬৭ সালের আগে বিরোধীরা সবাই আলাদা আলাদাভাবে লড়ত এবং হেরে ভূত হত। ’৬৭ সালে তারা প্রথম ঐক্যবদ্ধ হল, কংগ্রেসকে জোর ধাক্কা দিল এবং ন’টা রাজ্যে বিরোধীদের সরকার হল। আবার ’৭১ সালে তাদের জোট পর্যুদস্ত হয়েছিল, যেমন এবারও বিরোধীদের আধখ্যাঁচড়া জোট পর্যুদস্ত হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হল : জনসংঘ ও বিজেপির অ্যাজেন্ডা প্রায় পুরোদস্তুর একরকম হওয়া সত্ত্বেও কেন জনসংঘ কখনোই সাধারণ নির্বাচনে (১৯৫২-১৯৭১) ১০ শতাংশের বেশি ভোট শেয়ার অর্জন করতে পারেনি, অথচ বিজেপি হিসাবে তারা এত ভালো করছে? অগভীর, জনপ্রিয় ব্যাখ্যা হল এ সবই মোদি-জাদু। কিন্তু, বিজেপির উত্থান তো শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সাল থেকে, এবং প্রথম পর্যায়ে তা অব্যাহত ছিল ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত।
আমরা জানি এই উত্থানের মধ্যে দিয়ে কেন্দ্রে প্রথম বিজেপি সরকার তৈরি হয়েছিল। তখন তো মোদি মুখ্যমন্ত্রীও হননি, তাঁর নামও প্রায় কেউ জানত না। মোদির উত্থান হল বিজেপির দ্বিতীয় পর্যায়ের উত্থানের গল্প, যখন ২০১৪ থেকে বিজেপি একাই গরিষ্ঠতা পেতে শুরু করল। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কিত দুর্দশা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কঠিন বছরগুলির পরেও কেন মোদি-জাদু তাঁর উজ্জ্বলতা হারায়নি?
একথা অবশ্যই ঠিক যে এবারের লোকসভা ভোটের ফল পূর্বানুমান করে আমরা এই কথাগুলো লিখছি। কাজেই কেউ বলতেই পারেন যে এগুলো এখনই মানছি না। ঠিক তো, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। কিন্তু ঘটনা হল, এমন একটা বাতাবরণ তৈরি হয়ে গিয়েছে যেখানে মানু্ষ প্রশ্ন করছেন, বিজেপি কি সত্যিই একাই চারশো পেরোবে? প্রশ্ন হল, এমন বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে কেন? কেন কট্টর সমর্থকরা ছাড়া কেউ বিরোধীদের ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না? ২০০৪ সালেও অটলবিহারী বাজপেয়ীর জয় অবধারিত বলে সমীক্ষাগুলো দেখিয়েছিল, কিন্তু মানুষের মনোভাব ছিল ‘দেখা যাক কী হয়’ গোত্রের। এবার সেই সংশয়টাই যেন নেই (যেটা বিজেপির পক্ষে খারাপ, কারণ তাদের অনেক ভোটার এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বুথে না যেতেও পারেন)।
এইসবের উত্তর সাধারণ রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মধ্যে পাওয়া যাবে না। এখানে তার একটা অতিসংক্ষিপ্তসার উল্লেখ করছি।
সেকুলারেরা যে কথন (ন্যারেটিভ) আমাদের উপর গত ৫০-৬০ বছর ধরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তা চিরন্তন ভারতীয় কথনের বিরোধী। পুরো অ্যাকাডেমিয়া ও ইন্টেলেকচুয়ালদের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে তাঁদের তৈরি করা কথনটি যাতে গ্রহণযোগ্য হয়, তার জন্য তাঁরা রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধি, সুভাষচন্দ্র বসু এবং এমনকি জওহরলাল নেহরুর বিভিন্ন বক্তব্য টেক্সট বই থেকে শুরু করে যাবতীয় সামাজিক কথন থেকে লোপাট করে দিয়েছিলেন। এর অজস্র উদাহরণ আছে। এখানে তার এক ঝলক তুলে দিলাম :
রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি চিত্রিত করার উদ্দেশে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভারতীয় ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুনর্লিখনের দাবি করেছিলেন। সেই নিবন্ধে (ভারতবর্ষের ইতিহাস) তিনি বিশেষ করে বারাণসী ও নবদ্বীপের উল্লেখ করেছিলেন, এবং ভারতীয় সংস্কৃতির পাঠ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। গান্ধি তাঁর ‘রামনাম’ শীর্ষক সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে বলেছিলেন, রামনাম জপ করতে মুসলমানদের কোনও আপত্তি থাকা উচিত নয় (যদিও চাইলে তাঁরা রামের বদলে আল্লাও বলতে পারেন)। সুভাষচন্দ্র পশ্চিমী বিশ্বে, এবং আফ্রিকানদের হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য আফ্রিকায়, হিন্দু ধর্ম প্রচার করা উচিত বলে দাবি করেন। নেহরু তাঁর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া বইতে আমাদের মহান প্রাচীনকাল এবং আমাদের জাতীয়তাবাদে সেই অতীতের ভূমিকার কথা বারবার বলেছেন, এবং আমাদের হিন্দু দর্শন সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের ভারতে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, এবং কেউ গায়ের জোরে এর অবসান ঘটায়নি বলে তিনি স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। আমাদের সংবিধান রাষ্ট্রকে গোহত্যা বন্ধ করতে এবং অভিন্ন সিভিল কোড চালু করতে বলেছে (নির্দেশমূলক নীতি)।
উল্লিখিত সবক’টি বিষয়কে এখনকার সেকুলারেরা ‘হিন্দুত্ববাদী’ দাবি বলে চিহ্নিত করে থাকেন। আমাদেরও অনেক সময় এমনই মনে হয়। কারণ, গত ৫০ বছর ধরে সংগঠিতভাবে আমাদের স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদের জনকদের এমন অজস্র বক্তব্য আমাদের চোখের আড়াল করে রাখা হয়েছিল। ক’জন মানুষ আর রবীন্দ্রনাথ, গান্ধি, নেতাজি, নেহরুর রচনা সমগ্র পড়বেন? আমরা তো সাধারণত তাঁদের নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করেন, সেইসব বিশেষজ্ঞের লেখা থেকে এঁদের কথা জেনেবুঝে নিই। এই বিশেষজ্ঞরাই অর্ধসত্য তুলে ধরেছিলেন। ফলে মহীরুহদের অনুসারী বহু বক্তব্যকে সেকুলারেরা ‘হিন্দুত্ববাদী’ তকমা দিয়েছেন। কিন্তু সত্যকে তো লোপাট করা যায় না। ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেই সত্য ক্রমশ বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে কারা যেন কখন কীভাবে আমাদের ব্রেনওয়াশ করেছে। সেকুলারিজম বলে এমন কিছু তারা প্রচার করেছে যা প্রাক-স্বাধীনতা মহীরুহদের চিন্তাভাবনার বিপরীত। মহীরুহরা আমাদের প্রাচীনকাল, আমাদের সংস্কৃতি ও সনাতন ধর্ম নিয়ে গর্বিত ছিলেন। অথচ আমাদের উলটো সব কথা শেখানো হচ্ছিল।
সমাজের নিতান্ত সাধারণ মানুষ বলে যাঁরা গণ্য হন, তাঁরা সবসময়েই চিরন্তন ভারতীয় সংস্কৃতির অনুসারী জীবনই যাপন করে এসেছেন। তাঁদের কাছেও এখন রবীন্দ্রনাথ, গান্ধির অন্য ধরনের সব লেখা পৌঁছে যাচ্ছে। তাঁরা মনে করেছেন আধুনিক এলিটরা তাঁদের সমন্বিত স্মৃতিতে থাকা বহু হাজার বছরের পুরোনো সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে হিন্দুবিরোধী, সংখ্যালঘুবাদী, এবং কমিউনিস্ট (ইউএসএসআর)-অনুপ্রাণিত কথন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখন তার বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। সেই প্রতিক্রিয়ায় সমাজের প্রায় সব স্তর, বিশেষ করে দেশের ৮০ শতাংশ হিন্দুর ক্রমবর্ধমান অংশ মিশে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী এক ভারতের উত্থান মানুষের আত্মবিশ্বাসও অনেক, অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে (পেশায়, খেলায়, রাজনীতিতে সর্বত্র), এবং এই আত্মবিশ্বাসী মানুষ এখন দেশের সংস্কৃতি ও প্রাচীন গৌরবগাথার পক্ষে রুখে দাঁড়াচ্ছেন।
এরই প্রতিফলন আমরা দেখছি লোকসভার ভোটে। কংগ্রেস, আপ, তৃণমূল সহ বিরোধীরা যেদিন বুঝতে পারবে ‘চিরসারথি’র ‘রথচক্রে মুখরিত’ পথই এ দিশের একমাত্র সংস্কৃতি, সেদিন এরা হয়তো সত্যিকারের চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠবে। তার আগে পর্যন্ত যাবতীয় সংকীর্ণতা সত্ত্বেও বিজেপির হিন্দুত্বই একচ্ছত্র হয়ে থাকবে।
(লেখক সাংবাদিক)