Tuesday, April 30, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়উত্তরবঙ্গে এখনও গুলিয়ে অনেক অঙ্ক

উত্তরবঙ্গে এখনও গুলিয়ে অনেক অঙ্ক

  • সুমন ভট্টাচার্য

ঘটনা ১ : পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, তিনি উত্তরবঙ্গের জন্য এত কিছু করেন, তাও কেন রাজ্যের এই প্রান্ত তাঁকে শূন্য হাতে ফেরায়! তৃণমূল নেত্রীর এই আক্ষেপের কারণ হয়তো গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল। ২০১৯ সালে উত্তরবঙ্গ যে শুধু তৃণমূলকে শূন্য হাতে ফিরিয়েছিল তাই নয়, বিজেপি বা পদ্ম শিবিরকে হাত উপুড় করে দিয়েছিল।

মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য শুধু ২০১৯-এর কথা বলেননি, এমনকি ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনেও কীভাবে ফলাফল তাঁকে হতাশ করেছিল তাও মনে করিয়ে দিয়েছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে গোটা রাজ্যে ঘাসফুলের ঝড় বইলেও উত্তরবঙ্গে কিন্তু রাজ্যের শাসকদলের সব ডাকসাইটে নেতা, মন্ত্রীরা হেরে গিয়েছিলেন। গৌতম দেব থেকে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, সৌরভ চক্রবর্তী থেকে উদয়ন গুহ, ২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত তৃণমূলের হেভিওয়েটদের তালিকা বেশ দীর্ঘ ছিল।

স্বভাবতই মমতার আক্ষেপের কারণ বোঝা যায়। কিন্তু কেউ কি তাঁকে, মুখ্যমন্ত্রীকে সাহস করে বলবে যে, তিনি যেদিন রায়গঞ্জের প্রস্তাবিত এইমসকে দক্ষিণবঙ্গের কল্যাণীতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেইদিন থেকেই উত্তরবঙ্গের মানুষ যে গোসা করে রয়েছেন, তা আর ভাঙানো যায়নি! এমনিতেই স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়নের নিরিখে অবহেলিত, প্রান্তিক মানুষের বসবাসের জন্য পরিচিত উত্তরবঙ্গ সেই যে মমতার কাছেও সে ‘দুয়োরানি’ বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, শত চেষ্টাতেও কি আর মমতা সেই অভিমান ভাঙাতে পেরেছেন?

বরং এটা রাজ্যের শাসকদলের সৌভাগ্য যে, গেরুয়া শিবির হিন্দুত্বের আস্ফালন করতে বা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান মানুষের মস্তিষ্কে গেঁথে দিতে যতটা সক্রিয়, উত্তরবঙ্গকে এইমস পাইয়ে দেওয়া হবে, এই প্রতিশ্রুতির কথা ততটা জোর গলায় বলে না।

ঘটনা ২ : দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং আরএসএসের পছন্দের পাত্র রাজনাথ সিং উত্তরবঙ্গে সভা করতে এসে সবকিছু নিয়ে কথা বললেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে গালোয়ান সীমান্তে চিনের আগ্রাসন। শুধু উত্তরবঙ্গের চা বাগানের সমস্যা নিয়ে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। যিনি মমতা সরকারের বিরুদ্ধে মোদি সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যকলাপে ‘অসহযোগিতা’র কথা তোলেন, তিনি কেন উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় সমস্যা, বন্ধ চা বাগান এবং সেখানকার শ্রমিকদের বিষয় নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন? তাহলে কি আমাদের ধরে নিতে হবে, উত্তরবঙ্গকে নিজেদের ঘাঁটি মনে করতে শুরু করা গেরুয়া শিবিরের নেতারাও আসলে উত্তরবঙ্গের মন বোঝেন না?

ভুলে গেলে চলবে না, ২০০৯ থেকে টানা তিনবার দার্জিলিং আসন বিজেপির ঝুলতে গিয়েছে। আর ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে গোটা উত্তরবঙ্গের রং-ই তো গেরুয়া!

এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে দেখেছি, এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে শুধুই বিজেপির পতাকা। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার গেলে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য বিলোনো গেরুয়া নিশান কিংবা ‘উগ্র হনুমান’-এর ছবি দেওয়া পতাকা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। যা সব দেখেশুনে দিল্লি থেকে সরাসরি বাগডোগরায় এসে নামা দিল্লির সাংবাদিককুল, বা বিরোধীরা যাদের পরিহাস করে ‘মোদি ভক্ত মিডিয়া’ বলে থাকে, তারা অবলীলায় লিখেছে, উত্তরবঙ্গের হৃদয়ে মাত্র দুটো জিনিস আছে, শ্রীরাম এবং নরেন্দ্র মোদি। গেরুয়া শিবিরের তৈরি করা এই নির্মাণ বা ‘পপুলার ন্যারেটিভ’ কোথাও ধাক্কা খেয়ে যায় বিজেপির হেভিওয়েট নেতাদের বক্তৃতা শুনে।

দার্জিলিংয়ের আইকনিক রেস্তোরাঁ, ‘গ্লেনারিজ’ মালিক থেকে ‘হামরো পার্টি’ গড়ে প্রথম নির্বাচনে, অর্থাৎ দার্জিলিং পুরসভার ভোটে সবাইকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য পাওয়া অজয় এডওয়ার্ড অবশ্য গেরুয়া শিবিরের দাবি শুনলে হাসেন। দেশের একপ্রান্তের ‘পাহাড়ি’ হিসেবে যিনি ‘অন্যপ্রান্তের পাহাড়ি’ অর্থাৎ লাদাখের সোনাম ওয়াংচুখের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে ছুটে যান, তিনি তো অবশ্যই গেরুয়া শিবিরকে ‘জুমলাবাজ’ বলে বিঁধবেনই। অজয় পাহাড়ের রাজনীতিতে প্রবেশ করেই যতটা চমক জাগিয়েছিলেন, এবারও ততটাই সাড়া ফেলতে চান কংগ্রেসের সঙ্গে জোট তৈরি করে। পাহাড়ের রাজনীতিকে পদ্ম শিবির এবং তার বিরুদ্ধে তৃণমূলের মদতে তৈরি হওয়া অনীত থাপার যে দ্বিমুখী সমীকরণ রয়েছে, সেটাকে বদলে দিয়ে নতুনতর রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরি করতে তিনি মরিয়া।

লোকসভা নির্বাচনের আগে যখন গেরুয়া শিবিরের হেভিওয়েট নেতারা উত্তরবঙ্গে মোটামুটি ‘ডেইলি প্যাসেঞ্জারি’ করছেন আর তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উত্তরবঙ্গেই ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছেন, সেইসময় উত্তরবঙ্গে কি সত্যি কংগ্রেস-বাম জোট নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? এই প্রশ্ন আরও প্রাসঙ্গিক কারণ উত্তরবঙ্গের আটটি আসনের মধ্যে তিনটি, মালদার দুটি আসন এবং রায়গঞ্জ কিছুদিন আগে পর্যন্তও কংগ্রেসের ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল। মালদহের জন্য যদি, ‘গনি-মিথ’ কার্যকরী ছিল তো রায়গঞ্জ থেকে লাগাতার লোকসভায় গিয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি এবং তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে তাঁর স্ত্রী দীপা দাশমুন্সি।

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মালদার একটি আসন গনি পরিবার ধরে রাখতে পারলেও অন্য আসনটি বিজেপি জিতেছিল শুধুমাত্র কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মধ্যে ভোট কাটাকাটির ফলেই। এবার মালদার দুটি আসনই পেতে যতটা মরিয়া বিজেপি, ততটাই আশাবাদী রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্ব। গেরুয়া শিবিরের যদি ভরসার কারণ হয়, মালদার একটি আসনে খগেন মুর্মুর জয়, তাহলে অন্য আসনে নামমাত্র ব্যবধানে শ্রীরূপা মিত্রর ডালুবাবুর কাছে হার।

এবার অবশ্য কংগ্রেসের সেই জেতা আসনে পিতার পরিবর্তে পুত্র প্রার্থী, কিন্তু ইশা খাঁ-কে পরাস্ত করতে ফের আসরে রয়েছেন শ্রীরূপা মিত্রই। কিন্তু কংগ্রেসের গড়রক্ষা, বা আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের আসন সংখ্যা বাড়াতে, স্কোর বোর্ডে ভদ্রস্থ নাম তুলতে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের তৎপরতা কোথায়? রাহুল গান্ধি সেই ‘ভারত জোড়ো ন্যায়যাত্রা’ করার সময় মালদা দিয়ে গিয়েছেন বটে, কিন্তু শিয়রে ভোট এসে পড়ার পরে উত্তরবঙ্গে গান্ধিদের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন জাগবেই। বিশেষ করে গেরুয়া শিবির যেভাবে ‘কার্পেট বম্বিং’ করে চলেছে, অর্থাৎ প্রচারে একদিন মোদি, তো পরের দিন অমিত শা, তারপরেই রাজনাথকে এনে ঝড় তুলতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কংগ্রেসের পালটা জবাব কোথায়?

গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকবার পাহাড় এবং উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক প্রচারকে কাছ থেকে দেখার পর কয়েকটা বিষয় টের পাওয়া যায়। পাহাড়ের তৃণমূলের ওপর ‘রাগ’ ‘জুলুম’ করার অভিযোগে। আর বাকি উত্তরবঙ্গের মনে রাজ্যের শাসকদলের ওপর ‘অভিমান’ রয়েছে। সেই অভিমান এইমস না পাওয়ার কারণে হতে পারে, মমতার ‘ঘনিষ্ঠ বৃত্ত’ উত্তরবঙ্গকে চেনে না, এই ধারণা থেকেও হতে পারে। আর অবশ্যই তৃণমূলের এই ‘ক্ষত’কে উসকে দিয়ে গত পাঁচ বছরে রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড পেয়েছে বিজেপি। উত্তরবঙ্গের আদিবাসী এবং জনজাতিদের মধ্যে আরএসএস এবং তার শাখা সংগঠন বনবাসী কল্যাণ পরিষদের লাগাতার কাজ করে যাওয়া অবশ্যই গেরুয়া শিবিরের রাজনৈতিক জমিকে শক্তপোক্ত করেছে। কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভে বিজেপির দিকে ঝোঁকা আসলে কি সত্যিই উত্তরবঙ্গকে কিছু দিয়েছে?

মমতা উত্তরের জন্য তাঁর সরকারের পারফরমেন্স বলতে গিয়ে সবসময়ই কত নির্মাণ হয়েছে তার দীর্ঘ পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। কিন্তু তৃণমূলের সেই ন্যারেটিভ কেন উত্তরবঙ্গের মানুষের মন জয় করতে পারে না? আবার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেরুয়া শিবিরই বা কতটা স্কোরবোর্ডে রান তুলতে পেরেছে? যদি তুলতে পারত তাহলে তো আর আলিপুরদুয়ার, রায়গঞ্জের মতো আসনে তাদের জেতা প্রার্থীদের, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের প্রার্থীপদ বাতিল করতে হত না। তাহলে কি দিল্লির শাসকদল এবং রাজ্যের শাসকদল একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে? দুই শিবিরকেই কি উত্তরবঙ্গ আবারও বিশিষ্ট ভাওয়াইয়াশিল্পী ধনেশ্বর রায়ের ওই গানটি শোনাতে চায়?

“একবার উত্তর বাংলা আসিয়া যান/হামার জাগাখান দেখিয়া যান/মনের কথা বলিয়া যান রে,/ বন্ধু হামার কথাও শুনিয়া যান রে।”

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Raiganj | স্বামীর পরকীয়ার প্রতিবাদ করার পরই নিখোঁজ বধূ, খুনের আশঙ্কা পরিবারের

0
রায়গঞ্জ: স্বামীর পরকীয়ার প্রতিবাদ করার পর থেকেই নিখোঁজ স্ত্রী। রায়গঞ্জের মেরুয়াল এলাকার ঘটনা। নিখোঁজ মহিলার নাম সীমা ধর। তার পরিবারের অভিযোগ, সীমার ওপর প্রায়...

Telangana | অমিত শাহের ভিডিও বিকৃতির জের, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীকে সমন দিল্লি পুলিশের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ-র বিকৃত করা ভিডিও তেলেঙ্গানা কংগ্রেসের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে শেয়ার করার অভিযোগে দিল্লি পুলিশ সমন পাঠাল তেলেঙ্গানার...

Narendra Modi | বাতিল শা’র সভা, ৩ মে নির্বাচনি প্রচারে কৃষ্ণনগরে আসছেন মোদি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আগামী ১৩ মে চতুর্থ দফায় লোকসভা ভোট (Lok Sabha Election 2024) কৃষ্ণনগরে (Krishnanagar)। তার আগে মহুয়া মৈত্রের (Mahua Moitra) কৃষ্ণনগরে...

CM Mamata Banerjee | ‘সিপিএম কিনলে কংগ্রেস ফ্রি’, জোটকে কটাক্ষ মমতার

0
খড়গ্রাম: দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন নিয়োগ দুর্নীতিতে রাজ্যকে ধাক্কা দিল, ঠিক তখন মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামের নির্বাচনি জনসভা থেকে ফের শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবিকে উসকে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী...

TMC | নির্বাচনি আচরণবিধির পরোয়া নেই, সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন তৃণমূলনেত্রী

0
হরিশ্চন্দ্রপুর: নির্বাচনি আচরণবিধি চলছে। কিন্তু তা তোয়াক্কা করছেন না তৃণমূলের ব্লক সভানেত্রী তথা জেলা পরিষদের সদস্য। নির্বাচনি আচরণবিধি চলাকালীনই তৃণমূলের(TMC) হরিশ্চন্দ্রপুর-১ (বি) সাংগঠনিক ব্লকের...

Most Popular