Saturday, May 4, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়হিগস : নিজস্ব নিয়মে ব্যতিক্রমী বিজ্ঞানী

হিগস : নিজস্ব নিয়মে ব্যতিক্রমী বিজ্ঞানী

 

  • অতনু বিশ্বাস

কিংবদন্তি ব্রিটিশ পদার্থবিদ পিটার হিগস সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন ৯৪ বছর বয়সে। আর পাঁচজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর তুলনায় হিগস কিন্তু ছিলেন বেশ আলাদা। বলা চলে আজকের সমাজের মানদণ্ডে তিনি ছিলেন এক বিরল ব্যতিক্রম। হিগসের প্রয়াণ তাই যেন আজকের দিনে দাঁড়িয়ে অসংখ্য বিজ্ঞান পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞানীদের স্তূপীকৃত গবেষণাপত্র ছাপানোর হুড়োহুড়ির মধ্যে বিরল ব্যতিক্রমী এক ধারার অন্যতম শেষ পথিকৃতের প্রয়াণ।

গবেষক হিসেবে হিগস যে দুর্দান্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর যুগান্তকারী তত্ত্ব, ‘হিগস বোসন’-এর মাধ্যমে তিনি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে ‘বোসন’ বেঁধে রেখেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে। পার্টিকেল ফিজিক্সের ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ যেন পূর্ণতা পেল হিগসের ১৯৬৪-এর এই তাত্ত্বিক আবিষ্কারের মাধ্যমে।

তারপর কেটে যায় দীর্ঘ ৪৮ বছর। সুইৎজারল্যান্ডের ফরাসি সীমান্তের কাছে ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, অর্থাৎ সার্ন-এর ভূ-অভ্যন্তরে ২৭ কিলোমিটার সুড়ঙ্গের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে করা হল এক পরীক্ষা। পদার্থবিদ্যার দুনিয়ায় গত কয়েক দশকের মধ্যে এত বড় কোনও যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়নি। কারণ, এ পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেলেন হিগস বোসনের অস্তিত্ব, যার তাত্ত্বিক আবিষ্কার করেছিলেন হিগস। এই অস্তিত্বটুকু প্রমাণের অপেক্ষা মাত্র ছিল। পরের বছরই, অর্থাৎ ২০১৩-তে, পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন হিগস।

পদার্থবিদ্যার দুনিয়ায় হিগস বোসন যেন সব সমস্যার সমাধান। যাকে ইংরেজিতে বলে ‘হোলি গ্রেইল’। এ যেন প্রোফেসর শঙ্কুর সর্বরোগহর ‘মিরাকিউরাল’ ক্যাপসুল। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ‘সাবঅ্যাটমিক’ বস্তু কীভাবে ভরের জোগান পায়, তার ব্যাখ্যা দেয় হিগস বোসন। নোবেল পাবার আগেই বিবিসি-র তথ্যচিত্র হিগস-কে অবিহিত করেছে ‘পার্টিকল ম্যান’ হিসেবে।

বাঙালি কিংবা ভারতীয়দের কাছে হিগস কিন্তু বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে স্মরণ করার একটা সুযোগ, যাঁর কাজের উপর ভিত্তি করেই হয়েছে হিগসের যুগান্তগারী গবেষণা। সত্যেন বোস নোবেল পাননি, কিন্তু বোসন কিংবা বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের উপর কাজ করে পরবর্তীকালে নোবেল পেয়েছেন অনেক বিজ্ঞানীই।

যাই হোক, সাধারণের মধ্যে হিগস বোসন বেশি পরিচিত ‘গড পার্টিকল’ হিসেবেই। নামটা এসেছে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত বই ‘দ্য গড পার্টিকল : ইফ দ্য ইউনিভার্স ইজ দ্য আনসার, হোয়াট ইজ দ্য কোয়েশ্চন?’ থেকে। বইটির একজন লেখক, লিওন লেডারম্যান, ১৯৮৮-র পদার্থবিদ্যায় নোবেল-বিজয়ী। অন্য লেখক, ডিক টেরেসি-ও নামজাদা বিজ্ঞান-লেখক। কিন্তু এই নামটির সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ। হিগস নিজেও একেবারে পছন্দ করেননি ‘গড পার্টিকল’ নামটি। বলেছেন, নামটি ভুল পথে চালনাকারী এক পরিহাস।

হিগসের অ্যাকাডেমিক জীবন কিন্তু আজকের সমাজের কাছে একটা আত্মদর্শনের দর্পণ হয়ে উঠতে পারে। একটু বিশদে বলা যাক। আজকের দুনিয়ায় যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের তাদের শিক্ষাবিদ-গবেষকদের কাছে প্রত্যাশা থাকে যে তাঁরা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে লিখে চলবেন একের পর এক গবেষণাপত্র এবং সেগুলো ছাপা হবে দেশ-বিদেশের নামীদামি গবেষণা-পত্রিকায়। এই নিরন্তর গবেষণাপত্র লিখবার একটা পারিপার্শ্বিক চাপ আজকের শিক্ষাজগতের সঙ্গে জুড়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে। দূর প্রাচ্য হোক বা ইউরোপ, মধ্য এশিয়া হোক কি আমেরিকা, মোটামুটি একই ছবি পৃথিবীর সর্বত্র। হিগস কিন্তু সন্দেহ পোষণ করেছেন যে আজকের শিক্ষাজগতের এই পরিকাঠামোর মধ্যে হিগস বোসনের সমপর্যায়ের যুগান্তকারী কাজ করা আদৌ সম্ভব কি না। নোবেল পুরস্কার নিতে স্টকহোম যাবার পথে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হিগস বলেছিলেন যে, কী পরিমাণ শান্তি এবং নিরুপদ্রব পরিবেশে তিনি তাঁর ১৯৬৪-র কাজ করতে পেরেছিলেন তা আজকের দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও কঠিন।

১৯৬০-এর দশক থেকে আজকের পৃথিবী অনেকটাই আলাদা নিঃসন্দেহে এবং উচ্চশিক্ষার জগৎটায় কী বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে ইতিমধ্যে তা কল্পনা করাও কঠিন। আজকের উচ্চশিক্ষার দুনিয়ায় নিয়োগ থেকে পদোন্নতি, মাইনে বাড়া থেকে গবেষণার জন্য অনুদানের পরিমাণ, চাকরি পাকা হওয়া থেকে অ্যাকাডেমিক সম্মান, সবই গবেষণাপত্র ছাপা হওয়ার সংখ্যা এবং গুণমানের সঙ্গে সমানুপাতিক। গবেষণাপত্রের গুণমান আবার নির্ধারিত হয় কোন গবেষণা পত্রিকায় তা ছাপা হয়েছে তার উপর। দুনিয়াজুড়ে গবেষণার মূল চালিকাশক্তি এই গবেষণাপত্র ছাপানোর তাগিদ, একথা বললে অত্যুক্তি হবে না।

আজকের উচ্চশিক্ষার দুনিয়ার মূলমন্ত্রই হল ‘পাবলিশ অর পেরিশ’। অর্থাৎ গবেষণাপত্র ছাপিয়ে চল নিরন্তর, অথবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হও। আসলে গবেষকদেরও বোধকরি আর কোনও উপায় নেই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকের দুনিয়ায় গবেষকদের উন্নতি এবং গবেষণা-ক্ষমতার মাপকাঠি হল এই গবেষণাপত্র- তাদের সংখ্যা এবং কোন কোন গবেষণা-পত্রিকায় সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে সেই তালিকা, সে তাঁরা তাঁদের গবেষক-জীবনের শুরুতে থাকুন বা পরিণতিতে। সে কারণেই উচ্চ মানের ভালো কাজ করার অভিপ্রায় বিসর্জন দিয়ে গবেষকদের ছুটতে হয় নিরন্তর গবেষণাপত্র ছাপানোর ইঁদুর দৌড়ে। এমন নয় যে ভালো মানের গবেষণা করার ক্ষমতা সকলের আছে। কিন্তু কারও কারও তো রয়েছে। তাঁরাও কিন্তু এই চাপে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, এই জাঁতাকলে পড়ে ভালো গুণমানের কাজ করা কঠিন, নিঃসন্দেহে।

আজকের দুনিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিয়ে তাদের গ্লোবাল র‍্যাংকিং-এর তালিকা প্রকাশ করে চলেছে অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান। আজকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কিন্তু এই র‍্যাংকিং নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিংয়ের একটা উপাদান কিন্তু সংশ্লিষ্ট গবেষকদের গবেষণাপত্রের সংখ্যা। অবশ্য এসব র‍্যাংকিংয়ের সারবত্তা নিয়েও অনেকেরই যথেষ্ট সংশয়।

হিগস কিন্তু তাঁর ১৯৬৪-র যুগান্তকারী আবিষ্কারের পরে বাকি জীবনে গবেষণাপত্র লিখেছেন ১০টিরও কম। ২০২২-এর বই ‘ইলিউসিভ : হাউ পিটার হিগস সলভড দ্য মিস্ট্রি অফ মাস’-এ লেখক ফ্রাঙ্ক ক্লোজ উদ্ধৃত করেছেন হিগসকে ; হিগস বলছেন যে হিগস বোসনই তাঁর জীবনের একমাত্র ‘অরিজিনাল আইডিয়া’। আসলে একগাদা ‘অর্থহীন’ গবেষণাপত্র ছাপাতে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না হিগস।

কিন্তু এ তো প্রচলিত সিস্টেমের প্রতি বিদ্রোহের শামিল। সে বড় সহজ কাজ ছিল না। এমনকি হিগসের মাপের বিজ্ঞানীর পক্ষেও না। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন হিগস। নিরন্তর গবেষণাপত্র লিখতেন না বলে তাঁর ডিপার্টমেন্টের কাছে বোঝা হয়ে পড়ছিলেন তিনি। আজকের দিনে প্রায় প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ই সংশ্লিষ্ট অধ্যাপকদের কাছে বছরে একবার বা দু’বার তাঁদের সাম্প্রতিক ছাপা হওয়া গবেষণাপত্রের হিসেব চায়। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় যখন এভাবে হিসেব চাইত, হিগস উত্তর দিতেন একটি শব্দে- ‘নান’। হিগস নিজেই বলেছেন যে, আজকের উচ্চশিক্ষার জগতের পরিবেশে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই তাঁকে চাকরি দিত না, কারণ তিনি যথেষ্ট ‘প্রোডাকটিভ’, অর্থাৎ ‘উৎপাদনশীল’ হিসেবে বিবেচিত হতেন না। এমনকি ১৯৮০-তে নাকি তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার কথাও ওঠে। ঘটনাচক্রে সে বছর তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। তাই আপাতভাবে বেঁচে যায় তাঁর চাকরি।

হিগস নিজে এই বর্ণনা দেবার পরে কেটে গিয়েছে এক দশকেরও বেশি। উচ্চশিক্ষা জগতের পরিস্থিতি যে হিগসের মতো গবেষকদের পক্ষে আরও খারাপ হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১৬-তে ‘নেচার’ পত্রিকা একটা সমীক্ষা চালায় প্রারম্ভিক গবেষক-অধ্যাপকদের উপর। দেখা গেল পরিস্থিতি আরও খারাপ- চাপ বেড়েছে, কমেছে গবেষণার অনুদান আর চাকরির নিরাপত্তা। দুনিয়াজুড়েই। গবেষকরা অনুদান এবং পদোন্নতির আশায় যেনতেনপ্রকারেণ গবেষণাপত্র ছাপাতে মরিয়া। সেসবের গুণমান নিয়ে কারও হেলদোল নেই। সমীক্ষায় দেখা গেল, আজকের দুনিয়ায় একজন গবেষক মাত্র ৩৮ শতাংশ সময় দিতে পারেন তাঁর গবেষণার কাজে। বাকি সময়টা যায় পড়ানো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রশাসনিক কাজকর্মে। তা সত্ত্বেও সিস্টেম হা-হুতাশ করে চলে, কেন আধুনিক আইনস্টাইন, ফেইনম্যান কিংবা মেরি কুরি তৈরি হচ্ছে না এই সিস্টেমের মধ্য দিয়ে!

এই সিস্টেমের মধ্যে হিগস এক বিরল ব্যতিক্রমী বিজ্ঞানী। তিনি যেন এক বিদ্রোহী, যিনি এই অবিরাম গবেষণাপত্র ছাপানোর চাপকে উপেক্ষা করতে পেরেছেন নিজের জীবনে। আজীবন যিনি চলেছেন নিজের ছন্দে, নিজের নিয়মে। সিস্টেমের চাপ আর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই। আর এর মধ্য দিয়েই হিগসের জীবন যেন চোখে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে আজকের বিশ্বের উচ্চশিক্ষার সিস্টেমের অসারতার দিকে। সিস্টেমকে নিয়ে আমাদের ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে তা।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

0
সিতাই: পরিযায়ী শ্রমিকের ছেলের ৯০ শতাংশ নম্বর মাধ্যমিকে। স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া।          কোচবিহার জেলার সিতাই ব্লকের আদাবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজলিকুড়া গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিকের ছেলে জয়ন্ত...

Abhishek Banerjee | ‘বাংলাকে ছোট করার চেষ্টা’, সন্দেশখালির ভিডিও নিয়ে বিজেপিকে তোপ অভিষেকের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সন্দেশখালির (Sandeshkhali) ভাইরাল ভিডিও নিয়ে বিজেপিকে কড়া ভাষায় তোপ দাগলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee)। তিনি বলেন,...

SSC Scam | যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে কোন স্বার্থে অযোগ্যকে চাকরি? এসএসসির  হলফনামা চাইল...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ যোগ্যপ্রার্থীকে বঞ্চিত করে কম নম্বরের প্রার্থীকে কোন স্বার্থে চাকরি দেওয়া হল? এই বিষয়ে এসএসসিকে হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিল কলকাতা...
huge amount of dead fish floating at mirik lake

Mirik Lake | মিরিক লেকে মাছের মড়ক, বন্ধ বোটিং

0
শিলিগুড়ি: মিরিক লেকে (Mirik Lake) ভেসে উঠছে মৃত মাছ (Dead Fish)। গত দু’দিন ধরে চলা এই ঘটনার জেরে প্রশাসনিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ...

Robbery | গৃহকর্তার অনুপস্থিতিতে ডাকাতি! স্ত্রী-মেয়ের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে লুট আড়াই লক্ষ টাকা ও...

0
ডালখোলাঃ গৃহকর্তার অনুপস্থিতিতে তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে মারধোর করে আড়াই লক্ষ টাকা ও প্রচুর পরিমাণে গয়না নিয়ে চম্পট দিল সশস্ত্র ডাকাতদল। শুক্রবার রাতে এই...

Most Popular