- পীযূষ আশ
শ্রীমা সারদা দেবী নিজেই বলে গিয়েছেন, ‘ছায়া-কায়া সমান’। শ্রীরামকৃষ্ণ কখনও পুরীধামে যাননি বলে শ্রীমা আঁচলে ঠাকুরের ফোটো নিয়ে শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথ দর্শনে গিয়েছিলেন। নিজে দর্শন করেছিলেন, আঁচলের আড়ালে রাখা শ্রীরামকৃষ্ণের ফোটোকেও জগন্নাথ দর্শন করিয়েছিলেন। বিদ্বানদের কেউ কেউ শিক্ষার উদ্দেশ্যে অনেক কথা বলেন। হয়তো সে সব কথা তাঁরা নিজেরাই বিশ্বাস করেন না। মা লোকশিক্ষার জন্য বহু পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলি শুধু কথার কথা নয়। ‘ছায়া-কায়া সমান’ কথাটি তিনি নিজেও কতটা বিশ্বাস করতেন, তার প্রমাণ পুরীধামের ঘটনায়।
জানুয়ারির ৩ তারিখ মায়ের আবির্ভাব তিথি। তিনি জগন্মাতা, শাস্ত্রে তাঁর অনন্তরূপের বর্ণনা আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদা দেবীর ছবি নিয়ে বহু বছর গবেষণা করেছেন আমেরিকার সেন্ট লুইস বেদান্ত সেন্টারের অধ্যক্ষ স্বামী চেতনানন্দ (১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত অদ্বৈত আশ্রমে ছিলেন এবং ফোটো বিভাগে কাজ করেছেন)। তিনি লিখেছেন, ‘অনন্তরূপিণী সারদার ধ্যান করতে গেলে মন দিশেহারা হয়ে যায়। তাই আমাদের কল্যাণে মা কৃপা করে ফোটোগ্রাফারদের মারফত আধুনিক ক্যামেরার ভিতর দিয়ে নিজের বহু ছবি রেখে গিয়েছেন যাতে আমরা তাঁর ধ্যান করতে পারি।’ মায়ের আবির্ভাব তিথির একদিন আগে আমরা তাই ছবি নিয়েই কিছুটা আলোচনায় যাই।
চেতনানন্দের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, শ্রীমার প্রথম তিনটি আলোকচিত্র তুলেছিলেন এক বিদেশি। নাম মিস্টার হ্যারিংটন। তিনটি ছবিই ১৮৯৮ সালে তোলা। মা তখন থাকতেন বাগবাজারে ১০/২ বোসপাড়া লেনের ভাড়াবাড়িতে। প্রথম দুই ছবিতে শুধু মা রয়েছেন। তৃতীয় ছবিতে শ্রীমা ও ভগিনী নিবেদিতা মুখোমুখি বসে।
মায়ের অনেক ছবি তুলেছেন ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথ। তিনি বহু বছর মায়ের সঙ্গেই ছিলেন। তবে আমরা আজ শ্রীমার দুটি বিশেষ ছবি নিয়ে আলোচনা করব। এই ছবি দুটি আলোকচিত্র নয়, হাতে আঁকা। শিল্পী দুজনই বিদেশি। ফ্রাঙ্ক ডোরাক আর জন মার্কোভিচ।
ফ্রাঙ্ক ডোরাকের জন্ম ১৮৬২ সালের ১৪ নভেম্বর। মৃত্যু ১৯২৭ সালের ৭ জুন। তিনি জাতিতে চেক। তখনও চেক আর স্লোভাকিয়া আলাদা হয়নি, চেকোস্লোভাকিয়াই ছিল দেশের নাম। জানা যায়, শিকাগো ধর্মমহাসভার সময় তিনি আমেরিকায় ছিলেন। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দর বক্তৃতার দিন ছবি আঁকার কাজ এসে পড়ায় লেকচার শুনতে যেতে পারেননি। মূলত পোর্ট্রেট শিল্পী হিসেবে খ্যাতি হয়েছিল ফ্রাঙ্ক ডোরাকের। ইউরোপ-আমেরিকার নানা শহরে তাঁর প্রদর্শনী হয়। ১৯০৫ সালে প্রাগে স্টুডিও তৈরি করেন। আমৃত্যু প্রাগেই ছিলেন।
বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইটে ডোরাক এবং তাঁর ছবি সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে। তবে ডোরাকের ভারত-যোগ বা ভারতীয় দর্শনের প্রতি আগ্রহের কথা বিস্তারিত পাওয়া যায় না ইন্টারনেটে। তাঁর ভারত-যোগের বিষয়ে কিছু কিছু কথা রয়েছে রামকৃষ্ণ-বেদান্ত সাহিত্যের কয়েকটি গ্রন্থে। ফ্রাঙ্ক ডোরাক শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন স্বামী অভেদানন্দের। তাঁর আঁকা শ্রীরামকৃষ্ণের তৈলচিত্র বিখ্যাত। পরে এঁকেছিলেন শ্রীমা সারদা দেবীর ছবিও। দুটি ছবিই এখন রয়েছে কলকাতায়, বেদান্ত মঠের দ্বিতলে। ডোরাক নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি এঁকেছিলেন।
মায়ের ছবিটির বিষয়ে অজানা নানা তথ্য দিয়েছেন স্বামী বলভদ্রানন্দ। যা প্রকাশিত হয়েছে ‘শতরূপে সারদা’ গ্রন্থে। বইটির সূত্রে জানা যাচ্ছে, সারদা দেবীর ছবিটি আঁকার কিছুদিন পর ফ্রাঙ্কের মৃত্যু হয়। তাঁর বোন হেলেনা ছবিটি কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে ছবিটি আবার ফেরত চলে যায় হেলেনার কাছে, চেকোস্লোভাকিয়ায়। ফ্রাঙ্ক চেয়েছিলেন মায়ের ছবিটি শ্রীরামকৃষ্ণের তৈলচিত্রের পাশে থাকুক। ভাইয়ের ইচ্ছার কথা মাথায় রেখে হেলেনা চিঠি লেখেন নিউ ইয়র্কে স্বামী অভেদানন্দের ঠিকানায়। অভেদানন্দ তখন কলকাতায়। চিঠিটি নিউ ইয়র্ক ঘুরে কলকাতায় পৌঁছায়। চিঠির উত্তরে অভেদানন্দ জানান, রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটের রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠে ডোরাকের আঁকা ঠাকুরের ছবিটি রয়েছে। মায়ের ছবিটি হেলেনা কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে পারেন। তাতে ডোরাকের ইচ্ছা অনুযায়ী দুটি ছবি একত্রে থাকবে।
ডোরাকের আঁকা মায়ের ছবি কলকাতায় এসে পৌঁছায় ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। স্বামী অভেদানন্দ ছবিটি সংগ্রহ করতে গেলেন শুল্ক বিভাগের দপ্তরে। শুল্ক দপ্তর থেকে জানানো হল, বিদেশ থেকে পাঠানোর অয়েল পেন্টিংয়ের জন্য ৭৫ টাকা কাস্টমস ডিউটি দিতে হবে। স্বামী অভেদানন্দর কাছে তেমন টাকাপয়সা কিছুই ছিল না। কী করবেন ভাবছেন। ঘটনাচক্রে সেই সময় শুল্ক দপ্তরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন ‘উদ্বোধন’-এর গণেন মহারাজ। অভেদানন্দকে দেখে তিনি কাস্টমস অফিসের ভিতরে যান। সব কথা শুনে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখেন ঠিক ৭৫ টাকাই রয়েছে। ওই টাকা দিয়ে ডোরাকের ছবির শুল্ক মেটানো হয়। ফ্রাঙ্কের আঁকা শ্রীমার অয়েল পেন্টিং, ঠাকুরের ছবির পাশেই তদবধি রয়েছে কলকাতায়, বেদান্ত মঠের বাড়িতে।
গবেষকরা বলছেন, ছয়বার ফোটো তোলা হলেও শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি রয়েছে পাঁচটি। অন্যতম গৃহীভক্ত রামচন্দ্র দত্ত একটি ছবি তুলিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ ছবিটি পছন্দ করেননি, ছবি দেখে বলেছিলেন, ‘আমি কি এতই রাগী’! আলোকচিত্র ঠাকুরের পছন্দ হয়নি বুঝে রাম দত্ত ছবির প্রিন্ট এবং নেগেটিভ গঙ্গাজলে ভাসিয়ে দেন। শ্রীমার ছবির সংখ্যা ঠাকুরের তুলনায় বেশি। যাই হোক, মায়ের অধিকাংশ ছবিই বেশি বয়সের। এই প্রসঙ্গে ডোরাকের আঁকার প্রশংসা করে স্বামী অভেদানন্দর মন্তব্য ছিল, ‘শ্রীশ্রীমায়ের বার্ধক্যের ফোটো অনেক আছে। আমি তো বারণ করেছি, তা না ছাপানোই ভালো। অবতারের বার্ধক্য দেখাতে নেই। তিনি পূর্ণ। ফ্রাঙ্ক ডোরাক কেমন তৈলচিত্র এঁকেছে! মায়ের ফোটো খুব ভালো হয়েছে। এমনটি আর এদেশে আঁকতে পারবে না। ঠিক ষোড়শী মূর্তি। যেন জ্যোতির্ময়ী হয়ে বসে আছেন।’
জন মার্কোভিচের ছবি অবশ্য এত ঘটনাবহুল নয়, তবে খুবই প্রশংসিত। তাঁরা আঁকা শ্রীরামকৃষ্ণ এবং মায়ের ছবি আমেরিকার বিভিন্ন বেদান্ত সেন্টারে রয়েছে। রামকৃষ্ণ-বেদান্ত সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। নিবন্ধের সঙ্গে প্রকাশিত মার্কোভিচের আঁকা ছবিটি শ্রীমার অন্যতম সেরা প্রতিকৃতি হিসেবে স্বীকৃত।
মার্কোভিচের জন্ম ডেট্রয়েটে ১৯৩২ সালের ১৬ জানুয়ারি। ছোট থেকে ছবি আঁকায় ঝোঁক। অঙ্কন-দক্ষতার সুবাদে পেয়েছিলেন বৃত্তি, তা নিয়ে ১৯৫০ সালে যোগ দেন কলোরাডো স্প্রিং স্কুল অফ ফাইন আর্টসে। মার্কোভিচের কেরিয়ার শুরু আমেরিকার নৌসেনায়। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন ইউএস নেভিতে। আঁকার দক্ষতা কাজে লেগেছিল ফৌজি জীবনেও। নেভির একাধিক প্রকাশনায় তিনি ছবি এঁকেছেন বা ডিজাইন করেছেন।
নৌবহরে থাকার সময়েই তাঁর হাতে আসে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে একটি বই। ছেড়ে দিলেন চাকরি। চলে গেলেন লস অ্যাঞ্জেলেসে। সেখানে তিনি দুটি কাজ করলেন। আর্ট স্কুলে যোগ দিলেন। সেইসঙ্গে নাম নথিভুক্ত করালেন সেখানকার বেদান্ত সোসাইটিতে নিয়মিত বক্তৃতা শোনার জন্য।
এরপর থেকে মার্কোভিচের জীবনে দ্রুত বদল আসতে শুরু করে। ১৯৫৯ সালে হলিউড সেন্টারে যোগ দিলেন। সেখানে পাঁচ বছর থাকার পর তাঁকে পাঠানো হল ট্রাবুকো মনাসটেরিতে। ১৯৬৫ সালে ব্রহ্মচর্য, ১৯৭১-এ সন্ন্যাস রামকৃষ্ণ সংঘে।
বিখ্যাত সাহিত্যিক ক্রিস্টোফার ইশারউডের লেখায় একাধিকবার জন মার্কোভিচের উল্লেখ রয়েছে। ইশারউডের লেখা থেকে জানা যায় ব্রহ্মচারী হিসেবে জন মার্কোভিচের নাম ছিল নির্মল। সন্ন্যাসের পর তাঁর নাম হয় স্বামী তদাত্মানন্দ। ইশারউড তাঁর ডায়ারির তৃতীয় খণ্ড ‘লিবারেশন’-এ লিখছেন, ‘ভারত থেকে খবর পেলাম লেন, মার্ক আর পল সন্ন্যাসী হয়েছে। তাদের নাম এখন যথাক্রমে স্বামী ভদ্রানন্দ, তদাত্মানন্দ আর অমোহানন্দ। একদিন নৌকায় দক্ষিণেশ্বরে যাওয়া ছাড়া তাদের মঠের ভিতরেই থাকতে হয়েছে। কলকাতায় খুব গোলমাল চলছে। তবে মিসেস গান্ধি ভোটে জিতেছেন যখন, আশা করা যায় পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’ ইশারউডের ডায়ারিতে এটি ১৯৭১ সালের ১২ মার্চের এন্ট্রি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের আঁচে কলকাতা গনগনে। তদাত্মানন্দের সন্ন্যাস জীবনের শুরুর কথা বলতে গিয়ে কলকাতা-ইতিহাসের খণ্ডচিত্র এঁকে দিয়েছেন ইশারউড।
মায়ের শুভ আবির্ভাব তিথির আগে মনে হয়, অন্য দেশ, অন্য সংস্কৃতির মানুষ হয়েও তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ-শ্রীমা সারদাকে। শ্রীমা ও শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি এঁকেছেন বা ছবি নিয়ে কাজ করেছেন যেসব বিদেশি শিল্পী, ডোরাক কিংবা তদাত্মানন্দের অয়েল পেন্টিং তার একমাত্র নিদর্শন নয়। আমেরিকার শিল্পী জন হেনচ শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রাইন পোজ বা পূজিত মূর্তির ছবি হলিউডে বসে রেস্টোর করেছিলেন। জন হেনচ ডিজনি স্টুডিওয় কাজ করতেন। ওয়াল্ট ডিজনির মৃত্যুর পর তিনি ছিলেন মিকি মাউসের অফিশিয়াল পেন্টার। শিল্পনৈপুণ্যের জন্য পেয়েছিলেন অস্কার। ডিজনি স্টুডিওয় বসে, প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যে সিঙ্গল হেয়ার ব্রাশ ব্যবহার করে ঠাকুরের পূজিত মূর্তির ছবি রেস্টোর করেছিলেন। এই কাজের জন্য তাঁর সময় লেগেছিল দুই বছর। রামকৃষ্ণ-বেদান্ত সাহিত্যের পাশাপাশি সংঘের শিল্পচর্চার পরম্পরা নিয়ে যদি আলোচনা করতে হয়, তবে এইসব বিদেশি শিল্পীর নাম উঠে আসবেই। যুগপুরুষ-জগন্মাতা এভাবেই দেশকালের গণ্ডি ভেঙে দেন। জন হেনচ, ফ্রাঙ্ক ডোরাক কিংবা জন মার্কোভিচ সেই বেড়া ভাঙারই অনন্য উদাহরণ।
(লেখক সাংবাদিক। উদ্বোধন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত)