Monday, April 29, 2024
Homeকলামঐক্যের ভিতে ক্ষমতার ঘা, চারপাশেই বিভেদ-বিষ

ঐক্যের ভিতে ক্ষমতার ঘা, চারপাশেই বিভেদ-বিষ

  • গৌতম সরকার

ওহ রাজনীতি! হায় রাজনীতি!

চোখের সামনে ভেঙে দিল ঐক্যের শক্তিটাকে। দেশের পরিচয়ের দাবিতে যাঁরা দীর্ঘ আন্দোলন করেছেন, তাঁরা এখন আলাদা আলাদা। সংসারে খাবারের জোগান থাক বা না থাক, কারও ঘরে ঘাসফুল ফুটে আছে, কারও ঘরে পদ্মফুল। রাজনীতির থুড়ি ক্ষমতার কারবারে বিভাজনে বিষাক্ত সাবেক ছিটমহলের পরিবেশ। যেখানে হাতে হাত ধরে, কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে ভূখণ্ডে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার অনেক লড়াইয়ের প্রত্যক্ষদর্শী আমি।

ছিটমহল আন্দোলন ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন, এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন…।’ সেই সহস্র মন, সহস্র জীবনের বাঁধন গিয়েছে টুটে। কর্মসূত্রে কোচবিহারে থাকাকালে, পরবর্তী সময়ে কলকাতায় থাকাকালীনও সেই সহস্র মনের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ ছিল। কতবার যে গিয়েছি পোহাতুরকুঠি, গোবরাছড়া, মশালডাঙ্গা ইত্যাদি জনপদে…। এ সব একেকটি ছিটমহলের নাম।

আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে তারপর এল ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ২০১৫-র ৩১ জুলাই ও ১ অগাস্টের মাঝরাতে কাগজে-কলমে ৫১টি বাংলাদেশি গ্রাম মিশে গেলে ভারতীয় ভূখণ্ডে, ১১১টি ভারতীয় গ্রাম ঢুকে গেল বাংলাদেশে। ২০১০-এ দু’দেশের যৌথ শুমারি অনুযায়ী ৫১,৫৪৯ জনের দাঁতে দাঁত চেপে আন্দোলনের ফল মিলল। চিহ্নিত হল কে কোন দেশের নাগরিক। মিলল ভোটাধিকার। কিন্তু তারপর..। এক অন্ধকারের যাত্রা। প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ নিমেষে হয়ে গেলেন ভোটব্যাংক।

রবীন্দ্রনাথ ঘোষ প্রমুখ কোচবিহারের তৃণমূল নেতারা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বুঝিয়েছিলেন, ছিটমহল বিনিময় হলে এই মানুষগুলির ভোট যুক্ত করা যাবে জোড়াফুলের ঝুলিতে। সেই উদ্দেশ্যসাধনে ছিটমহল বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল তৃণমূলের তৎপরতা। ছিটমহল আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের একাংশ এই খবরদারি সহ্য করতে না পেরে পদ্ম শিবিরে আশ্রয় নিলেন। সাধারণভাবে এই তথ্য সকলেরই প্রায় জানা। কিন্তু সম্প্রতি মাথাভাঙ্গার গবেষক রাজর্ষি বিশ্বাসের একটি লেখা আমার গালে যেন চড় কষাল।

মাথাভাঙ্গার দীর্ঘদিনের প্রকাশনা সংস্থা ‘বিবৃতি সাহিত্যে’র বই ‘উত্তরের জানালা’য় রাজর্ষির সেই লেখা সংবিৎ ফেরাল আমার। বুঝলাম, সাংবাদিকতা পেশার তাগিদে হিল্লি-দিল্লি, চেন্নাই-কাশ্মীর, ওয়াশিংটন-বেজিং, দেশদুনিয়ার যত খবরেই চোখ থাকুক না কেন, ‘পাওয়ার সিন্ডিকেটে’র আঘাতে সাবেক ছিটমহলের জনতার ছিন্নভিন্ন চেহারাটা ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া।’ রাজর্ষি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোয় হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

ছিটমহল বিনিময়ের পর বাংলার প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিটমহলের ঐক্যে শেষ পেরেকটি পুঁতেছিল। রাজর্ষি লিখেছেন, ‘আকাশে-বাতাসে উড়তে থাকে কাঁচা টাকা। যে যেভাবে পারছে তালুবন্দি করছে। অভুক্ত মানুষ যেমন খাদ্য পেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে…। কোথা থেকে টাকা আসছে, কোন উদ্দেশে আসছে…ভাবার সময় তাদের কারও ছিল না।’ লেখাটা পড়ার পর গত প্রায় এক মাস নতুন করে অতীতের ছিটমহলগুলির সুলুকসন্ধান শুরু করলাম।

সেই খোঁজখবরে মিলে গেল রাজর্ষির গবেষণালব্ধ তথ্য। কাঁচা টাকা হাতে পাওয়ার সেই স্বপ্নের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু বিষ পুঁতে দিয়ে গিয়েছিল। বিভাজনের জটিল পাকচক্রে হারিয়ে গেল এককাট্টা থাকার সোনালি দিনগুলি। মাথাভাঙ্গার তরুণ লেখকের কথায়, ‘একদল টাকার লোভে উন্মত্ত, আরেকদল বিদ্বেষের নোংরা রাজনীতির খেলায়… এতকাল একসঙ্গে যারা সুখেদুঃখে পথ হেঁটেছে- তারাই এখন অর্থলোলুপ! কুটিল! হিংসাশ্রয়ী! ছন্নছাড়া! দিগভ্রান্ত! এবং পরস্পরের শত্রু!’

মনে পড়ে গেল আটের দশকে মনে গেঁথে যাওয়া একটি কবিতার লাইন, ‘ঝড়-জল ঝঞ্ঝা রাতে যারা ছিল একদিন প্রেরণার সাথী, তাদের অনেকে আজ ঘোরে নিয়ে ছুরি…।’ মশাল নিভে গিয়েছে ছিটমহল আন্দোলনের অন্যতম ধাত্রীভূমি মশালডাঙ্গায়।

ওহ রাজনীতি! হায় রাজনীতি!

শুধু কী আর ছিটমহল, সমাজের সবক্ষেত্রে সন্দেহের বিষের উৎস যেন ক্ষমতার কারবার। ঘরের মধ্যে ঘর তৈরি করে। বিভেদের আগুন যখন জ্বলে, তখন শুধু অন্যকে পোড়ায় না, ঘরে যারা থাকে, তাদেরও পোড়ায়।

পাওয়ার সিন্ডিকেট আজকাল কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের স্মরণ নেয়। তৃণমূল নেতারা বলেন, কবিগুরুর বাংলা, নজরুলের বাংলা। অমিত শা বাংলায় এসে ভাষণে বলেন, রবিবাবু, বঙ্কিমবাবু। কিন্তু একসূত্রে সহস্রটি মন বাঁধার কথা কেউ বলেন না। নজরুলের ‘এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’-এর ভাবনাটা যেন প্রহসন হয়ে উঠেছে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় ক্যালেন্ডারে তাকিয়ে দেখলাম, দিনটি জামাত-উল-বিদা। লেখাটি প্রকাশের দিন বারুণী স্নান।

আগামী সপ্তাহে পাশাপাশি ইদ, নীলপুজো, চড়কপুজো। পার্বণের, ধর্মীয় আচারের দিনগুলি পাশাপাশি থাকলেও মানুষের সহাবস্থান, পরস্পরের প্রতি মর্যাদা কোথায়? এই ছবি দেখলে কি নজরুল লিখতেন, ‘মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ…?’ তার পরের সপ্তাহে পরপর অন্নপূর্ণাপুজো, রামনবমী। একই ধর্মের দুই পার্বণ। অথচ রামনবমীকে ঘিরে প্রতিবছর বাংলায় তাল ঠোকাঠুকি এখন নিয়ম হয়ে গিয়েছে। কে বড় রামভক্ত, তার প্রতিযোগিতা। সবার ওপরে বিভাজন সত্য, তাহার ওপরে নাই।

ঘরের মধ্যে ঘর। কোচবিহারে তৃণমূলের উদয়ন গুহ আর মির মহম্মদের মিলমিশ নেই কেন? সতর্ক করতে হয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রায়গঞ্জে বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরীকে প্রার্থী করা হল না কেন? দলের একাংশের তীব্র প্রতিবাদে। জলপাইগুড়িতে বিজেপির বাপি গোস্বামীর সঙ্গে বিরোধে দল ছেড়েছেন দলের পুরোনো দিনের সৈনিক দীপেন প্রামাণিক। মালদায় একই দলের কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী ও সাবিত্রী মিত্রর আকচা-আকচি তো ইতিহাস।

ওহ রাজনীতি! হায় রাজনীতি!

ঘরের ঐক্যও রাখতে পারে না। সমাজের একতা রাখবে কী করে? বরং বিষে নীল করে দিচ্ছে সব। ধর্মীয় বিভেদ, জাতপাতের বিভেদ, দলাদলির বিভেদ, দলের মধ্যে বিভেদ। পৃথিবীটাকেই যেন ভাগ করে নিচ্ছে পাওয়ার সিন্ডিকেট। যেভাবে জমি মাফিয়া, বালি সিন্ডিকেট, কয়লা পাচারকারীরা এলাকা ভাগ করে নেয়। সবাই যেন বলছে, বিভেদের জয়গান গাও। খেলা হবে স্লোগান জোরালো। সেই খেলা কীসের? ভাগাভাগির খেলা। যাতে প্রাণান্ত আমাদের, পাঁচ পাবলিকের।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Telangana | অমিত শাহের ভিডিও বিকৃতির জের, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীকে সমন দিল্লি পুলিশের

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ-র বিকৃত করা ভিডিও তেলেঙ্গানা কংগ্রেসের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে শেয়ার করার অভিযোগে দিল্লি পুলিশ সমন পাঠাল তেলেঙ্গানার...

Narendra Modi | বাতিল শা’র সভা, ৩ মে নির্বাচনি প্রচারে কৃষ্ণনগরে আসছেন মোদি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: আগামী ১৩ মে চতুর্থ দফায় লোকসভা ভোট (Lok Sabha Election 2024) কৃষ্ণনগরে (Krishnanagar)। তার আগে মহুয়া মৈত্রের (Mahua Moitra) কৃষ্ণনগরে...

CM Mamata Banerjee | ‘সিপিএম কিনলে কংগ্রেস ফ্রি’, জোটকে কটাক্ষ মমতার

0
খড়গ্রাম: দেশের সর্বোচ্চ আদালত যখন নিয়োগ দুর্নীতিতে রাজ্যকে ধাক্কা দিল, ঠিক তখন মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামের নির্বাচনি জনসভা থেকে ফের শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবিকে উসকে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী...

TMC | নির্বাচনি আচরণবিধির পরোয়া নেই, সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন তৃণমূলনেত্রী

0
হরিশ্চন্দ্রপুর: নির্বাচনি আচরণবিধি চলছে। কিন্তু তা তোয়াক্কা করছেন না তৃণমূলের ব্লক সভানেত্রী তথা জেলা পরিষদের সদস্য। নির্বাচনি আচরণবিধি চলাকালীনই তৃণমূলের(TMC) হরিশ্চন্দ্রপুর-১ (বি) সাংগঠনিক ব্লকের...

Govt Ambulance | সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের সংখ্যা কম, ক্ষোভ উত্তর দিনাজপুরে

0
বিশ্বজিৎ সরকার, রায়গঞ্জ: উত্তর দিনাজপুরে (Uttar Dinajpur) সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স (Govt Ambulance) সংখ্যায় অনেক কম। গোদের ওপর বিষফোঁড়া জটিল পরিষেবা পদ্ধতি। অনেকেরই সেই পদ্ধতি জানে...

Most Popular