- ঋতব্রত গুহ
আপনি সকালে মোবাইলটা নিয়ে স্ক্রোল করা শুরু করলেন। ভাবলেন পাঁচ-দশ মিনিট একটু রিলস দেখলে কি আর এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? কিন্তু একটা-দুটো করে রিল দেখতে দেখতে হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, আপনি ইতিমধ্যে নষ্ট করে ফেলেছেন এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময়। এই অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কমবেশি হয়। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। একটু সময় পেলেই আমাদের চোখ আটকে যায় সেই মোবাইলের স্ক্রিনে। এই প্রবণতার ফলে জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু। কিছু অর্থহীন কারণে মহামূল্যবান সময় ক্রমাগত অপচয় করে চলেছি আমরা।
ফোমো অথবা ফিয়ার অফ মিসিং আউট সোশ্যাল মিডিয়ার একটি ক্ষতিকারক দিক। আমার জীবন থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ কি হারিয়ে গেল? অথবা আমি কি কোনও গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট অথবা তথ্য মিস করে গেলাম! এই বোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে আমরা বারবার মোবাইল চেক করতে থাকি। অনেক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাঝেই আমরা অন্যমনস্ক হয়ে যাই। আর যদি আমরা নিজেরা কোনও পোস্ট বা রিলস শেয়ার করি তবে তো কোনও কথাই নেই। দশ মিনিট বাদে বাদে আমরা দেখতে থাকি কতগুলো লাইক পড়ল অথবা কতজন কমেন্ট করল। সেই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে আমরা নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা নির্ধারণ করি। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের কি পরিমাণ মানসিক ক্ষতিসাধন করছে তা এই প্রবণতা থেকেই অনুমেয়। এই ভার্চুয়াল অ্যাপ্রিসিয়েশন পাওয়ার তাগিদ আমাদের স্বাভাবিকতা নষ্ট করছে ক্রমাগত।
আরেকটা প্রবণতাও খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমরা এখন ভাবছি আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধুরা আমাদের থেকে ভালো জীবন কাটাচ্ছে। ধরা যাক, আমার কোনও বন্ধু প্রবাসে একটি সুন্দর লেকের ধারে তার একটা অসাধারণ ছবি পোস্ট করেছে। আমার তখন মনে হবে যে তার জীবন কত ভালো। সে কী সুন্দর জীবনযাপন করছে। ভালো হোটেল বা ভালো জায়গায় ঘুরতে গিয়ে আজকাল সবাই ছবি পোস্ট করে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লাইফস্টাইল ভ্লগ। আমরা অনেকেই মানতে চাই না সেগুলো স্ক্রিপ্টেড। প্রত্যেক মানুষের জীবন সুখ-দুঃখের মিশেল। সোশ্যাল মিডিয়ার লেন্সে অথবা একটি মাত্র মুহূর্তের অভিব্যক্তিতে একজনের মানসিক অবস্থা বোঝা সম্ভব কি? এই অর্থহীন তুলনা আমাদের ঠেলে দেয় অবসাদের গহ্বরের দিকে।
ফোকাস বা মনঃসংযোগের ওপরও অত্যধিক সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের একটা কুপ্রভাব রয়েছে। আমরা যদি কাজের মাঝে বারবার মোবাইল দেখতে থাকি তবে তো এটা খুব স্বাভাবিক যে আমরা মন দিয়ে কাজটা করতে পারব না। কাজে ভুল হবে। আশানুরূপ ফল পাব না। যারা এখন ছাত্র, তাদের মধ্যে মনঃসংযোগের যে অভাব দেখা যাচ্ছে তার কিন্তু একটা বড় কারণ এই সোশ্যাল মিডিয়া।
এই প্রযুক্তির সুফলগুলো নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। অনেক ক্ষেত্রেই বিপ্লব এনেছে এই প্রযুক্তি। কিন্তু এর কুপ্রভাব সম্পর্কে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। নইলে বিপদ এড়ানো যাবে না।
(লেখক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, শিলিগুড়ির বাসিন্দা)