- মিরাজুল ইসলাম
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন – ‘রাজা আসে যায় রাজা বদলায় /জামা কাপড়ের রং বদলায় / দিন বদলায় না!’
আজ থেকে ১৮ বছর আগে বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচারের নেতৃত্বে একটি রিপোর্টে তৎকালীন সরকারের মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যের নগ্নচিত্র ধরা পড়ে। সেই রিপোর্টে জানা যায়, সারা দেশের তুলনায় বাংলার মুসলমানদের অবস্থা বেশি করুণ। সেই সময় সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অবস্থান ছিল ২.১ শতাংশ। ইদের আগে একটা কথা মনে হয় বারবার। বর্তমান সরকার মুসলমানদের সামনে উন্নয়নের টোপ ঝুলিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলেছে তাতে সন্দেহ নেই। অথচ রিপোর্ট পরবর্তী এই ১৮ বছরে বাঙালি মুসলমানের উন্নতি কতটা হয়েছে?
আজকের সরকারপক্ষ বিরোধী অবস্থায় নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষমতায় এসে সব ভুলে বসে আছে। সরকার বলে, ‘একশো শতাংশ কাজ হয়ে গিয়েছে’। বিরোধীরাও সরকারের মুসলিম তোষণের অভিযোগ চড়া সুরে করেন। কিন্তু বিভিন্ন সমীক্ষার ভিত্তিতে যেসব তথ্য আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে মুসলমানদের বিশেষ উন্নতি হয়নি।
মুসলিমদের ওবিসি আওতায় নিয়ে এসে ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণের আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে। কল্যাণী, যাদবপুর সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে ওবিসি সংরক্ষণ মানা হয়নি। সংরক্ষণ মানা হচ্ছে কি না খতিয়ে দেখার জন্য রাজ্য সরকারের কোনও সেল নেই। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপে বাইরে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের অধিকাংশ মুসলিম। প্রতীচী ইনস্টিটিউটের রিপোর্ট বলছে, বর্তমানে ৬৪.৭ শতাংশ মুসলিম পরিবার দারিদ্র্যসীমার নীচে, ৪৭ শতাংশ মুসলমান খেতমজুর, দিনমজুর।
ইদের প্রেক্ষাপটে আরও কিছু তথ্য চমকে দিতে পারে। স্টাফসেন্সাস রিপোর্টে জানা যায়, সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের অবস্থান ৫.৭৩ শতাংশ। সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মুসলিম শিক্ষকের অনুপাত ৭.৮ শতাংশ। রাজ্য পুলিশে মুসলিম যোগদান ৯.৪৪ শতাংশ। রাজ্যে স্নাতক করছে ১২.৫ শতাংশ, স্নাতকোত্তর করছে ৭.৭ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে যে শতাংশ হার বৃদ্ধি পেয়েছে, তার নেপথ্যে ভূমিকা আল আমিন মিশন সহ অন্য মিশনারি স্কুলগুলির।
উত্তরবঙ্গের মুসলমানরা আরও পিছিয়ে, মুসলিমদের এলাকায় নেই ভালো স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি। মাদ্রাসা স্কুলগুলি পরিকাঠামো ও শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হওয়ার মুখে। উত্তরবঙ্গের মুসলিম মেয়েদের উচ্চশিক্ষা, সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণ আরও করুণ। মুসলিমদের উচ্চশিক্ষার জন্য আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হল। শুরুতে ভালো চললেও এখন অর্থ, পরিকাঠামোর অভাব, দুর্নীতি সহ বিভিন্ন রোগে জীর্ণ। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তর দেখছেন। কিন্তু কাজের মধ্যে নজরে পড়েছে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বিল্ডিং, ৩টি হস্টেল, হজ হাউস, ইমাম ভাতা, ইফতারের মজলিশ ও দুই ইদে রেড রোডের জামাতে ভাষণ। প্রত্যেক বছরে ঘটা করে সংখ্যালঘু বাজেট বরাদ্দ হয়, কিন্তু অধিকাংশ অর্থই ব্যয় হয় না।
বঙ্গে হিন্দু-মুসলমান, শতকের পর শতক পাশাপাশি বাস করলেও এক উদাসীনতা ছুঁয়ে যায় ইদের উৎসবে। আগের বছরে ইদের ছুটিতে কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরছি, ট্রেনে দুজন ভদ্রলোক গল্প করছেন, পরশুদিন অফিস ছুটি। কীসের ছুটি রে? অন্যজন অবজ্ঞার সুরে উত্তর দিলেন ‘মুসলমানদের ইদ না মহরম কী একটা আছে।’ কলকাতায় ঘর ভাড়া নিতে গেলে আগে জিজ্ঞাসা করে বাঙালি না মহামেডান। দ্বিধায় পড়তে হয়। ইদানীং আমাদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে বিরল রোগ, আমরা কেমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। অথচ এই ইদ মিলনের কথা বলে।
(লেখক আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, কুশমণ্ডির বাসিন্দা)